শনিবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

সেইসব গানের দিন

ইমদাদুল হক মিলন

সেইসব গানের দিন

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ঢাকায় এসেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে সেই তাঁর প্রথম আগমন। ’৭২ সালের শেষ অথবা ’৭৩ এর শুরু। বিটিভি তাঁকে নিয়ে একটি বড় আয়োজন করেছে। কয়েকদিন ধরে বিজ্ঞাপন প্রচার চলছে। আমরা অনেকেই হেমন্তের গান বিটিভিতে শোনার জন্য দিশাহারা হয়ে গেছি। ’৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে একটি অত্যন্ত হাস্যকর যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধের সময় ভারতীয় গান রেডিও-টেলিভিশনে বাজানো নিষেধ। ভারতীয় সিনেমা নিষেধ। তারপরও সংগীতপ্রেমী মানুষ গ্রামোফোনে কিংবা ‘আকাশবাণী কোলকাতা’ থেকে রেডিওতে প্রিয় শিল্পীদের গানগুলো শুনে থাকেন। সিনেমাগুলো দেখার কোনো উপায় নেই। দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ওইসব সমস্যা নেই। ভারত আমাদের প্রিয় বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিল। পুরো নয়টি মাস এই উদ্বাস্তুদের ভারত সরকার খাইয়ে-পরিয়ে চিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল। আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্পে ট্রেনিং নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা যৌথবাহিনী গড়ে পাকিস্তানিদের পরাজিত করেছিল। সুতরাং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান অবিস্মরণীয়। বাংলাদেশকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য সেই সময়কার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পৃথিবীর বড় বড় দেশগুলোতে দৌড়ে বেড়িয়েছেন। এই ইতিহাস আমরা বাঙালি জাতি মনে রেখেছি।

ছেলেবেলা থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আমার খুব প্রিয় শিল্পী। মাওয়ার ঠিক আগের গ্রাম মেদিনীমন্ডলে কেটেছে আমার ছেলেবেলা। বহু বহু বছর ধরে শিল্প-সাহিত্য সংগীতে বিক্রমপুর ছিল খুবই অগ্রসর একটি এলাকা। ছেলেবেলায় দেখেছি বিয়ের অনুষ্ঠানে এমনকি সচ্ছল গৃহস্থবাড়ির খতনার অনুষ্ঠানেও মাইক বাজানো হয়। অন্যান্য উৎসব অনুষ্ঠানেও তো হয়ই। প্রায় প্রতিটি বাজারেই মাইক ভাড়া দেওয়ার দোকান থাকত। সেইসব দোকান থেকে বিয়ের অনুষ্ঠানের দুই-তিন দিন আগে থেকেই মাইক ভাড়া করে আনা হতো। বড় একটা চোঙা বা হর্ন ঘরের চালায় অথবা গাছের ডালে বাঁধা হতো। তারের সংযোগ ঘরে। যে ঘরে রাখা হয়েছে গ্রামোফোন আর বেশ কয়েকটি রেকর্ডের বাক্স। একজন মাইকম্যান আছে। তার কাজ হচ্ছে একটার পর একটা রেকর্ড বাজিয়ে যাওয়া। বাড়ির লোকজন এই লোককে বেশ সমীহ করে। তার থাকা-খাওয়ার ভালো বন্দোবস্ত করে। বিদায়ের দিন মাইকের ভাড়ার সঙ্গে মাইকম্যানকেও কিছু ধরিয়ে দিতে হতো।

গ্রামে বিয়ে-শাদি নাটক-থিয়েটার ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ইত্যাদি উৎসবের কোনো কমতি ছিল না তখন। আশপাশের কোনো বাড়িতে বিয়ে বা খতনা হচ্ছে, মাইক বাজতে শুরু করেছে, আর আমরা ছোটরা সবাই উন্মাদের মতো সেই বাড়িতে ছুটে গেছি। আত্মীয়-অনাত্মীয় বুঝিনি।

কত কত শিল্পীর গান তখন রেকর্ডে। বেশির ভাগই আধুনিক বাংলা গান। কাননবালা, কে এল সায়গল, জগন্ময় মিত্র, শচীন দেববর্মণ, ধনঞ্জন ভট্টাচার্য, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, গীতা দত্ত, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেক পরে জেনেছি প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় বিক্রমপুরের মানুষ। আজীবন বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে গেছেন। মান্না দে, শ্যামল মিত্র, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় এ রকম কত শিল্পী! লতা মুঙ্গেশকরও অসামান্য সব বাংলা গান গাইতে শুরু করেছেন। যেমন- ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে’, ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’। আশা ভোঁশলে, আরতী মুখোপাধ্যায়, উৎপল সেন, নির্মলা মিশ্র এঁদের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো গান তুমুল জনপ্রিয় হয়ে যাচ্ছে। নির্মলা মিশ্রের ‘ও তোতা পাখি রে’ গানটি শুনে মাতৃহারা যে কোনো সন্তানের চোখে পানি আসবে। তরুণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘কাজল নদীর জলে’ তুমুল জনপ্রিয়। সুবীর সেনের ‘এত সুর আর গান’ সবার মুখে মুখে। হিন্দিভাষী তালাত মাহমুদ তাঁর অসামান্য কণ্ঠে বেশ কয়েকটি বাংলা গান গাইলেন। যেমন- ‘রূপের ওই প্রদীপ জ্বেলে কী হবে তোমার’। আব্বাসউদ্দিন আহমেদ কন্যা ফেরদৌসী রহমান তখন ছিলেন ফেরদৌসী বেগম। ‘রাজধানীর বুকে’ নামে একটি সিনেমার সংগীত পরিচালনা করলেন তিনি। সেই সিনেমাতে গান গাইতে এলেন তালাত মাহমুদ। ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো, চাঁদ বুঝি তা জানে’ তুমুল জনপ্রিয় হয়ে গেল। পান্নালাল ভট্টাচার্য নামে একজন গায়ক ছিলেন মূলত শ্যামা সংগীত গাইতেন। তাঁর ‘মা আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিলো’ এই গান কোন বাঙালির হৃদয় স্পর্শ না করেছে? এই শিল্পীর আরেকটি গান ‘আশার খেলা এই জীবনে অনেক ভাঙে গড়ে’ কিশোর কণ্ঠে এই গানটি ছেলেবেলায় আমি খুব গাইতাম। অমল মুখোপাধ্যায়ের নাম এখন অনেকেই ভুলে গেছেন। তাঁর খুব সুন্দর সুন্দর গান ছিল। যেমন- ‘এই পৃথিবীতে সারাটি জীবন’, চুপ চুপ লক্ষ্মীটি, শোনবে যদি গল্পটি’, ‘পদ্মদীঘির ধারে ধারে, ডাহুক ডাকা মাঠের পাড়ে,’ ‘উড়ে যা উড়ে যা আকাশে, কাঞ্চন পিঞ্জিরা দিলাম খুলে’ এই গানগুলো খুব আচ্ছন্ন করেছিল আমাকে। অমল মুখোপাধ্যায় পরে কিছু গানের সুর করেছিলেন। একটি গান অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা এখনো অনেক অনুষ্ঠানে সেই গানটি করেন। গানটি গেয়েছিলেন গীতা দত্ত। ‘এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়, একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু’। সুর এবং গীতা গত্তের কণ্ঠমাধুর্যে এই গান ব্যাপক জনপ্রিয় হলো। ‘হারানো সুর’ ছবিতে গীতা দত্ত গাইলেন, ‘তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার’, ‘পৃথিবী আমারে চায়’ সিনেমাতে তাঁর গান ‘নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে’ এখনো সেই সময়কার শ্রোতাদের মনে গুনগুনিয়ে ওঠে। গীতা দত্ত পরে বোম্বাইতে চলে যান। গুরু দত্তের সঙ্গে বিয়ে হয়। হিন্দি সিনেমার গানে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। কত শিল্পী তখনকার দিনে। মনে পড়ছে আল্পনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। কি সুরেলা, মিষ্টি কণ্ঠ ছিল তাঁর। বাপ্পী লাহিড়ীর পিতা অপরেশ লাহিড়ী একটু অন্য রকমের গান গাইতেন। জনপ্রিয় ছিলেন। জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, মৃণাল চক্রবর্তী এসব শিল্পীর নাম অনেকেই ভুলে গেছেন। পঞ্চাশ ষাটের দশকে বেশ নাম করেছিলেন এঁরা। ‘আকাশবাণী কোলকাতা’ থেকে নিয়মিত তাঁদের গান শোনা যেত। পাঁচমিশেলি গানের অনুষ্ঠান কিংবা অনুরোধের আসরে শ্রোতারা আরও নামি ও জনপ্রিয় শিল্পীর পাশাপাশি এসব শিল্পীর গান শোনার জন্যও চিঠি লিখতেন। পিন্টু ভট্টাচার্যও বেশ নাম করেছিলেন তখন। তাঁর গান ‘এক তাজমহল হৃদয়ে তোমার আমি হারিয়ে গেলাম’, ‘চলো না দীঘার সৈকত ছাড়িয়ে’ শ্রোতারা খুবই পছন্দ করত। শচীন দেববর্মণ পুত্র রাহুল দেববর্মণের একটি বাংলা গান শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরত ‘মনে পড়ে রুবী রায়’। এই গান কে না শুনেছে? কোন বাঙালি কিশোর যুবক গুনগুন করে না গেয়েছে? বহু বহু দিন পেরিয়ে গানটি এখনো জনপ্রিয়।

কয়েকটি গানের কথা হঠাৎ হঠাৎ মনে আসে। শিল্পীর নাম ভুলে গেছি। যেমন- ‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন, কে কার অলঙ্কার’। আরেকটি গান ‘বনের পাখি গায় ভুলো না, ভুলো না’। আরেকটি ‘ওপার হতে ভরা গাঙে ঢেউ লাগে হায় এপারে, আমি যারে স্বপন দেখি সে কি দেখে আমারে’। কোথায় হারিয়ে গেছে এইসব গান? শিল্পের জগৎটা এ রকমই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হতে থাকে নতুন নতুন শিল্প। আগের অনেক কিছুই চাপা পড়ে যায়। আবার অনেক কিছুই কাল অতিক্রম করে এগোতে থাকে। এই শিল্পকেই আমরা কালোত্তীর্ণ বলি। বহু কালোত্তীর্ণ আধুনিক বাংলা গান যুগের পর যুগ ধরে এখনো বাঙালির অন্তর দখল করে আছে। কিছু শিল্পী অমর হয়ে গেছেন। এ রকম একজন জগন্ময় মিত্র। তাঁর ‘তুমি আজ কতদূরে।’ রেকর্ডের দু’পিঠে একই গান। এই লম্বা গানটি কী যে জনপ্রিয় হয়েছিল! শচীন দেববর্মণ একেবারেই অন্যরকম কণ্ঠ, গায়কী ঢং নিয়ে সংগীতজগতে প্রবেশ করেছিলেন। বাংলা হিন্দি দুই ভাষাতেই তাঁর গান এখনো সমান জনপ্রিয়। সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে ভারতীয় হিন্দি সিনেমাকে তুঙ্গে তুলে দিয়েছেন তিনি। তাঁর পুত্র রাহুল দেববর্মণের অবদানও এক্ষেত্রে অনেকটা। শচীনকর্তার স্ত্রী মীরা দেববর্মণ অসাধারণ কিছু বাংলা গান লিখেছিলেন। সেসব গান জনপ্রিয়তায় আকাশ ছুঁয়েছিল। আমাদের পল্লীকবি খ্যাত জসীমউদ্দীনের লেখা বেশ কিছু গান শচীনকর্তা গেয়েছেন। যেমন- ‘বন্ধু রঙ্গিলা রঙ্গিলা রে’, ‘নিশীথে যাইয়ো ফুলবনে রে ভ্রমরা’। পরবর্তীকালে হিন্দি ও বাংলা গানে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যাওয়া কিশোর কুমার শচীনকর্তার সুরে বহু গান গেয়েছেন। সেসব গানের অনেকগুলোই সংগীত জগতের মাইলস্টোন। ‘লুকোচুরি’ সিনেমায় কিশোর কুমার অভিনয় করেছিলেন এবং এই সিনেমায় তাঁর গাওয়া ‘সিং নেই তবু নাম তার সিংহ’, একেবারেই পাগলাটে ধরনের গান ছিল। তবে জনপ্রিয়তায় তুঙ্গে উঠে গিয়েছিল গানটি। তারপর একটার পর একটা হিট বাংলা গান কিশোর কুমারের। হিন্দি গানে তিনি তো হয়ে উঠলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। মোহাম্মদ রফি, মুকেশ, তালাত মাহমুদ এসব মহিরুহকে ডিঙিয়ে আকাশে উঠে গেলেন কিশোর কুমার। নারীকণ্ঠে লতা মুঙ্গেশকর, পুরুষকণ্ঠে কিশোর কুমার। গত ষাট সত্তর বছরে এই দুই মহান শিল্পীর গান জনপ্রিয় থেকে জনপ্রিয়তর হয়ে চলেছে। বাংলা ও হিন্দি গানের আরেক কিংবদন্তি আশা ভোঁশলে, লতা মুঙ্গেশকরের ছোটবোন, রাহুল দেববর্মণের স্ত্রী। এই উপমহাদেশের সংগীত জগৎকে এসব শিল্পী আলোকিত করেছেন। পাকিস্তানের কয়েকজন শিল্পী সংগীতজগতের গৌরব। যেমন- নূরজাহান, মেহেদী হাসান। নাহিদ নিয়াজী নামের একজন পাকিস্তানি শিল্পী খুব সুন্দর একটি বাংলা গান গেয়েছিলেন ‘আকাশের ওই মিটিমিটি তারার সাথে কইবো কথা, নাইবা তুমি এলে’। খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল গানটি। ভারত ও পাকিস্তানের ওস্তাদদের কথা এখানে নাইবা বললাম। তাঁরা অনেকেই বিশাল সংগীত আকাশের একেকটি ধ্র“বতারা।

মান্না দে এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রায় একই সময়ে সংগীতের জগতে ঢুকেছিলেন। দুজনেই ধীরে ধীরে এগোতে লাগলেন তুমুল জনপ্রিয়তার দিকে। পাড়ার ক্লাবে কুস্তি লড়তেন মান্না দে। তাঁর কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে ছিলেন উচ্চাঙ্গ সংগীতের নামকরা শিল্পী। এই কাকাই কুস্তির জগৎ থেকে মান্না দেকে নিয়ে এলেন গানের জগতে। ধীরে ধীরে মান্না দে হয়ে উঠলেন বাংলা ও হিন্দি গানের এক মহাশিল্পী। কত কত জনপ্রিয় গান তাঁর।

‘তীর ভাঙা ঢেউ’ ‘আমি যে জলসা ঘরে’ ‘আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না’। শেষ দিকে এসে ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ আধুনিক বাংলা গানের জগতে অতুলনীয়। ভারতীয় ক্রিকেটের দাদা হিসেবে খ্যাত সৌরভ গাঙ্গুলী কলকাতায় ‘ভজহরি মান্না’ নামে বাংলা খাবারের চমৎকার একটি রেস্টুরেন্ট করেছেন। বেশ কয়েকটি এই নামের রেস্টুরেন্ট ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কলকাতার বিভিন্ন এলাকায়। বহু হিন্দি সিনেমায় গান গেয়েছেন মান্না দে। বাংলা সিনেমাতে তো গেয়েছেনই, ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলীর বিখ্যাত কয়েকটি ঠুমরি নিজের অসামান্য কণ্ঠে গাইলেন মান্না দে। এক্ষেত্রেও অতুলনীয় তিনি। যেমন- ‘লাগা চুনারি মে দাগ’। হেমন্ত ও মান্না দের একটু আগের শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। আধুনিক বাংলা গানে তিনি তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। ‘তাজমহল তাজমহল’ ‘মাটিতে জন্ম নিলাম’ এ রকম অজস্র স্মরণীয় গান। আশির দশকে সাতক্ষীরার পারুলিয়ায় আফজালদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেছিলাম আমি আর আমার বিখ্যাত ক্যামেরা শিল্পী বন্ধু পাভেল রহমান। আফজালের একটিই বোন, মনা খুব ছোট তখন। কথা প্রায় বলেই না, কিন্তু দুপুরের দিকে রোজই নিজেদের পুরনো দালানের একটি কামরায় ঢুকে গ্রামোফোনে যে কদিন আমরা ছিলাম সে কদিনই দেখেছি একটিই গান বাজায়। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘জল ভরো কাঞ্চনকন্যা জলে দিয়া মন’। সেই গান আমার স্মৃতিতে এমনভাবে গেঁথে আছে, এখনো মাঝে মাঝে গানটা শুনি, সেই দিনগুলোতে ফিরে যাই। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘একটা গান লিখো আমার জন্য’ ‘মনে আগুন জ্বলে, চোখে কেন জ্বলে না’ ‘আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি’ আর আমাদের স্কুল পাঠ্যবইয়ের পাতায় পড়া যতীন্দ্রমোহন বাগচীর সেই বিখ্যাত কবিতা ‘কাজলা দিদি’ ‘বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ’ এমন বিষন্ন   কণ্ঠে গাইলেন প্রতিমা, শুনলে বুক হু হু করে ওঠে। বিমল কর আমার একজন খুব প্রিয় লেখক। তাঁর মেয়ে অনুভা কর ছিল আমার বন্ধু। ক্যান্সারে মারা গেছে।

ক্যান্সার নিয়েই বিমল কর উপন্যাস লিখেছিলেন ‘খড়কুটো’, ‘ছুটি’ নামে সিনেমা হয়েছিল। সেই সিনেমায় খুবই বিষণœ কণ্ঠে গান গেয়েছিলেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা আমি যে পথ চিনি না’। এই গান আমি কোনো দিন ভুলতে পারব না।  যে নারী কণ্ঠটি সেই ছেলেবেলা থেকে আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তাঁর নাম সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। কত কত গান এই মহীয়সী শিল্পীর ‘মধুমালতি ডাকে আয়’ ছিল সবচাইতে জনপ্রিয়। ‘চোখের জলে যদি হয় ছোট্ট নদী’। তারা শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘মধুর মধুর বংশি বাজে’ সন্ধ্যার কণ্ঠে স্মরণীয় হয়ে আছে। তারা শঙ্করের ‘সপ্তপদী’ সিনেমা হয়েছিল। উত্তম-সুচিত্রা অভিনয় করলেন। এই সিনেমার গান ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’, হেমন্তের সঙ্গে ডুয়েট তুমুল জনপ্রিয় হলো। তখনকার বাংলা চলচ্চিত্রে যেমন উত্তম-সুচিত্রা, সংগীতজগতে তখন হেমন্ত-সন্ধ্যা। আরেক জনপ্রিয় শিল্পী তখন শ্যামল মিত্র।  ‘ভ্রমরা ফুলের বনে’ ‘চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে’ ‘নাম রেখেছি বনলতা’ লোকের মুখে মুখে ফিরত। মাউথ অর্গানে রোমান্টিক যুবকরা খুব বাজাত এই গান।

[এই পর্ব শেষ হবে আগামী সংখ্যায়]

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

সর্বশেষ খবর