শনিবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

মেট্রোরেলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা

তপন কুমার ঘোষ

মেট্রোরেলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা

মেট্রোরেল নিয়ে ঢাকাবাসীর কৌতূহল আর উচ্ছ্বাসের যেন শেষ নেই। মনের আনন্দে মেট্রোরেলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেকেই। ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশ উদ্বোধন করা হয়।  গত বছরের ৪ নভেম্বর উদ্বোধন করা হয় আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশ। বিদায়ী বছরের শেষ দিন উত্তরা হতে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের ১৬টি স্টেশনের সব সীমিত সময়ের জন্য খুলে দেওয়া হয়। সকাল থেকে রাত অবধি পুরোদমে মেট্রোরেলের চলাচল শুরু হয়েছে ২০ জানুয়ারি। উত্তরার দিয়াবাড়ীতে মেট্রোরেলের ডিপো। উত্তরা থেকে দিনের প্রথম ট্রেন ছেড়ে আসে সকাল ৭টা ১০ মিনিটে। মতিঝিল থেকে শেষ ট্রেন ছেড়ে যায় রাত ৮টা ৪০ মিনিটে। মেট্রোরেলের ১৬টি স্টেশন হচ্ছে- উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ সচিবালয় ও মতিঝিল। শুক্রবার ব্যতীত সপ্তাহের বাকি ছয় দিন সাড়ে ১৩ ঘণ্টার নতুন সূচিতে চলছে মেট্রোরেল। পিক আওয়ার অর্থাৎ ব্যস্ততম সময়ে সকাল ৭টা ১০ থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত দুটি ট্রেন চলাচলের মধ্যে সময়ের পার্থক্য বা হেডওয়ে থাকছে ১০ মিনিট। আর অফ পিক আওয়ারে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ১২ মিনিট পরপর ট্রেন চলছে। মেট্রোরেলের যাত্রীসেবা ইতোমধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সুহৃদ আমিনুল ইসলাম খান থাকেন পরীবাগে। ইতোমধ্যে মেট্রোরেলে বেশ কয়েকবার ভ্রমণ করেছেন। প্রতিদিন রমনা পার্কে আসেন প্রাতঃভ্রমণে। তিনি জানালেন, টিকিট কাউন্টার থেকে নির্দিষ্ট গন্তব্যের ভাড়া দিয়ে কার্ড সংগ্রহ করতে হবে। এই কার্ড অনেকটা স্মার্ট কার্ডের মতো দেখতে। চাইলে আপনি নিজেও টিকিট কেনার মেশিন থেকে টিকিট কিনতে পারবেন। এ ছাড়াও আছে স্থায়ী কার্ড বা এমআরটি পাস- ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট পাস। এটি রিচার্জ করা যায়। তিনি আরও জানালেন, প্ল্যাটফরমে প্রবেশের আগে নির্দিষ্ট স্থানে কার্ড টাচ করতে হবে। তবেই স্বয়ংক্রিয় গেট খুলবে। আবার গন্তব্যে পৌঁছানোর পর প্রস্থানের সময় ওই কার্ড মেশিনের নির্দিষ্ট সøটে পুশ করলে কার্ড ভিতরে ঢুকে যাবে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে গেট খুলে যাবে। এমআরটি পাস নির্দিষ্ট স্থানে টাচ করলেই হবে। এমআরটি পাসে নির্ধারিত ভাড়ার ওপর ১০ শতাংশ হারে ছাড় পাওয়া যাবে। এ ছাড়া প্রতিবার লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেনার ঝামেলাও এড়ানো যাবে। এতে সময় বাঁচবে, খরচেরও সাশ্রয় হবে, জানালেন তিনি।

১৪ জানুয়ারি। সকাল ৯টা। রাজধানীর কারওয়ানবাজার স্টেশনে প্রবেশের পর কিছুটা উত্তেজনা অনুভব করি। কিছুটা উচ্ছ্বসিতও। সব কিছু গোছানো। ঝকঝকে-তকতকে। ডিজিটাল স্ক্রিনে ভেসে উঠছে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা। আছে নিরাপত্তাকর্মীদের কড়া নজরদারি। আমার গন্তব্য মতিঝিল। কাউন্টার থেকে টিকিট কিনে প্ল্যাটফরমে প্রবেশ করলাম। মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়া ৩০ টাকা। প্রসঙ্গত, মেট্রোরেলে সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা; সর্বোচ্চ ১০০ টাকা। কোনো শ্রেণি বিভাজন নেই।  কয়েক মিনিটের মধ্যেই ট্রেন এসে প্ল্যাটফরমে দাঁড়ালো। মোট ছয়টি বগি। পিক আওয়ারে যাত্রীদের ভিড়ে ঠাসা প্রতিটি বগি। আমার হাতে অনেক সময়। পরিবেশ-পরিস্থিতি না বুঝে হুট করে ট্রেনে ওঠা ঠিক হবে না ভেবে পরবর্তী ট্রেনের অপেক্ষায় রইলাম। পরের ট্রেন কত মিনিট পর পৌঁছাবে, ডিজিটাল স্ক্রিনে তা দেখানো হচ্ছে। যথাসময়ে এলো ট্রেন। নামার চেয়ে ওঠার যাত্রী বেশি। এবার কিছুতেই মিস করা যাবে না। ভিতরে ঢুকে ঠেলাঠেলি করে কোনো রকমে একটু জায়গা করে নিলাম। স্টেশন ছাড়ার পরপরই পরবর্তী স্টেশনের নাম ঘোষণা করা হলো। শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ সচিবালয় স্টেশনে যাত্রীদের উঠানামার জন্য ১৫-২০ সেকেন্ড করে থেমে মিনিট দশেকের মধ্যে ট্রেন পৌঁছে গেল মতিঝিল। তাজ্জব ব্যাপার।

কারওয়ানবাজার থেকে মতিঝিল ব্যক্তিগত গাড়িতেও অনেক সময় ঘণ্টা পার হয়ে যায়।

নিউ ইস্কাটন রোডের দোকান কর্মচারী মো. হারেছ সরকার। এ পর্যন্ত চারবার মেট্রোরেলে ভ্রমণ করেছেন। তাঁর স্ত্রী উত্তরার দিয়াবাড়ীর কাছে বাসাভাড়া নিয়ে থাকেন। গার্মেন্টে চাকরি করেন। হারেছ জানালেন, মেট্রোতে ভিড় বেশি। ভাড়াও বেশি। কারওয়ানবাজার থেকে দিয়াবাড়ী ভাড়া ৮০ টাকা। অথচ বাসভাড়া মাত্র ৫০ টাকা। তবে এসব সত্ত্বেও অখুশি নন তিনি। তাঁর কথায়, ‘মেট্রোরেলে ভাড়া বেশি হলেও সময় অনেক বাঁচে। ‘হারেছ জানালেন, মেট্রোরেলে কারওয়ানবাজার থেকে উত্তরা পৌঁছাতে সময় লাগে আধ ঘণ্টারও কম। অথচ বাসে প্রায় দুই ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। বিরক্তির শেষ নেই।

স্টেশনে ওঠানামার জন্য সিঁড়ি, চলন্ত সিঁড়ি এবং লিফট আছে। সক্ষম বা ফিট ব্যক্তিরা সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করবেন। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে যাদের সমস্যা, তারা চলন্ত সিঁড়ি ব্যবহার করবেন। প্রতিবন্ধী ও বৃদ্ধদের জন্য লিফট। কিন্তু এই শৃঙ্খলা অনেকেই মানেন না বলে অভিযোগ আছে। পাছে নামতে সমস্যা হয়, এই ভয়ে বগির দরজার মুখে দাঁড়িয়ে থাকেন অনেকে। ভিতরে ফাঁকা জায়গা থাকা সত্ত্বেও দরজার মুখে জটলার কারণে অনেক যাত্রী ট্রেনে উঠতে পারেন না। রাজধানী ঢাকাকে যানজট থেকে মুক্তি দিতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে মেট্রোরেল একটি সফল উদ্যোগ।  নগর জীবনে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে মেট্রোরেল সেবা। বিদেশে মেট্রোরেল বা সাবওয়েতে চড়ার অভিজ্ঞতা আমার থাকলেও দেশের মাটিতে এই প্রথম। আমার সরল উপলব্ধি, ছোট হয়ে এসেছে আমার প্রিয় শহর ঢাকা।

লেখক : সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড

সর্বশেষ খবর