শনিবার, ২০ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ টেলিভিশনের সোনালি দিনগুলো

ইমদাদুল হক মিলন

বাংলাদেশ টেলিভিশনের সোনালি দিনগুলো

ব্যাপারটা হলো কি, শমী কায়সার বলল, ‘আমি দৌড়ে নামব না। লাফ দিয়ে নামব।’ বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমার প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘কোন কাননের ফুল’-এর শুটিং চলছে। প্রযোজক ফখরুল আবেদীন দুলাল। স্টুডিওতে সুন্দর সেট তৈরি করা হয়েছে। শমীর বড় ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করছেন খালেদ খান। তাঁর ডাকনাম যুবরাজ। আমার অত্যন্ত প্রিয় অভিনেতা ছিলেন। অতি অল্প বয়সে, আমাদের সবাইকে বেদনার্ত করে চলে গেলেন। তাঁর স্ত্রী মিতা হক আমার খুব পছন্দের রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী। যুবরাজ নিজেও গান করতেন। মিতাও অকালে চলে গেল। এখন ওদের কন্যাটি গান করে। একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে যুবরাজ এক রাতে খালি গলায় রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গান গেয়েছিলেন। শুনে আমি আবিষ্ট হয়েছিলাম। শুধু গানের জগতে থাকলেও যুবরাজ অনেক বড় শিল্পী হতেন। মঞ্চে দুর্দান্ত অভিনয় দেখেছি তাঁর, দেখেছি টেলিভিশনে। আমার ‘রূপনগর’ ধারাবাহিকে ‘হেলাল’ নামের খলচরিত্রে অভিনয় করে এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিলেন, এখনো সেই সময়কার দর্শকরা যুবরাজের কথা বলে। খলচরিত্র এত জনপ্রিয় হতে পারে, তাও টেলিভিশনের মতো জায়গায়, সেই সময় এসব আমাদের ধারণার মধ্যে ছিল না। আমার ছোট মেয়েটি তার তিন-চার বছর বয়সের সময় বাড়ির কেউ কোনো ভুল কাজ করলে খুবই মিষ্টি করে বলত, ‘ছি ছি তুমি এত খারাপ?’ এ সংলাপটি আমি ‘রূপনগর’ নাটকে খালেদ খানের মুখে লাগিয়ে দিলাম। সংলাপটি জনপ্রিয় হলো, মানুষের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। বাস ট্রাকের পেছনে সংলাপটি লেখা হতে লাগল। ‘বারো রকম মানুষ’ ধারাবাহিকেও একই কান্ড হয়েছিল। ওই নাটকে ছোটভাই শ্যামল জাকারিয়া অত্যন্ত হেড়ে ও বেসুরো গলায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করে। গানের মাঝখানে বড়ভাই তারিক আনাম খান এলে গান থামিয়ে জানতে চায় ‘গান কেমন হচ্ছে?’ বড়ভাই গম্ভীর গলায় জবাব দেন ‘থামলে ভালো লাগে।’ এ সংলাপটিও ব্যাপক হারে লেখা হতে লাগল বাস ট্রাকের পেছনে। আজকাল আর এমন হয় না, তখন হতো। তখন বিটিভির স্বর্ণযুগ। আমাদের নাটক দেখার জন্য নাটক প্রচারের রাতে রাস্তাঘাট খালি হয়ে যেত। ‘বারো রকম মানুষ’ ছিল কমেডি ধাঁচের নাটক। সুবর্ণার সঙ্গে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন নাদের চৌধুরী। টিভি নাটকে ওটাই ছিল তাঁর বড় চরিত্রে অভিনয় করা।

হুমায়ূন আহমেদের নাটকে অভিনয় করে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছে ফারুক আহমেদ। ফারুকের অভিনয় আমি প্রথম দেখি মহিলা সমিতির মঞ্চে। সে ঢাকা থিয়েটারের কর্মী ছিল।  ‘বারো রকম মানুষ’ এ একটি বিশেষ চরিত্রে তাঁকে আমি নিয়ে এলাম। ‘বারো রকম মানুষ’ই বোধহয় টেলিভিশনে ফারুকের প্রথম নাটক। রফিকুল্লাহ সেলিম, মিজানুর রহমান, কামাল বায়েজিদ আর এখন নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করে নাদিয়া, ওদের যাত্রা শুরু হয়েছিল এই নাটকের মধ্য দিয়ে। বিখ্যাত সালাহউদ্দিন লাভলু অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল ‘কোন কাননের ফুল’-এ অভিনয় করে। কমেডি চরিত্র। এ নাটকের আরেকটি প্রধান চরিত্রে ছিল আজিজুল হাকিম। যতদূর মনে পড়ে আজিজুল হাকিম ও সালাহউদ্দিন লাভলুর প্রথম ধারাবাহিক ‘কোন কাননের ফুল’। সম্ভবত শমীরও। তার আগে ’৮৮ সালের দিকে আবদুল্লাহ আল মামুন বিটিভির জন্য নতুন একটি পরিকল্পনা করেছিলেন। তিন পর্বের খন্ডনাটক তৈরি করবেন। প্রথম নাটকটি লিখতে বললেন আমাকে। লিখলাম ‘যত দূরে যাই’। মূল চরিত্রে শমী কায়সার ও তৌকীর আহমেদ। টেলিভিশনে শমীর দ্বিতীয় নাটক ছিল ‘যত দূরে যাই’। সম্ভবত তৌকীরেরও। এ নাটকের প্রযোজকও ফখরুল আবেদীন দুলাল। আসাদুজ্জামান নূর অভিনয় করেছিলেন একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে। দেশ স্বাধীন করে নিজ এলাকায় ফিরেছেন। তখন একজন রাজাকার তাঁকে গুলি করেছিল। ফলে মুক্তিযোদ্ধার একটি পা নষ্ট হয়ে যায়। তৌকীরদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ওদের বাড়িতে থেকে সারা দিন ঘুরে বেড়ান নূরভাই। তিনি জানেন সেই রাজাকারটি বেঁচে আছে। মুক্তিযোদ্ধা খুঁজছেন রাজাকারকে। রাজাকারদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার ইঙ্গিত ছিল এই নাটকে। ‘যত দূরে যাই’ এর দু’তিনটি মজার ঘটনা মনে পড়ছে। এই নাটকে ফেরদৌসী মজুমদারের ছোটভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রামেন্দু মজুমদার। তাঁরা পর্দায় এলেই, রামেন্দুদা যখন ফেরদৌসী আপাকে ‘বুবু বুবু’ করছেন, ওই শুনে দর্শকরা খুব মজা পেত। ব্যক্তিজীবনের স্বামী নাটকে স্ত্রীকে ‘বুবু’ ডাকছে! দর্শকদের মজা পাওয়ারই কথা। তারানা হালিমের চরিত্রটি ছিল খুব আনন্দ মাখা। নূরভাই তৌকীরদের বড়লোক বাড়ির গেস্টরুমে থাকেন। লুঙ্গি পরে কলসি থেকে পানি ঢেলে খেতে গেছেন, পানি ঢালতে বসার সঙ্গে সঙ্গে প্যার প্যার করে তাঁর লুঙ্গি ছিঁড়ে গেল। আরেকটি ঘটনা খুব মনে পড়ে, শমী আর তৌকীরের ১১ মিনিট ধরে সংলাপের একটি দৃশ্য ছিল। টানা অভিনয় করে গেল দুজনে। এক শর্টেই ওকে! আজকাল নাটকের রিহার্সেল হয় না শুনেছি। অভিনেতা অভিনেত্রীরা নাকি স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করা তো দূরের কথা, অনেক সময় পড়েও দেখেন না। সেটে এলে নাকি পরিচালক দৃশ্যটির ইঙ্গিত দিলে তাঁরা অনেকেই নিজেদের মতো করে সংলাপ বলে যান। বিটিভির সেই সোনালি যুগে এসব কেউ কল্পনাও করতে পারত না।

‘কোন কাননের ফুল’ এর যে দৃশ্যে শমী লাফ দিয়ে নামতে চাইল, সেই দৃশ্যটা ছিল এমন- বাড়ির ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে শমী। তখনই রাস্তায় দেখা গেল তার বড়ভাই খালেদ খানকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে মাস্তানরা। এই দেখে ভয়ার্ত শমী দৌড়ে ছাদ থেকে নামবে। ইনডোর আর আউটডোর মিলিয়ে দৃশ্যটি তৈরি করা হবে। স্টুডিওতে ছাদ এবং সিঁড়ির সেট বানানো হয়েছে। দুলাল দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছে শমীকে। তখন নিজের লেখা নাটকের শুটিংয়ে আমি নিয়মিত থাকতাম। সেদিনও ছিলাম। দুলালের ডিরেকশন মন দিয়ে শুনল শমী। দুলাল আর আমাকে সে আংকেল ডাকে। দুলালের কথা শুনে দৃশ্যটি অতি বাস্তবসম্মত করার জন্য শমী বলল, সে দৌড়ে নামবে না, তিন চার সিঁড়ির ওপর থেকে লাফ দিয়ে নামবে। ফখরুল আবেদীন দুলাল এক অসামান্য চরিত্র। অতি সুদর্শন, রসে টইটম্বুর। কথা বলে মানুষকে হাসাতে হাসাতে মেরে ফেলবে। শমীর কথা শুনে অতি বিনীত ভঙ্গিতে বলল, ‘মা, মাগো, মা জননী, এই কাজটি কোরো না মা। পা-টা ভেঙো না। তাহলে আমার নাটকটি বন্ধ হয়ে যাবে।’ শমী বলল, ‘কিচ্ছু হবে না আংকেল, আপনি দেখেন না, কী সুন্দরভাবে লাফটা আমি দেই।’ শমীর কথা শুনে আমারও ভয় লাগছে। এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘এটা কোরো না শমী, বিপদ হতে পারে।’ তখন শমীকে ‘তুমি তুমি’ করে বলতাম। তারপর তো ‘তুই’ হয়ে গেছে। শমীর মা বলতেন, ‘শমী তোমার বড় মেয়ে।’ যাই হোক, আমার কথাও শুনল না শমী। লাফটা সে দিল, যথারীতি পা ভাঙলো। দুলাল মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। সর্বনাশ হয়ে গেছে। শমী তখন উঠে দাঁড়াতে পারছে না। ব্যথায় কাতরাচ্ছে। ধরাধরি করে তাকে গাড়িতে তুলে দেওয়া হলো। নাটক বন্ধ। মাসখানেক পর অবশ্য সুস্থ হয়ে নতুন করে নাটকটিতে আবার অভিনয় শুরু করেছিল। শমীকে নিয়ে আমি অনেক নাটক করেছি। ‘একজনা’ নাটকটির কথা মনে পড়ছে। শমী ছিল বুলবুল আহমেদের মেয়ে। বুলবুল আহমেদ ছিলেন মুুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার দিন ঢাকার এক গলিতে বছর তিনেক বয়সের একটি শিশুকন্যাকে খুঁজে পেয়েছিলেন। সেই মেয়েই ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের সবকিছু। মেয়েটি তা জানে না। এক দুষ্টু আত্মীয় ইউনিভার্সিটিতে পড়া মেয়েটিকে এই তথ্য একদিন জানিয়ে দেয়। শুনে এত ক্ষিপ্ত হয় মেয়ে, পিতলের একটি ফুলদানি দিয়ে প্রচন্ড আঘাত করে সেই লোককে। লোকটি মারা যায়। পুলিশ শমীকে নিয়ে যাচ্ছে, এ সময় অফিস থেকে ফেরেন বুলবুল আহমেদ। তারপর বাপ-মেয়ের গভীর আবেগের দৃশ্য আর কান্না। দৃশ্যটি এত প্রাণবন্ত হলো, সেটের অনেকেই নিঃশব্দে চোখ মুছতে লাগল। ওই নাটকের পরিচালক ছিলেন সম্ভবত রিয়াজউদ্দিন বাদশা। টেক ওকে হয়ে গেল। কিন্তু শমীর কান্না আর থামছে না। আকুল হয়ে কাঁদছে সে। আমরা কেউ তাকে থামাতেই পারছি না। কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলছে, ‘আমার বাবার কথা মনে পড়ছে।’ ‘রূপনগর’ নাটকে বিপাশাও এমন করে কেঁদেছিল একদিন। খুবই আবেগের দৃশ্য ছিল। শর্ট ওকে হয়ে যাওয়ার পরও বিপাশার কান্না থামছিল না। ভালো শিল্পীরা চরিত্রের সঙ্গে এমনভাবে মিলেমিশে যান, চট করে সেখান থেকে বেরোতে পারেন না। শমী বিপাশার ক্ষেত্রে এটা আমি দেখেছি। সুবর্ণার ক্ষেত্রে দেখেছি বহুবার। ফরীদি ও আফজালের ক্ষেত্রে দেখেছি। আসাদুজ্জামান নূরের ক্ষেত্রে তো দেখেছিই।

শমী আর তৌকীরের জুটি আমার খুব পছন্দের ছিল। বেশ কয়েকটি নাটক ওদের নিয়ে আমি করেছি। ‘যুবরাজ’ ধারাবাহিকে তিনটি চরিত্রে অভিনয় করেছিল শমী। তার নায়ক তৌকীর। ‘আলতা’ নাটকেও শমীর নায়ক তৌকীর। আরেকটি নাটক ছিল ‘ভুল’। আমার খুব প্রিয় নাটক ‘কোথায় সেজন’। যমজ বোনের চরিত্রে অতুলনীয় অভিনয় করেছিল শমী। প্যাকেজ নাটক শুরু হওয়ার পর দ্বিতীয় নাটক ছিল ‘কোথায় সেজন’। আবদুল্লাহ আল মামুন আমার লেখা দুটো নাটক তৈরি করেছিলেন। একটির নাম ‘অকূল দরিয়া’, আরেকটি ‘অপরবেলা’। ‘অকূল দরিয়া’য় অভিনয় করেছিলেন ফেরদৌসী মজুমদার। একটি ভাসমান, অসহায় গ্রাম্য নারী চরিত্র। কিছুদিন পর পরই আশ্রয় বদলাতে হতো তাঁকে। এক আশ্রয় থেকে আরেক আশ্রয়ে যাচ্ছেন, সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ বদলে যাচ্ছে, গল্পও বদলে যাচ্ছে। ফেরদৌসী আপার অসাধারণ অভিনয়গুণে নাটকটি উজ্জ্বল হয়েছিল। ‘অপরবেলা’ ছিল প্রেমের নাটক। আফজাল হোসেন, শম্পা রেজা ও নৃত্যশিল্পী নিপা অভিনয় করেছিলেন। আর মামুন ভাইয়ের কাছে আমার নাটক লেখার হাতেখড়ি হয়েছিল শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিতে গিয়ে। তিনি আমার অনেক নাটকে অভিনয়ও করেছেন। ‘ফুলের বাগানে সাপ’ একেবারে নতুন ধরনের রোমান্টিক নাটক ছিল। আফজালের সঙ্গে সেই সময়কার অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন মডেল অভিনয় করেছিলেন। মেয়েটির বাবার চরিত্রে ছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। তার নাম সম্ভবত মুনা। মুনার শিশু বয়সের চরিত্রে অভিনয় করেছিল আজকের জনপ্রিয় অভিনেত্রী তারিন। তারিন আর ঈশিতা দুজনেই আমার নাটকে শিশু চরিত্রে অভিনয় করেছে। আফজালের মেয়ে হয়েছিল ঈশিতা আমার ‘দুজনে’ নাটকে। শান্তা ইসলাম নায়িকা। সেই শিশুরা এখন বিখ্যাত নায়িকা। ঈশিতা তো সন্তানের জননীও হয়ে গেছে। তারিনের মা, আজকের বিখ্যাত নায়িকা তিশার মা, ঈশিতার মা, আরেকজনের কথা মনে পড়ে নাদিয়ার মা, অপির মা, এই কন্যাদের মায়েরা মেয়েদের অভিনয় ক্ষেত্রে বড় জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য কী প্রাণান্তকর পরিশ্রম করেছেন, ওই সময়কার আমরা অনেকেই তা দেখেছি ও মনে রেখেছি।

‘কোন কাননের ফুল’ চলছে। বোধহয় দুটো পর্ব হয়ে গেছে। তখনকার পর্বগুলো ষাট পঁয়ষট্টি মিনিট, আবার কোনো কোনোটা সত্তর-পঁচাত্তর মিনিটও হয়ে যেত। একেকটি পর্ব এখনকার নাটকের চার পাঁচটি পর্বের সমান। তৃতীয় পর্ব লেখা চলছে। বিটিভিতে দুলালের রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছি। ফরীদি এসে হাজির। ‘আমি এই নাটকে অভিনয় করবো।’ তখনো ফরীদি কিংবদন্তি হয়ে ওঠেনি। তারপরও ফরীদি অভিনয় করতে চাইছে, দুলাল খুবই পুলকিত। আমি পড়ে গেলাম ফাঁপরে। গল্প যেভাবে ভেবেছি, সেখানে ফরীদির করার মতো কোনো চরিত্র নেই। ফরীদি বলল, ‘চরিত্র নাই তো কী হইছে? চরিত্র বানা?’ দুলালও বলল, ‘ফরীদির কথা মাথায় রাইখা চরিত্র বানাইয়া ফালা।’ দুজনের কেউ আমার মতামতের ধারই ধারলো না। তৃতীয় পর্বের শেষ দৃশ্যে হঠাৎই দেখা গেল ফরীদি এসে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছে। তার ওপরই ফ্রিজ হলো দৃশ্যটি। অর্থাৎ পরের পর্বে ফরীদি আসিতেছেন। শেষ পর্যন্ত গল্প বদলে ফরীদির চরিত্র ঢুকানো হলো। ‘কোন কাননের ফুল’ আলাদা মাত্রা পেয়ে গেল।

‘কাজল’ও ছিল তৌকীরের নাটক। সেই নাটকে নায়িকা চরিত্র করার কথা ছিল নৃত্যশিল্পী অভিনেত্রী ও মডেল মৌ-এর। একদিন রিহার্সেলে এসে কী এক রহস্যময় কারণে সে আর আসেনি। প্রডিউসার কামরুননেসা হাসান মানে আমাদের মেনকা আপা খুবই মাইন্ড করেছিলেন। জাহিদ হাসান তখন ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে। আমার ‘নীলু’ নাটকে বিপাশার সঙ্গে অভিনয় করল। ‘যায়াযায়দিন’ পত্রিকাটি তখন বছরের সেরা নাট্যকার ও অভিনেতা অভিনেত্রীকে পুরস্কার দিত। আমি আর জাহিদ হাসান সে বছর ‘নীলু’ নাটকের জন্য পুরস্কার পেয়ে গেলাম। নায়ক মাহফুজ আহমেদ এক সময় সাংবাদিকতা করত। তার খুব ইচ্ছা অভিনেতা হওয়ার। আমার গেন্ডারিয়ার ফ্ল্যাটে নিয়মিতই যেত আমার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য, আমাকে নিয়ে নিউজ করার জন্য। ‘কোন কাননের ফুল’-এ অতি ক্ষুদ্র একটি চরিত্রে মাত্র একটি দৃশ্যে মাহফুজ অভিনয় করেছিল। সেই শুরু হয়েছিল তার যাত্রা। পরে হুমায়ূন আহমেদের নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করে মাহফুজ বিখ্যাত হয়ে যায়।

তৌকীর আহমেদ পরে নাটক নির্মাণ করতে লাগলেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে লাগলেন। মঞ্চ নাটক রচনা ও নির্দেশনা দিতে লাগলেন। আমজাদ হোসেনের কাহিনি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেন, হুমায়ূন আহমেদের কাহিনি নিয়ে করলেন। কয়েক বছর আগে বরিশাল থেকে ফিরছি। দ্রুতগামী জলযানে দুপুরবেলা টিভিতে একটি সিনেমা দেখাতে লাগল। টাইটেল ইত্যাদি দেখা হয়নি। কিন্তু সিনেমাটি দেখতে দেখতে একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। অপূর্ব সিনেমা। ফজলুর রহমান বাবু, মোশাররফ করিম ও অন্যদের অসামান্য অভিনয়ের সঙ্গে পরিচালকের মেধা ও মনন, এই সময়কার বিদেশ প্রবাসী শ্রমিকদের কথা ভারি সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ছবিটি শেষ হতে হতে বুঝে গেলাম এই হচ্ছে তৌকীর আহমেদের ‘অজ্ঞাতনামা’। নিজের উচ্ছ্বাস প্রকাশের জন্য তৌকীরকে ফোন করলাম, পেলাম না। বিপাশাকে পেলাম, তাকেই জানালাম। ভেবে খুব গৌরববোধ করছিলাম যে, তৌকীরের অভিনয় জীবনের শুরুর দিকটায় তাঁর বিশিষ্ট হয়ে ওঠার সময়টিতে সহযোগী হিসেবে আমিও ছিলাম। আজকের বিখ্যাত নায়ক অপূর্বকে নিয়েও আমার অনুভূতি অনেকটাই ওরকম। আমার একটার পর একটা নাটকে শুরুর দিকে অভিনয় করেছে অপূর্ব। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্মাতা ছিল চয়নিকা চৌধুরী। জয়া আহসানের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। ‘আমাদের ছোট নদী’ সিরিজে সে ছিল জাহিদ হাসানের নায়িকা। আমার কয়েকটি এক পর্বের নাটকও সে করেছিল। জয়া এখন ভারত বাংলাদেশ মিলিয়ে জনপ্রিয়তম নায়িকা। জয়ার কথা ভেবে আমি খুব গৌরববোধ করি। তার শুরুর পর্বে আমিও ছিলাম। আমরা ছয় বন্ধু মিলে ‘সিক্সথ সেন্স’ নামে একটি নাটক তৈরির কোম্পানি খুলেছিলাম। আমার লেখা ‘ছবির মতো মেয়ে’ টেলিফিল্ম দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল। চট্টগ্রামের পর কক্সবাজারে গিয়েছি শুটিং করতে। পরিচালক ও নায়ক আফজাল হোসেন। ক্যামেরায় সালাহউদ্দিন লাভলু। নায়িকা মৌসুমির সঙ্গে চৈতি নামের একজন মডেল এবং জয়াও অভিনয় করেছিল। কক্সবাজারে গিয়ে আমি পড়েছিলাম বেদম জ্বরে আর জয়া আক্রান্ত হয়েছিল পেটের পীড়ায়।

বিটিভিতে আমার প্রথম নাটক ‘মায়াকানন’। ফজলুল করিমের নাট্যরূপ। প্রযোজক মোস্তাফিজুর রহমান। অভিনয়ে সুবর্ণা, আফজাল। দ্বিতীয় নাটক ‘সখা তুমি সখী তুমি’। নাট্যরূপ জিয়া আনসারী। প্রযোজক ফখরুল আবেদীন দুলাল। অভিনয়ে সুবর্ণা, ফরীদি। তারপর আমাকে সিরিজ নাটক লেখার জন্য ডাকলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি নিজেই নাটকটি প্রযোজনা করবেন। আফজালের সঙ্গে রাতের পর রাত বসে ‘নায়ক’ নামে একটা সিরিজ লিখতে শুরু করলাম। ’৮৫ সালের কথা। সেই সময় আবদুল্লাহ আল মামুনের স্ত্রীবিয়োগ হলো। দায়িত্ব দিলেন ফিরোজ মাহমুদকে। একপর্ব প্রচার হওয়ার পর অতি আধুনিকতার কারণে নাটকটি বন্ধ হয়ে গেল। তারপর অভিমান করে নাটক লেখা আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমার বন্ধু ফখরুল আবেদীন দুলাল অভিমান ভাঙিয়ে আমাকে আবার ডেকে নিল বিটিভিতে। একটার পর একটা নাটক লেখা শুরু করলাম। কত আনন্দের স্মৃতিঘেরা সেইসব দিন। দুলালের রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছি, কে একজন দরজা খুলে উঁকি দিয়ে গেল। প্রত্যেক প্রযোজকের রুমেই তখন এরকম দরজা ঠেলে কেউ কেউ উঁকি দিয়ে যেত।  দুলাল মজা করে বলত, ‘বিটিভিতে কে যেন কাকে খোঁজে?’ মামুন ভাইয়ের রুমে বসে আছি, ফরীদি ঢুকে মামুন ভাইকে বলল, ‘কী রে মামুন, কেমন আছিস?’ মামুন ভাই ঠান্ডা মাথায় ঠাট্টাটি গ্রহণ করে বিনীত কণ্ঠে বললেন, ‘ভালো আছি ফরীদি ভাই, বসেন।’ তারপর ফরীদির সেই ঠা ঠা হাসি। এ রকম কত সুখের দিন ছিল বিটিভি ঘিরে। আনন্দ মজা আর সৃষ্টিশীলতার সেই সুখের দিনগুলো কোথায় হারিয়ে গেছে!

♦ লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

 

সর্বশেষ খবর