সোমবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

মেয়ে যখন মা

ফরিদুর রেজা সাগর

মেয়ে যখন মা

(আজ মোহনার জন্মদিন। মোহনা রেজা এখন একজন স্থপতি। তিনি ফরিদুর রেজা সাগরের কনিষ্ঠ কন্যা। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মোহনা রেজা গত বছর স্থাপত্যে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। কন্যা মোহনা রেজাকে নিয়ে ফরিদুর রেজা সাগর এ লেখাটি লিখেছেন।)

গল্পের শুরুটা অনেক দিন আগের কথা দিয়ে। মোহনা তখন সবেমাত্র নার্সাফর স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। মোহনার চেয়ে মেঘনা প্রায় চার বছরের বড়। সুতরাং মেঘনা-মোহনাকে নিয়ে দেশের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে কনার তেমন কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না। সেভাবেই প্রোগ্রাম করা হলো, প্ল্যান করা হলো। সিদ্ধান্ত হলো দুবাই ঘুরতে যাওয়ার। দুবাইতে বাচ্চাদের তখন কিছু নতুন নতুন পার্ক হয়েছে। মহাআনন্দে সেখানে যাওয়া হলো। দলের বহরটা একটু বড়ই ছিল। আমার ভাইবোন সবাই। মোহনা তখন সবচেয়ে ছোট। মোহনার সঙ্গে সবাই আনন্দ করতে থাকে। মাত্র সে অল্প অল্প কথা বলে কিন্তু তার চেয়ে বেশি কাঁদে। দুবাইতে যাওয়ার পর ভালোই ছিল সে, সবার কোলে কোলে ঘুরে বেড়ায়। একটু একটু হাঁটতে শিখেছে মাত্র। সেই সময়ে দুবাইতে শাহরুখ খানের একটা ফিল্ম চলছিল। সবার ইচ্ছা হলে বসে শাহরুখ খানের ছবি দেখবে। আমরা সবাই গেলাম মোহনাসহ। সবাই মিলে টিকিট কেটে যথারীতি সিনেমা হলে প্রবেশ করলাম। সবই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু যখনই হলের লাইট বন্ধ হলো তখনই মোহনা শুরু করল কান্না। একটু থামে আবার কাঁদে। অন্ধকারে মোহনার ভালো লাগছিল না। শাহরুখের নতুন ছবি। তাই কেউ হল থেকে বের হতে চায় না। আমি তখন বললাম আমি বাইরে যাই। ওকে নিয়ে একটু বাইরে যাই, কান্না থামলে আবার নিয়ে আসব।

তো আমি বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছি। মোহনাকে বলি ভিতরে যাবে? মোহনা মাথা নাড়ে। কিন্তু দরজার কাছে নিতে গেলেই আবার কান্না শুরু করে। অন্ধকারকে আসলে সে ভয় পেয়েছে। সেই সঙ্গে ছবি চলাকালীন যে শব্দ তাতেও সে আতঙ্কিত হয়তো। কিন্তু বারান্দায় হলের লবিতে দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে। জুসের গ্লাস ধরছে। চারদিকে লাগানো শাহরুখ খানের ছবিগুলো মিটিমিটি চোখে দেখছে। কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ভিতরে যাওয়া নিয়েই তার যত সমস্যা। আমার মনটাও বেশ খারাপ। কারণ শাহরুখের ফিল্মটা দেখতে পারলাম না, কিন্তু অন্যদিকে মোহনার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি সেটাও মন্দ না। ছবি শেষ হলে কনারা বের হয়ে এলো।

কনা বলল, ছবিটা দেখতে পারলে না। বললাম তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই, মোহনার সঙ্গে ভালোই সময় কাটল। মেয়ে আর কান্নাকাটি করেনি হাসিমুখেই বাইরে সময় কাটিয়েছে।

একজন টিকিট চেকার ঠাট্টা করে বললেন, মেয়ের টিকিট চেক হবে সেজন্য উনি হলের বাইরে পাহারা দিচ্ছেন। তারও পরের গল্পটা ৩০ বছর পরের। মোহনা তখন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছে। ছুটিতে দেশে এসেছিল। সে সময়ে আমার শরীরটা খারাপ হয়ে যাওয়ায় আমেরিকা যেতে হয়েছিল। মোহনা সঙ্গে গিয়েছিল। আমেরিকাতে আমার কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হওয়ার পর শরীরটা যখন একটু ভালোর দিকে- সবাই মিলে ঠিক করল নিউইয়র্কে যেহেতু এসেছি একটু থিয়েটার বা সিনেমা দেখলে মন্দ হয় না। তখন অপেরা হাউসে লায়ন কিং চলছে। সবাই রাজি, আমি শুধু একটু আমতা আমতা করছি, অপেরার সিটগুলো খুব ছোট ছোট হয়, আমার বসতে সমস্যা হবে। হাঁটাচলা সহজ নয়, এমনকি পা রাখাটাও ইজি নয়। আমার শরীরের যে অবস্থা আমাকে তোমরা রেখে যাও।

কিন্তু কেউ তাতে রাজি না।

তারা বলল, তুমি যদি না যাও আমরাও যাব না।

আমার জন্য তাদের আনন্দ মাটি হয়ে যাবে বলে তাদের সঙ্গে যেতে আমিও সম্মতি প্রকাশ করলাম। আমিও গেলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ যাওয়ার পর শুরু হলো আমার অস্বস্তি। সিটে বসে পা মেলা যাচ্ছে না। সদ্য অপারেশন করা পেট। খুবই খারাপ লাগছিল। আমি তো ছোট মানুষের মতো কাঁদতে পারি না। কিন্তু আমার অবস্থা দেখে মোহনা বুঝতে পারল।

মোহনা বলল, বাবা তোমার কি অসুবিধা হচ্ছে?

বললাম, না তেমন না। তারপর আবার নড়াচড়া দেখে মোহনা ঠিকই বুঝতে পারল। বলল, চল একটু ঘুরে আসি ভালো লাগবে। সবাই মনোযোগ দিয়ে লায়ন কিং দেখছে, তারই মধ্যে মোহনা আমাকে উঠিয়ে নিয়ে হাত ধরে দুটো সিঁড়ি পার করে লবিতে নিয়ে এসে বলল, তুমি কি কোনো চেয়ারে বসবে?

আমি বললাম, চেয়ারটা একটু নিচু, এই চেয়ারে আমার জন্য বসা কঠিন। আমি বরং একটু হাঁটি। আমি একটু হাঁটতে থাকলাম। এরই মধ্যে দেখি মোহনা ম্যানেজারের রুম থেকে একটি উঁচু চেয়ার নিয়ে এলো।

বলল, এই চেয়ারে বস, তোমাকে একটা অরেঞ্জ জুস খাওয়াব। এখানকার জুস নাকি খুব ভালো। লায়ন কিং-এর ছবিওয়ালা জুসের গ্লাস। আমি চেয়ারে বসে সেই জুস খেতে থাকলাম। তারপর মোহনা বলল, তুমি কি আবার ভিতরে যাবে?

আমি বললাম, আমার বাইরে বেশ ভালোই লাগছে। এখানে খোলা আকাশ দেখি, তুমি বরং ভিতরে যাও। দেখলাম লায়ন কিংয়ের ইতিহাসও রয়েছে। তারপর আগামীতে কি আসবে তাও লেখা রয়েছে। সেগুলো একটু পড়ি।

আমি সেগুলো দেখতে লাগলাম। তবে খেয়াল করলাম মোহনা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে আমাকে ধরে। হলের ভিতরে গেলই না মেয়েটা। ৩০ বছর আগে দুবাইতে মোহনাকে নিয়ে আমি বাইরে অপেক্ষা করেছি। ঠিক ৩০ বছর পর মোহনা আমেরিকার নিউইয়র্কে আমার জন্য সিনেমা হলের বাইরে অপেক্ষা করছে লায়ন কিংয়ের একটি শোতে। বাবা আর কন্যার এ সম্পর্ক এই রক্তের ঋণ বুঝিবা কখনোই শোধ হওয়ার নয়।

সর্বশেষ খবর