গত বছরে অক্টোবরের শেষ দিকে চীনের উহানে যাওয়ার সুযোগ হয়। সেখানে বাংলাদেশের শিক্ষার্থী আবু হোরাইরা আমাকে নিয়ে যান উহানের হোয়াজং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের গবেষণা কার্যক্রম দেখাতে। হোয়াজং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই হর্টিকালচার বিভাগ গবেষণায় বিশ্ব র্যাংকিংয়ে যেমন এগিয়ে আছে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঝেও এর অবস্থান প্রথম সারিতে। আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে এলেন এই বিভাগের শিক্ষার্থী বাংলাদেশের সাইফুল ইসলাম। সাইফুল ইসলাম এখানে পিএইচডি করছেন আলুর রোগতত্ত্ব নিয়ে।
যে হারে পৃথিবীর জনসংখ্যা বাড়ছে, সেই হারে খাদ্যের উৎপাদন বাড়ানো না গেলে খাদ্যসংকট বা দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা কঠিন হয়ে যাবে। পৃথিবীর গবেষকরা খাদ্যসংকট মোকাবিলায় আলুকে বেছে নিয়েছেন। কারণ পৃথিবীর ১৫৯টি দেশে আলু চাষ হয়। এটি উপাদেয়, পুষ্টিকর এবং অধিক উৎপাদনশীল। যাতে রয়েছে ভিটামিনসহ সব ধরনের পুষ্টি উপাদান। আলুকে বলা হয় ‘কিং অব ভেজিটেবল’। পৃথিবীতেই আলুর রয়েছে নানাবিধ মুখরোচক ব্যবহার। ফলে খাদ্য হিসেবে বিশ্বব্যাপী এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা। আবার এর উৎপাদনশীলতাও বেশি। হেক্টরপ্রতি আলুর গড় ফলন ২০ টন; অন্যদিকে ধান ৩ টন আর
গম ৩.৩ টন। সুতরাং এ বিবেচনায় আলু অন্যান্য প্রধান ফসলের চেয়ে বেশ এগিয়ে। এ চিন্তা থেকেই চীন আলু উৎপাদনে নজর দিয়েছে। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত তিন বছরের ‘গ্রেট চায়না ফেমিন’-এর পর চীন আলু উৎপাদন বাড়াতে শুরু করে। এখন পৃথিবীর শতকরা ২২ ভাগ আলুই উৎপাদন হয় চীনে। প্রতিবছর প্রায় ৯ থেকে ১০ কোটি টন আলু উৎপাদন করে চীন বিশ্বের আলু উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে শীর্ষে অবস্থান করছে।হোয়াজং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আলু নিয়ে গবেষণা বিস্তর। আলুর রোগ নিয়ে যেমন গবেষণা চলছে, গবেষণা হচ্ছে নতুন জাত উন্নয়নের। গবেষণারত শিক্ষার্থী ঝং জিয়াং জানালেন চীনে আলুর জনপ্রিয়তা ও তাদের গবেষণা সম্পর্কে। তিনি বলেন, ‘চীনে আলু বেশ জনপ্রিয়। ১৯৬১ সালের দুর্ভিক্ষের পর চীন সরকার আলু চাষের ওপর গুরুত্ব দেয়। ফলে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আলু নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়। আপনি জেনে থাকবেন চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং কৃষককে আলু চাষে উদ্বুদ্ধ করছেন। চীনের উত্তরাঞ্চলের হেবেই প্রদেশের দারিদ্র্যপীড়িত একটি গ্রামের চিত্র পাল্টে গেছে আলু চাষের মাধ্যমে।’
আলু চাষের প্রধান সমস্যা এর নানারকম রোগ। ইতিহাস থেকে আমরা জানি, অন্য অনেক দেশের মতো আয়ারল্যান্ডের প্রধান খাবার আলু। ভাইরাসের আক্রমণে আলুর ফলন না হওয়ায় ১৮৪৫ থেকে ১৮৫২ সাল পর্যন্ত সেখানে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। যাতে মারা যায় প্রায় ১০ লাখ মানুষ। এ ঘটনা ইতিহাসে দ্য গ্রেট ফ্যামিন অব আয়ারল্যান্ড নামে পরিচিত। তাই আলুর উৎপাদন নিশ্চিত রাখতে আলুর নানান রোগ নিয়েও গবেষণা চলছে হোয়াজং বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে। সাইফুল ইসলামও সেখানকার একজন গবেষণা শিক্ষার্থী। তিনি কাজ করছেন আলুর ওয়াই ভাইরাস নিয়ে। তিনি বলেন, ‘ওয়াই ভাইরাসের কারণে আলুর কুঁড়ি ও ফুলের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। ভয়ানকভাবে কমে যায় আলুর ফলন। আমরা চেষ্টা করছি আলুকে কীভাবে এই ভাইরাস প্রতিরোধক হিসেবে তৈরি করা যায়। ফসলকে রোগজীবাণুর হাত থেকে বাঁচাতে পারলে উৎপাদনশীলতা বাড়ে। তাই এখানে পুরোদমে গবেষণা চলছে আলুকে কী করে বিভিন্ন রোগ-জীবাণু থেকে রক্ষা করা যায় তার উপায় খুঁজে বের করার।’
ল্যাবে কাজ করছিলেন অন্য শিক্ষার্থীরাও। কথা হয় তাদের দুয়েকজনের সঙ্গে। চেন রুহাও নামের এক শিক্ষার্থী গবেষক দেখালেন ওয়াই ভাইরাস কীভাবে পাতায় আক্রমণ করে। এরপর কথা হয় হোয়াজং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নি বিহুয়ার সঙ্গে। তিনি আলুর উৎপাদনশীলতা নিয়ে বহুদিন ধরেই কাজ করছেন। তিনি বললেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ সমৃদ্ধ একটি ল্যাবরেটরি রয়েছে এবং আমরা কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একীভূত হয়ে গবেষণার কাজ করছি। আমাদের গবেষণার মূল ফোকাস আলুর গুণমানকে প্রভাবিত করে এমন গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা। ঠান্ডা প্রতিরোধ এবং রোগ প্রতিরোধের মতো গুণাবলির জেনেটিক বিষয় নিয়ে কাজ করছি। একই সঙ্গে প্রচলিত রোগ এবং কীটপতঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রক্রিয়া, প্লান্ট-প্যাথোজেন মিথস্ক্রিয়া এবং পরিবেশগত কারণগুলো অনুসন্ধান করছি। আমাদের লক্ষ্য হলো একটি সমন্বিত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।’
আলু কন্দাল ফসল। এটি মাটির নিচে ফলে। যার কারণে জীবাণু খুব সহজেই আক্রমণ করতে পারে। মাটির নিচে কী ঘটছে সহসা চোখে পড়ে না। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত। জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বের কৃষি ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করছে নানাভাবে। আলু চাষেও এর প্রভাব আমরা আমাদের দেশে দেখছি। কোনো কোনো বছর বেশি শীত পড়ছে, আবার কোনো কোনো বছর গরম বাড়ছে। কিংবা শীত বা গরম কোনোটিই ঠিক সময়ে আসছে না। অধ্যাপক বিহুয়ার কাছে জানতে চাই, এই বিষয়টি মাথায় রেখে তাদের কোনো গবেষণা আছে কি না?
ড. নি বিহুয়া বললেন, ‘নিশ্চয়ই। আমরা দেখেছি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নতুন নতুন রোগ জীবাণুর দেখা মিলছে। আর জীবাণুরাও তাদের গঠন বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করছে। ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার স্বভাবও পাল্টে নিচ্ছে। আমরা এই বিষয়গুলো মাথায় রেখেছি। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় হুমকি খাদ্য নিরাপত্তায়। এ ক্ষেত্রে চীনে প্ল্যান বি হচ্ছে আলু। কারণ আলুর স্টার্চ বা আটা চাল বা গমের আটার চেয়ে বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায়। ১০ বছর পর্যন্ত আলুর আটা ভালো থাকে।’
পৃথিবীতে এখনো প্রতিরাতে ১০ শতাংশের বেশি মানুষ খিদে পেটে ঘুমোতে যায়। প্রায় ১৩.৫ কোটি মানুষ অনাহারে দিন কাটায়। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সম্প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, ভয়ানক এক দুর্ভিক্ষের দিকে ধাবিত হচ্ছে আমরা। খাদ্যের অভাবে প্রতিদিন প্রাণ হারাবে তিন লাখ নিরীহ মানুষ। করোনাভাইরাস সৃষ্ট সংকট ও যুদ্ধসংঘাতে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্থবির হয়ে যাওয়ায় খাদ্য নিরাপত্তা নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে প্ল্যান বি হিসেবে আলুকে রেখেছে চীন।
আলুর স্টার্চ হচ্ছে আলু থেকে তৈরি ময়দা বা আটা। ড. নি বিহুয়ার মতে, সাধারণ গম বা চালের আটা যেখানে তিন থেকে চার মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়, সেখানে আলুর স্টার্চ সংরক্ষণ করা যায় ১০ বছরের বেশি সময় ধরে। তাই খাদ্য নিরাপত্তার বলয় তৈরিতে তারা আলুকে প্রাধান্য দিচ্ছে। মনে আছে এই শতাব্দীর প্রথম দিকে জয়পুরহাটে আলুর স্টার্চ তৈরির একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। আমরা সে সময় তা আপনাদের সামনে তুলে ধরেছিলাম। অজ্ঞাত কারণে প্রকল্পটি আর সামনের দিকে এগোয়নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট নিরসনকল্পে মানুষের খাদ্য হিসেবে আলুর কদর বেড়ে যায়। গোলআলু ও মিষ্টি আলু দুটোই যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর খাদ্য সংকট মোকাবিলায় বিশেষ ভূমিকা রেখে আসছে। ক্ষুধাপীড়িত আফ্রিকায়ও শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে উৎপাদন করছে অরেঞ্জ ফ্লেশড সুইট পটেটো। অন্য যে কোনো শস্যের চেয়ে আলুর ফলন যেমন বেশি, মুনাফাও বেশি। বাংলাদেশেও ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে আলু। এর আবাদ বাড়ছে। বাড়ছে উৎপাদন। আলু বাংলাদেশের তৃতীয় প্রধান খাদ্যশস্য। বর্তমানে দেশে আলুর উৎপাদন প্রায় ১১০ লাখ টন। আবাদি এলাকা প্রায় ৪.৫৫ লাখ হেক্টর। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তায় আলু রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আগামীর কথা ভেবে আলু নিয়ে বিস্তর গবেষণার যেমন প্রয়োজন, প্রয়োজন আলুর বীজ উৎপাদনের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। আর এর জন্য সবার আগে প্রয়োজন টেকসই নীতিমালা। খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে আলু নিয়ে নতুন করে ভাবনার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
♦ লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব