গত ১৭ জানুয়ারি ছিল সর্বকালের মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের প্রয়াণ দিবস। প্রতি বছর এ দিবসটি এলেই আমার মনে পড়ে সেই বিচারিক আদেশটির কথা, যে রায় দিয়ে আমি জামায়াতিদের দখল থেকে পাবনা শহরে তাঁর বাড়িটি উদ্ধারের আদেশ দিতে পেরেছিলাম। হাই কোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি থাকাকালে অগণিত সংখ্যক মামলার রায় দিতে হয়েছে। সবগুলো মনে রাখা কখনো সম্ভব নয়। তবে কিছু সংখ্যক মামলার কথা কখনো ভোলার নয় সেগুলোর গুরুত্বের কারণে। এসবের মধ্যে রয়েছে মহানায়িকার বাড়ি দখলমুক্ত করার মামলাটিও, যে বাড়িটি অবৈধভাবে ধর্মান্ধ, ধর্ম ব্যবসায়ী জামায়াত নেতারা দখল করে রেখেছিলেন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ সিদ্ধান্তে। ২০১২ সালের কথা। গণস্বার্থসংক্রান্ত মামলায় সিদ্ধহস্ত অ্যাডভোকেট মনজিল মোর্শেদের আবেদনক্রমে মহামান্য হাই কোর্টের সেই সময়ের মাননীয় বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী (পরে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন) মহোদয়ের ২০১২ সালে দেওয়া তাঁর রায়ে পরিষ্কার ভাষায় আদেশ দিয়েছিলেন সুচিত্রা সেনের পৈতৃক বাড়ি থেকে জামায়াতি দখলদারদের উচ্ছেদ করার। হাই কোর্টের সে আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন জামায়াত নেতারা। ২০১৪ সালে আপিল বিভাগে আপিল শুনানিকালে তাদের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে হাজির হন জামায়াত নেতা ব্যারিস্টার রাজ্জাকের পুত্র ব্যারিস্টার ইমরান আবদুল্লাহ সিদ্দিক। ব্যারিস্টার রাজ্জাক তড়িঘড়ি করে যুক্তরাজ্যে চলে গিয়েছিলেন এই ভয়ে যে, যুদ্ধাপরাধী মামলায় তিনিও আসামি হতে পারেন। সে কারণেই সুচিত্রা সেনের বাড়ির মামলায় ব্যারিস্টার রাজ্জাক হাজির না হয়ে হাজির হয়েছিলেন উপরে উল্লিখিত তার ব্যারিস্টার পুত্র। ব্যারিস্টার ইমরান তার আর্জিতে উল্লেখ করেছিলেন, বিগত সরকারের মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীর (যিনি নিজেও জামায়াত নেতা এবং বিএনপি-জামায়াত সরকার আমলে পাবনা জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন এবং পরবর্তীতে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যার ফাঁসি হয়েছিল) উদ্যোগে সরকার সুচিত্রা সেনের পরিত্যক্ত বাড়িটি ইমাম গাজ্জালি ট্রাস্ট নামক জামায়াতে ইসলামের এক সংস্থার কাছে দীর্ঘমেয়াদে ইজারা (লিজ) প্রদান করে দিয়েছে বিধায় লিজের সময়কাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের উচ্ছেদ করা যাবে না। তারা সুচিত্রা সেনের পৈতৃক বাড়িটিকে জামায়াতি রাজনীতির শিক্ষালয় হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলেন।
আমিসহ তিন বিচারপতির আপিল বিভাগ শুনানির পর ২০১৪ সালের মে মাসে জামায়াতের আপিল এই বলে খারিজ করে আদেশ প্রদান করেন যে শুরুতেই জামায়াতিদের কাছে লিজ দেওয়াটা ছিল অবৈধ। এ মামলার রায় লেখার দায়িত্ব পেয়ে আমি যারপরনাই উৎফুল্ল হয়ে যথাসম্ভব অল্প সময়ের মধ্যে ৫৯ পৃষ্ঠার রায়টি লিখে সরকার এবং পাবনা জেলার ডিসিকে নির্দেশ দিয়েছিলাম বাড়িটি তাৎক্ষণিকভাবে জামায়াতিদের দখলমুক্ত করে সেখানে সুচিত্রার স্মৃতি রক্ষণের জন্য জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করতে। কালবিলম্ব না করে সেই সময়ের সংস্কৃতি বিষয়কমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর সাহেব আমার রায়ে লেখা নির্দেশক্রমে জামায়াতিদের উচ্ছেদ করে সেখানে সুচিত্রার স্মৃতি রক্ষার জন্য জাদুঘর স্থাপন করেন। দুর্ভাগ্যবশত সুচিত্রা সেন আমার লেখা রায়টি দেখে যেতে পারেননি, কারণ তার কয়েক মাস আগেই তিনি কোটি কোটি ভক্তকে অশ্রুসিক্ত করে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছিলেন।
![](/assets/archive/images/Print-Edition/2024/01.JANUARY/21-01-2024/Bd-Pratidin-21-01-24-F-24.jpg)
মহানায়িকার মহা প্রয়াণের কয়েকদিন পর ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনাম সুচিত্রা স্মরণে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন যাতে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সৈয়দ বদরুল হায়দারেরও ধারাবিবরণীতে ভূমিকা ছিল। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে মাহফুজ আনাম তাঁর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, তাঁর স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা জন্মানোর বহু আগেই তিনি একতরফাভাবে সুচিত্রার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। এটা যে শুধু মাহফুজ আনাম সাহেবের কথা তা নয়, সে সময়ে একতরফাভাবে সুচিত্রার প্রেমে আসক্ত হননি এমন পুরুষের সংখ্যা খুব কমই ছিল এবং তাঁদের অনেকেরই বয়স মাহফুজ আনাম সাহেবের মতো, সুচিত্রা থেকে অনেক কম ছিল।
ভারতের অবাঙালি এলাকার লোকেরা সুচিত্রাকে মধুবালার সঙ্গে তুলনা করে থাকেন তাঁর রূপের প্রশংসা করে। বলা হয়, ভারতের চলচ্চিত্র জগতে সবচেয়ে রূপবতী অভিনেত্রী ছিলেন পাঠান বংশীয় মধুবালা, আর বাংলায় তাঁরই সমতুল্য ছিলেন সুচিত্রা সেন। কিন্তু সুচিত্রা শুধু তাঁর রূপের কারণেই সবার মন কাড়েননি, বিরল অভিনয় প্রতিভা এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্বই তাঁকে শীর্ষে স্থান দিয়েছে। তাঁর অভিনয়ে এমন সব বিকল্পহীন বৈশিষ্ট্য ছিল, যা অন্য কেউ আয়ত্ত করতে পারেননি। সে অর্থে তিনি ছিলেন অনন্যা, তাঁর বিকল্প কেউ হতে পারেননি, হয়তো ভবিষ্যতেও কেউ পারবেন না। দুটি গান রেকর্ড করে তিনি গায়িকা হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছিলেন। মনে করা হয় সংগীত জগতে অবস্থান করলে তিনি সন্ধ্যা, গীতা দত্ত, লতা, সুমন কল্যাণপুরের মতো অনন্য সাধারণ গায়িকা না হতে পারলেও আশা ভোঁসলে, প্রতীমা, হৈমন্তী শুক্লা, আলপনা, চিত্রা সিনহা, সবিতা চৌধুরীদের কাছাকাছি পৌঁছতে পারতেন নিশ্চয়ই।
মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক মতবাদের ধারক। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীনও তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। ১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে যে সম্মেলন ডেকেছিলেন, সেখানে শ্রীমতী গান্ধী তাঁর পাশের চেয়ারেই বসিয়েছিলেন সুচিত্রা সেনকে। প্রয়াত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর থেকে শুনেছি ’৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কলকাতা সফরকালে সুচিত্রা বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তাঁর পদধূলি নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পৈতৃক ভূমি পাবনা ভ্রমণের ইচ্ছা থাকলেও এক পর্যায়ে তিনি লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান বলে সে ইচ্ছা কখনো পূরণ হয়নি। কেন তিনি অন্তর্ধানে চলে গিয়েছিলেন, সে রহস্য সম্ভবত কখনো উন্মোচিত হবে না। জনসম্মুখে না আসার প্রত্যয়ের কারণে তিনি ভারতের চিত্রজগতের সর্বোচ্চ সম্মান, দাদাভাই ফালকে পুরস্কারও গ্রহণ করেননি। অন্তর্ধানে যাওয়ার আগে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এবং সংবাদমাধ্যমের কয়েকজন উজ্জ্বল নক্ষত্র তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে কলকাতা গেলে মহানায়িকা সাদরে গ্রহণ করে তাঁদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করেছেন, তাঁর শৈশবে পাবনার স্মৃতির প্রসঙ্গ টেনেছেন। এমনই ব্যক্তির মধ্যে ছিলেন রাজনীতি সচেতন জনপ্রিয় চলচ্চিত্রশিল্পী আলমগীর এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা সামিয়া জামান। মহানায়িকার সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎকারের বিবরণ থেকে জানা গেছে, মানুষ হিসেবেও সুচিত্রা কত বড়মাপের ছিলেন। অনেকেই মহানায়িকার সাক্ষাৎ পাওয়াকে জীবনের বড় প্রাপ্তি বলে মনে করেন।
আমার লেখা আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ের কারণে মহানায়িকার বাড়ি ধর্মান্ধদের কাছ থেকে দখলমুক্ত হওয়া এবং সেখানে সুচিত্রা জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি।
লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি