শনিবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

পা অচল, মনের জোরে হেঁটে চলেছেন কৃষি সাফল্যের পথ

শাইখ সিরাজ

পা অচল, মনের জোরে হেঁটে চলেছেন কৃষি সাফল্যের পথ

মাগুরা সদর উপজেলার নালিয়ারডাঙা গ্রাম। আক্ষরিক অর্থে চিরায়ত গ্রামবাংলার যে রূপ আমরা দেখে এসেছি, এখানে তাই ধরা দিয়েছে দৃশ্যের ভিতর। মাঠের পর মাঠ হলুদ শরষেখেত। দূরে দু-একটি বাড়িঘর। আঁকাবাঁকা নদীর মতো চলে গেছে মেটোপথ। সেই পথ ধরে ব্যস্ত পথিকের সাইকেল, দু-একটি গরুরগাড়ি হেলে-দুলে চলে যাচ্ছে। এরই মাঝে একটি ইলেকট্রিক ট্রাইসাইকেলে করে এগিয়ে এলেন এক যুবক। ট্রাই সাইকেলে ঝোলানো ছিল দুটি ক্রেচ। আমার সামনে এসে থামলো সে। ক্রেচ ভর দিয়ে নেমে এগিয়ে এলো আমার কাছে। যুবকের নাম আক্কাছ খান। আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।  বললেন, ‘স্যার আপনি আমার এখানে এসেছেন, এ আমার পরম পাওয়া। আমি দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায় আছি, কখন আপনার দেখা পাব।’

আক্কাছ একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ। সাত বছর বয়সে পোলিও রোগে পঙ্গুত্ববরণ করেন। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে মনে ঠাঁই দেননি আক্কাছ। মনের প্রত্যয় বরং আরও বেশি তাকে সামনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাই পা ছাড়াই তিনি হেঁটে চলেছেন মাঠের পর মাঠ। ফসলি খেত। কৃষিকে আঁকড়ে ধরে তৈরি করে নিয়েছেন নিজের সাফল্যের পথ।

তাকে নিয়ে হেঁটে যাই ফসলি জমির আল ধরে। ক্রাচে ভর দিয়েই জমির বুক থেকে ফলিয়ে নিয়েছেন সোনার ফসল। কৃষক আক্কাছ কখনো এক ফসল উৎপাদনে থেমে থাকেননি। বরং বৈচিত্র্যময় ফল-ফসলেই যত আগ্রহ তার। তিনি চাষ করছেন সুপার ফুড চিয়া সিডসহ নানান ফল-ফসল। আমরা গিয়ে দাঁড়াই তার চিয়া সিডের খেতের পাশে। সবে গাছগুলোতে ফুল আসতে শুরু করেছে। সবুজ গাছগুলোতে মৃদু বাতাস দোল দিয়ে যাচ্ছে, যেন আক্কাছের সাফল্যের বারতা ছড়িয়ে দিচ্ছে আরেক গাছে। এই সময়ে সিয়া সিড দারুণ অর্থকরী এক ফসল। বর্তমানে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের কাছে চিয়া সিডের কদর বেড়েছে। বিশেষ করে করোনার পর অনেকেই স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে উঠেছেন। তাদের কাছে চিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপকরণ। চিয়া হচ্ছে সালভিয়া হিসপানিকা নামক মিন্ট প্রজাতির উদ্ভিদের বীজ। এটি মূলত মধ্য আমেরিকা ও মেক্সিকোর মরুভূমি অঞ্চলে বেশি জন্মায়। বিশেষজ্ঞদের দাবি, প্রাচীন অ্যাজটেক জাতির খাদ্য তালিকায় এটি অন্তর্ভুক্ত ছিল। দেখতে অনেকটা তোকমা দানার মতো। সাদা ও কালো রঙের এবং তিলের মতো ছোট আকারের। সাধারণত বীজ জাতীয় যে কোনো খাবারই স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। পুষ্টিবিদদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এতে আছে প্রচুর ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডসহ নানাবিধ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন, ক্যালসিয়াম এবং দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয় খাদ্যআঁশ। এটি স্বাস্থ্যের জন্য যেমন উপকারী, ফসল হিসেবেও বেশ অর্থকরী। এ বছর আক্কাছ ৪০ শতক জমিতে চিয়া সিড চাষ করছেন। রোপণ থেকে ফসল তোলা পর্যন্ত তিন মাসে খরচ হয়েছে সাকল্যে ৭ হাজার টাকা। এই পরিমাণ জমি থেকে ছয়-সাত মণ চিয়া সিড উৎপাদন হয়। কেজিপ্রতি বিক্রি করেন ১ হাজার টাকা করে। পাশেই তার মাসকলাইয়ের খেত, পিঁয়াজ, সরিষা থেকে শুরু করে নানান মৌসুমি সবজি চাষ করছেন।

মাঠেই কথা হয় আক্কাছের বাবা আওয়াল খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, পঙ্গু ছেলে পরিবার ও সমাজের বোঝা হয়ে যাবে ভেবে বড় দুশ্চিন্তায় ছিলেন। কিন্তু ছেলে বোঝা হয়ে থাকেনি। বরং অচল পা নিয়েই সে পরিবারের বোঝা কাঁধে নিয়েছে। শুধু পরিবার নয়, সমাজেরও দায়িত্ব নিয়েছেন আক্কাছ খান। মাঠের পাশেই কৃষকদের বসার জন্য তৈরি করেছেন ছাউনি। বসিয়েছেন টিউবওয়েল। মাঠে কাজ করতে করতে ক্লান্ত কৃষক যেন দু-দন্ড বিশ্রাম নিতে পারেন। সেই ছাউনির নিচে বসে কথা হলো এলাকার অনেকের সঙ্গে। বয়োজ্যেষ্ঠ কয়েকজন কৃষক বললেন, আক্কাছ শুধু তার পরিবারের নয়, পুরো এলাকার গর্ব। তার সাফল্যে উজ্জ্বল হয়েছে গ্রামের নাম।

আক্কাছ বলেন, প্রতিবন্ধী হয়ে তিনি কোনো কাজকে ছোট মনে করেন না। নিজের মনোবল ঠিক রেখে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তার কাজ দেখে এলাকার মানুষ উৎসাহ দেয়। তাদের ভালোবাসা নিয়েই তার বেঁচে থাকাটা সুন্দর হয়ে উঠেছে। তিনি আইপিএমের সেরা কৃষক, মসলা চাষে সেরা কৃষক ও মাগুরার মডেল কৃষকের পুরস্কার অর্জন করেছেন কৃষি বিভাগ থেকে। কৃষি সাফল্যের অনন্য উদাহরণ সৃষ্টিকারী এ উদ্যোক্তা অন্য কৃষকের কথাও ভাবেন। ভাবেন কৃষকের প্রশান্তির কথাও। তিনি স্বপ্ন দেখেন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষকে নিয়ে কিছু করার।

সময় পাল্টেছে। পাল্টেছে দেশের কৃষি ও কৃষক। এ পরিবর্তনে দেশের প্রতিটি মানুষের ভূমিকা রয়েছে। এ সময়ে কৃষিতে আমরা অনেকদূর এগিয়েছি। যেতে হবে আরও বহুদূর। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে কৃষি ব্যবস্থা। বীজতলা থেকে উৎপাদন পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে রয়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার। যে লাঙল-জোয়াল আর হালের বলদ ছিল কৃষকের চাষাবাদের প্রধান উপকরণ, সে জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে আধুনিক লাঙল ট্রাক্টর, পাওয়ার ট্রিলার, কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার, ব্রডকাস্ট সিডার পাওয়ার রিপার মেশিন। এমনকি ফসল ফলানোর জন্য জমি চাষ, বীজ বপন, নিড়ানি, সার দেওয়া, কাটা, মাড়াই, ফসল ঝাড়া ও প্যাকেটিং সব কিছুই করা হচ্ছে প্রযুক্তির ছোঁয়ায়। ফলে কৃষিতে উৎপাদন বাড়ছে, কমছে উৎপাদন ব্যয়। প্রযুক্তির ব্যবহারে ফসলের অপচয়ও কম হচ্ছে। ফলে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকের। আক্কাছও আশ্রয় নিয়েছেন যান্ত্রিক কৃষির। তার বাড়িতে চোখে পড়ল নানারকম কৃষিযন্ত্রের। আক্কাছ বলেন, যন্ত্রই তাকে সাহায্য করেছে এগিয়ে যেতে। তিনি মনে করেন, তরুণদের কৃষিতে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। কারণ তরুণরা সহজেই যন্ত্র ব্যবহার করতে পারবে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েও আক্কাছ কৃষিতে যে সাফল্যের নজির গড়েছেন তা সবার জন্যই অনুপ্রেরণার।  বিশেষ করে আজকের তরুণ-তরুণী উপলব্ধিতে নিতে পারেন কৃষির অনন্য শক্তির। চাকরির পেছনে ছুটে সময় অপচয় না করে সে সময়টুকু কৃষিতে বিনিয়োগ হতে পারে সাফল্যের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রথম ধাপ।  এটি মাথায় রেখে কৃষিতে তরুণদের প্রশিক্ষণ ও অংশগ্রহণের ক্ষেত্রটি তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের কৃষিতে তৈরি হবে নতুন সম্ভাবনা।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর