সোমবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

ভারতের রাজনীতিতে নতুন সংকট

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

ভারতের রাজনীতিতে নতুন সংকট

চলতি বছরে আর কয়েক মাসের মধ্যেই ভারতের লোকসভা নির্বাচন। এ নির্বাচনে বিজেপি-আরএসএসকে হারানোর জন্য সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং ২৮টি আঞ্চলিক দল নিয়ে গঠন করা হয়েছিল ‘ইন্ডিয়া’ জোট। অর্থাৎ ইন্ডিয়া বনাম বিজেপি-আরএসএস। মাঝপথেই আমেরিকার দেওয়া নাম ফায়ারব্র্যান্ড লেডি অর্থাৎ অগ্নিকন্যা বা বঙ্গেশ্বরী এমন জট পাকিয়ে দিলেন যে, এই জোট স্থায়ী হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। জোট যে দানা বাঁধবে না, দেশের রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা তা আগেই অনুমান করেছিলেন। জোট যদি হতো তাহলে বিজেপির বিরুদ্ধে সব দলের অভিন্ন প্রার্থী দিয়ে বিজেপিকে হারানো যেত।

এ মাসের ২২ তারিখে বাবরি মসজিদ ভেঙে অযোধ্যার রামমন্দির তৈরি হয়েছে। সুতরাং বিজেপির কাছে রামই একমাত্র ইস্যু। ভারতে আর কোনো ইস্যু নেই। মমতা যখন অগ্নিকন্যা সেজে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিজেপির হাত ধরেছিলেন, তখনই অনেকের সন্দেহ হয়েছিল। মমতা খুব লোভী, মিথ্যাবাদী একজন মহিলা। তখন কলকাতার আমেরিকান দূতাবাসের প্রধান ন্যান্সি পাওয়েল কংগ্রেসের নেতাদের ডেকে ডেকে বলতেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে আর কমিউনিস্টদের কোনো প্রয়োজন নেই। মমতা ফায়ারব্র্যান্ড লেডি এবং আমরা তাকেই ক্ষমতায় বসাব। বসিয়েও ছিল। এসব তো ইতিহাস। সাম্প্রতিককালে মমতা ব্যানার্জি কী করছেন, তা একবার দেখা যাক।

গত বছর ডিসেম্বর মাসে দিল্লিতে ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে হঠাৎ তিনি প্রস্তাব দেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে এই জোটের আহ্বায়ক। খাড়গে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি আহ্বায়ক হতে চাই না। আসুন আমরা সবাই মিলে বিজেপি-আরএসএসকে দেশছাড়া করি। খাড়গের কথায় কর্ণপাত না করে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল মমতার কথায় সায় দিলেন। আগের দিন রাতে কেজরিওয়ালকে দিল্লির বঙ্গভবনে ডেকে মমতা তার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেন। তারপর তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কয়েকজন সংসদ সদস্যকে নিয়ে দেখা করেন। সরকারিভাবে বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গের দাবিদাওয়া নিয়ে তারা কথা বলেছেন। সংসদ সদস্যদের বাদ দিয়ে মোদি মমতাকে নিয়ে যান সংসদ ভবনে তার নতুন ঘর দেখাতে। সেখানে তাদের মধ্যে একান্তে ৫ মিনিট কথা হয়। আরএসএস প্রধান তখন কলকাতায়।

গোড়ার দিকে মমতা নিজেই প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে তিনি বুঝতে পারেন, প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থিতা কেউ মেনে নেবে না। এটাই ছিল বিজেপি-আরএসএস মমতার এক ঐতিহাসিক চাল। মমতা কোনো দিন বিজেপি-আরএসএসের হাত থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন না। তিনি বেরিয়ে আসতে চানও না। কারণ মমতার দায়বদ্ধতা পেন্টাগন এবং নাগপুরের সঙ্গে একই সূত্রে গাঁথা। মমতা মুখে যতই বিজেপির বিরোধিতার কথা বলুন, তিনি কখনো নরেন্দ্র মোদি বা মোহন ভাগবতের সমালোচনা করেন না। মমতার আকাশছোঁয়া দুর্নীতি ভারতে কেন, পৃথিবীর কোনো দেশে আগে কখনো দেখা যায়নি।

তার যে সীমাহীন দুর্নীতি, এর কয়েকটি নমুনা তুলে ধরছি। তালিকাটি খুব দীর্ঘ। শিক্ষা, কয়লা, গরু, বালি, রেশনসহ একাধিক কান্ডে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। তদন্তকারী অফিসার এবং কলকাতা হাই কোর্টের একাধিক বিচারপতির ধারণা, মমতার দুর্নীতির পরিমাণ ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকার। মোদির আশা, এই দুর্নীতির তদন্ত প্রকাশ্যে চলতে থাকলেও মমতার সাহায্য ছাড়া তার তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন সফল হবে না। মোদির ১০ বছরের ক্ষমতা শেষ হতে চলেছে। তাই মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য আরএসএস এবং মোদি নিজে স্লোগান শুরু করেছেন-রামমন্দির এবং হিন্দুত্ব। হিন্দিতে বলা হচ্ছে, তিসরি বার মোদি সরকার। এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য কংগ্রেস থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। একাধিকবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও পাঁচবারের বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারকে ইন্ডিয়া জোটের আহ্বায়ক করা হোক। তৃণমূল ক্যাডাররা তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়ে উঠেছে নীতিশ কুমারকে আমরা মেনে নেব না। বাকি ২৩টি দল মেনে নিয়েছে।

কংগ্রেসসহ ইন্ডিয়া জোটের অন্য শরিকরা মনে করেন, মমতাই বিজেপিকে ক্ষমতায় রাখার জন্য ওয়াশিংটন এবং নাগপুরের নির্দেশে চলছেন। ভারতের সাধারণ মানুষ যে দুবেলা খেতে পায় না, আধপেটা খেয়ে থাকে, তার সঠিক তথ্য দিয়ে সম্প্রতি জাতিসংঘ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতে ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ স্বাস্থ্যকর খাবার পায় না। ২০২১ সালের কয়েকটি জরিপ উল্লেখ করে তারা বলেছে, এই জরিপ সত্যি হলে ভারত সরকারের খাদ্য সহায়তার যে দাবি করা হয়, তা সঠিক বলে মনে হয় না। ভারত বলেছে, সেই দেশে ৮১৩ মিলিয়ন লোকের খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন। জাতিসংঘের ওই রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ২০২১ সালে ভারতে ৭৪.১ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যকর খাবার ব্যবস্থা করতে পারেনি। গোটা বিশ্বের নিরিখে ভারতে অপুষ্টির হার ছিল ১৬.৬ শতাংশ। এই হিসাব ২০০০-২০২২ সালের।

মমতা জোটের জট পাকানোর কাজ দিল্লিতে শুরু করলেও পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া তার দলের অস্তিত্ব ভারতের আর কোথাও নেই। সংসদে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ৪২টি আসন আছে। তিনি কংগ্রেসকে মাত্র ২টি আসন ছাড়তে চেয়েছেন একটি মালদহ ও অন্যটি মুর্শিদাবাদ। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি, সংসদে বিরোধী দল নেতা, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য অধীর রঞ্জন চৌধুরী মমতাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, আপনার কোনো দয়া-ভিক্ষা কংগ্রেস চায় না। আপনার যদি সাহস থাকে তবে রহমপুরে এসে আমার বিরুদ্ধে দাঁড়ান। মমতা বা তার মুখপাত্ররা এর কোনো জবাব দেননি। অধীর আরও বলেছেন, ১২টি আসনে আমরা জিততে পারি। এর মধ্যে ৮টি আসনে আমরা জিতবই। আমি সিপিএমকে বলব, এই ৮টি আসনে কোনো প্রার্থী না দিতে।

এদিকে কংগ্রেস ঠিক করেছে ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ৩০০টি আসনে প্রার্থী দেবে। বাকি আসন তারা ইন্ডিয়া জোটকে ছেড়ে দেবে। ইন্ডিয়া জোটের আঞ্চলিক দলগুলো তাতে রাজিও হয়েছে বলে কংগ্রেস সূত্রে জানা যায়। দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোতে কংগ্রেস জয়ী হবে বলে তারা আশা প্রকাশ করেছে। অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ওয়াইএসআর রেড্ডির বোন শর্মিলা রেড্ডি ভাইয়ের দল থেকে বেরিয়ে এসে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। তাতে তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশে কংগ্রেস বেশি আসন পাবে।

অন্যদিকে গত বছর ছয় মাস ধরে কন্যাকুমারী থেকে শ্রীনগর পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যাত্রা করেছিলেন রাহুল গান্ধী। তার দ্বিতীয় যাত্রা শুরু হচ্ছে এই মাসের ১৪ তারিখ থেকে। শুরু করছেন উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর থেকে। যে মণিপুর গত বছরের ছয় মাস ধরে অশান্ত হয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রী সেখানে একবারও যাননি। রাহুল গিয়েছিলেন। রাহুলের এবারের যাত্রা মণিপুর থেকে মুম্বাই। যাবে মোদির রাজ্য গুজরাটেও। পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী ছয়টি জেলায় সফর করবে। রাহুলের আগামী যাত্রায় সফরসঙ্গী হবেন ওইসব এলাকার আঞ্চলিক দলগুলোর নেতৃত্ব। কংগ্রেসের সর্বভারতীয় মুখপাত্র জয়রাম রমেশ বলেছেন, রাহুলের সফরসঙ্গী হওয়ার জন্য সব আঞ্চলিক দলকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। মমতাকেও চিঠি দিয়েছি। মমতার দল যোগ দেবে কি না, সেটা তাদের ব্যাপার। কারণ আমাদের লড়াই বিজেপি-আরএসএসের বিরুদ্ধে।

মমতার দলের দিল্লির মুখপাত্র বলেন, আমরা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। নিলে কংগ্রেসকে জানিয়ে দেব। সর্বশেষ পরিস্থিতি এই রূপ : মমতা এবং দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী একজোট হওয়ার বহু কারণ রয়েছে। সবই দুর্নীতি। অরবিন্দ কেজরিওয়াল মন্ত্রিসভার দুই মন্ত্রী এখন জেলে। মমতা মন্ত্রিসভারও দুই মন্ত্রী জেলে। এ ছাড়া মমতার দলের জেলা নেতৃত্বের ১০-১২ জন জেলে। অরবিন্দ কেজরিওয়াল যখন দল গঠন করেন, তখন মমতার মতোই প্রথম নির্বাচনে লড়ার সময় আমেরিকা থেকে ৮০০ কোটি টাকা অনুদান পেয়েছিলেন। নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া কেজরিওয়ালের তথ্য অনুযায়ী এই অর্থ তাকে নাকি পাঠিয়েছিলেন তার আইআইটির সহপাঠীরা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে একাধিক বিষয়ে মমতার সঙ্গে কেজরিওয়ালের খুব মিল। দুজনেরই আশা- বিজেপি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসুক। এরা দুজন মোদিকে বা আরএসএসকে আক্রমণ করেন না। এদের আক্রমণ বিজেপিকে।

ভারতের বাঘা বাঘা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এদের দুর্নীতির কারণে এরা মোদির সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলেছে। অন্যদিকে সিপিএমের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে সেটিংয়ের কথা বলে আসছেন। তিনি বলেছেন, এরা একে অপরকে ছাড়তে পারবে না। এদের পথের কাঁটাই হলো দুর্নীতি। গত নির্বাচনে বিজেপি সবচেয়ে বেশি (কয়েক হাজার কোটি) টাকা অনুদান পেয়েছিল করপোরেট সংস্থা থেকে। দ্বিতীয় স্থানে ছিল মমতার দল।

শেষ পর্যন্ত এদের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী, ইন্ডিয়া জোটের এই নীতি ও আদর্শ ভাঙার জন্য প্রথম দায়ী মমতা। তার ক্ষমতা ও অর্থের লোভ। ভবিষ্যৎ ভারতকে কোন দিকে নিয়ে যাবে সেটা স্থির করবে কারা? মমতা? অরবিন্দ কেজরিওয়াল? না আমেরিকা? কারণ দুটি দলেরই জন্ম ওয়াশিংটনের হাত ধরে।

সাধারণ মানুষ মোদি-মমতার মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে মোহভঙ্গ হয়ে গেছে। কিন্তু টাকা? অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, টাকা দিয়ে ভোট কেনা যায়। মমতা ২০০৯ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসেন শুধু টাকা খরচ করে। পশ্চিমবঙ্গে আমরা শুনতে পাচ্ছি পুলিশ, থানার মাধ্যমে ভোটারদের ভয় দেখিয়ে টাকা দেয়। সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মুহাম্মদ সেলিম সরাসরি অভিযোগ করেছেন, সদ্য নিযুক্ত পশ্চিমবঙ্গের ডিরেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (এখনো সারদাকান্ডে জামিনে আছেন) রাজীব কুমার। সাবেক পাঁচ ডিজি তাদের বিভিন্ন সরকারি কাজে পুনর্নিয়োগ করে ভোট সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়েছেন। বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনুমান, কংগ্রেস ইন্ডিয়া জোট ধরে রাখলেও মমতা কয়েকটি আঞ্চলিক দল নিয়ে তা ভেঙে দেবেন।

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর