শিরোনাম
শুক্রবার, ২৬ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

লবণাক্ত জমিতে রিলে পদ্ধতিতে গম চাষ

ড. মৃন্ময় গুহ নিয়োগী

লবণাক্ত জমিতে রিলে পদ্ধতিতে গম চাষ

বিস্তীর্ণ উপকূল অঞ্চলে শুধু বৃষ্টির মৌসুমে বছরে একটি মাত্র ফসল আমন ধান হয়। এই ধান কৃষকরা ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে কেটে থাকেন। এরপর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অপঘাতে শুষ্ক মৌসুমে জমিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে এবং সেই সঙ্গে সেচযোগ্য পানির দুষ্প্রাপ্যের কারণে উপকূলের ৪ লাখ ৩৯ হাজার হেক্টর জমিতে শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ছয়-সাত মাস কোনো ফসল ফলানো সম্ভব হয় না। অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রায় প্রতিটি সভাতে বলে যাচ্ছেন,  এক ইঞ্চি জমিও ফেলে রাখা যাবে না। এই বিস্তীর্ণ উপকূল অঞ্চলের লবণাক্ত পতিত জমিতে ফসল ফলানোর লক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়ান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল রিসার্চের সহায়তায় গত পাঁচ-সাত বছর ধরে গবেষণা করে যাচ্ছি।  যেহেতু গম এবং ডালজাতীয় ফসলে অল্প পানি সেচ দিয়েই ভালো ফসল উৎপাদন সম্ভব এবং গম ফসল প্রকৃতিগতভাবেই কিছুটা লবণাক্ততা-সহিষ্ণু, তাই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অপঘাত মোকাবিলায় উপকূলে রিলে পদ্ধতিতে গম ও মুগ ফসলের প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গবেষণা করছি। গম ফসল ঠান্ডা আবহাওয়া পছন্দ করে। ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচের তাপমাত্রায় গম গাছ ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে এবং ভালো মানের গমের শীষ বের হতে সহায়তা করে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এখন শীতকাল কমে গেছে। দক্ষিণাঞ্চলে শীতকাল আরও কম। তবে গম ফসল উৎপাদনে এ ধরনের ঠান্ডা আবহাওয়া এখনো বাংলাদেশের উপকূলে শুধু ডিসেম্বর মাসের শেষার্ধ্বে এবং জানুয়ারি মাসে পাওয়া যায়। সেজন্য বাংলাদেশের উপকূলে গম বোনার প্রকৃত সময় মধ্য নভেম্বর। মধ্য নভেম্বরে জমিতে গম বীজ বুনলে জানুয়ারি মাসের অনুকূল ঠান্ডা আবহাওয়ায় প্রচুর গমের ছড়া বের হতে সহায়ক হবে। কিন্তু উপকূলের জমিতে নভেম্বর মাসে আমন ধান থাকে, যা কৃষকরা ডিসেম্বর মাসে কেটে থাকেন। এ কারণে সঠিক সময়ে গম বীজ বোনার লক্ষ্যে জমিতে আমন ধান থাকা অবস্থায়ই মধ্য নভেম্বরেই গম বীজ ছিটানো হয়েছে। এটিই রিলে পদ্ধতিতে গম চাষ প্রযুক্তি। নভেম্বর মাসে জমিতে লবণাক্ততা কম থাকার কারণে গম বীজ ভালোভাবে গজাতে এবং বেড়ে উঠতে পারছে। এ ছাড়াও নভেম্বর মাসে জমিতে আর্দ্রতা থাকার কারণে গম ফসল প্রয়োজনীয় রস পাচ্ছে। আমার এই গবেষণায় মধ্য নভেম্বরে সঠিক সময়ে জমিতে গম বীজ বোনার কারণে এবং ওই সময়ে জমিতে লবণাক্ততা না থাকা বা কম থাকার কারণে এবং মধ্য নভেম্বরে জমিতে প্রয়োজনীয় রস বা আর্দ্রতা বিদ্যমান থাকা। মূলত এই তিন কারণেই উপকূলের লবণাক্ত পতিত জমিতে রিলে পদ্ধতিতে গম চাষে অসামান্য সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে। রিলে প্রযুক্তিতে জমি চাষের প্রয়োজন হয় না বিধায় উৎপাদন খরচও অনেক কম। এ ছাড়াও গম চাষাবাদে কম পানি সেচ দিতে হয়। আবার রিলে গম চাষাবাদে পানির প্রয়োজন আরও কম। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এখন প্রায় প্রতি বছরই আগাম বৃষ্টি হচ্ছে। প্রতি বছরই ডিসেম্বর বা জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারির প্রথমে কোনো না কোনো সময়ে বৃষ্টি হচ্ছে, যা গম চাষের জন্য ভালো। এ সময় বৃষ্টি হলে সেচের প্রয়োজন হয় না। এতে সেচ খরচও কমে যায়। তবে অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে রিলে গমের জমিতে যেন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার বিকল্প নেই। গম ফসল জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। উপকূলের এই সমস্ত পতিত জমিতে শুষ্ক মৌসুমে ফসল ফলাতে লবণাক্ততার পাশাপাশি সেচযোগ্য পানির অপ্রতুলতাও একটি সমস্যা। আমার একটি গবেষণায় দেখা গেছে, উপকূলের লবণাক্ত জমির ঠিক নিচেই যে পানির স্তর আছে, তা লবণাক্ত এবং সেচযোগ্য নয়। কিন্তু এই সমস্ত জমির ১১ শত থেকে ১২ শত ফুট গভীরের পানি লবণাক্তমুক্ত এবং সেচযোগ্য। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই পানির লবণাক্ততা ০.৫ ডিএস/মিটার এর কম, যা শুধু ফসল চাষাবাদেই নয়, খাওয়ারও যোগ্য। সাবমারসিবল পাম্পের সাহায্যে ১১ শত ফুট বা তারও নিচের পানি উত্তোলন করা সম্ভব। বোরিং এবং ফিটিংসহ সম্পূর্ণ পাম্পটি কিনতে এবং বসাতে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। এ ধরনের একটি পাম্প দিয়ে ২০-২৫ বিঘা জমিতে অনায়াসে রিলে প্রযুক্তিতে গমসহ অন্যান্য রবি ফসলের চাষাবাদ করা যাবে। এর থেকে নিরাপদ খাওয়ার পানিও পাওয়া যাবে। এ ছাড়া উপকূলের প্রায় সব জায়গাতেই প্রচুর খাল, পুকুর, ডোবা, জলাশয় আছে, সেগুলো সংস্কার করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলেই উপকূলের বিশাল জমি রিলে গম চাষের আওতায় আনা সম্ভব। এ ছাড়াও আমার আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১ একর বা ১০০ শতাংশ জমির ১০ ভাগ অর্থাৎ মাত্র ১০ শতাংশ জমিতে যদি ৬ ফুট ৬ ফুট ৬ ফুট অর্থাৎ দৈর্ঘ্যে ৬ ফুট, প্রস্থে ৬ ফুট এবং গভীরতায় ৬ ফুট করে জমির উঁচু স্থানে পুকুর খনন করা যায় এবং ওই পুকুরের পানি যাতে চুইয়ে নিচে চলে না যায়, সেজন্য পুকুরের তলদেশে মোটা পলিথিন বিছিয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যায়, তাহলে ওই বৃষ্টির পানিতে ছয় মাস মাছ চাষ সম্ভব এবং ওই পানি দিয়ে বাকি ৯০ শতাংশ জমিতে রিলে পদ্ধতিতে গম উৎপাদন সম্ভব।

রিলে পদ্ধতিতে ১ বিঘা জমিতে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা খরচ করে ৪০০ কেজি (১০ মণ) গম পাওয়া যাচ্ছে। যার মূল্য প্রতি কেজি ৫০ টাকা হিসাবে ২০ হাজার টাকা। উপকূলের পতিত জমিতে রিলে পদ্ধতিতে গম ফসল চাষাবাদ ছড়িয়ে দিতে পারলে ৪ লাখ ৩৯ হাজার হেক্টর (৩২ লাখ বিঘা) পতিত জমিতে ১৩ লাখ টন বা ৩ কোটি মণ গম পাওয়া যাবে।  উপকূলে গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে কৃষকের মাঠে কৃষকদের সঙ্গে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে গবেষণার কাজ করতে পারার কারণে এবং পাশাপাশি প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে কাজে লাগিয়ে উপকূলের কৃষকের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আমি বিশ্বাস করি ‘রিলে পদ্ধতিতে বিনা চাষে কম খরচে গম উৎপাদন’-এ অঞ্চলের জন্য একটি আশীর্বাদ।

লেখক : স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী, ডেপুটি প্রজেক্ট লিডার, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া

সর্বশেষ খবর