সোমবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

বিশ্ব ইজতেমার শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ুক

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

বিশ্ব ইজতেমার শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ুক

বছর ঘুরে আমাদের মাঝে হাজির হয়েছে বিশ্ব ইজতেমা। দুই পর্বের বিশ্ব ইজতেমার পাশাপাশি দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত হচ্ছে জেলা ইজতেমাও। তুরাগ তীরের বিশ্ব ইজতেমা ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। ইজতেমার বিস্তৃতির সঙ্গে ইজতেমার মহান শিক্ষাও জাগিয়ে দিতে হবে মুমিন-মুসলমানের প্রাণে। তা না হলে ইজতেমা আসবে, ইজতেমা যাবে; কিন্তু ধর্মের কোনো উপকার হবে না। উপকার হবে না মানুষেরও। ইজতেমার প্রাণপুরুষ মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) মানুষের জীবনে ধর্মের ফুল ফোটানোর মিশন নিয়ে শুরু করেছিলেন তাবলিগের মেহনত। মেওয়াতের মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) দেখলেন, আহারে! এসব মানুষ যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, নামাজ-রোজা-কালেমা শেখার সময় কোথায় তাদের? তখন তিনি নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে মানুষের মাঝে ধর্ম শিক্ষার মেহনত শুরু করেন। তিনি মানুষের কাছে গিয়ে বলতেন, তোমরা আমার মাদরাসায় ভর্তি হও। আমি তোমাদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করব। অভিনব এ দাওয়াতে সাড়া দিলেন সবাই। আজকের ইজতেমা বৃক্ষের বীজ বপনের ইতিহাস এটিই।

শুধু মেওয়াতের মাওলানাই নন, যুগে যুগে যারাই দাওয়াতের মশাল হাতে প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন তারা সবাই ছিলেন বিচক্ষণ ও সময়োপযোগী কৌশলী ব্যক্তি। মিসরের শ্রেষ্ঠ দায়ী শহীদ হাসান আল বান্নার কথাই ধরা যাক। মানুষের মনে ধর্মের ফুল ফোটানোর জন্য কত যে অভিনব পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন তিনি, যার কোনো হিসাব নেই। এক দিনের ঘটনা। রেলস্টেশনে বসে আছেন দায়ী বান্না। তিনি ভাবছেন, স্টেশনের এত ব্যস্ত মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় কীভাবে? কোন পদ্ধতি প্রয়োগ করলে মানুষ আমার কথা শুনবে? এসব ভাবতে ভাবতে তার মাথায় একটি বুদ্ধি এলো। তিনি এক বোতল কেরোসিন নিয়ে নিজের গায়ে ঢালতে শুরু করলেন। এ দৃশ্য দেখে কিছু লোক জড়ো হলো। এবার তিনি নিজের গায়ে আগুন দিতে যাবেন এমন সময় কিছু মানুষ তাকে ধরাধরি করে থামিয়ে দিল। তারা বলল, ভাই! আপনি কি পাগল হয়েছেন? নিজেকে জ্বালিয়ে দিচ্ছেন কেন? এবার হাসান আল বান্নার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। মনে মনে বলল, এ সুযোগের অপেক্ষায়ই তো ছিলাম এতক্ষণ। উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ্য করে বান্না বললেন, ভাই! আমার দেহে দুনিয়ার আগুন লাগাতে দেখে আপনারা আমাকে পাগল বলছেন; কিন্তু আপনারা যে এর চেয়ে সত্তর গুণ বেশি তেজস্বী আগুনের দিকে ধাবিত হচ্ছেন সে খবর আছে? মহান আল্লাহর দাসত্ব ছেড়ে খাহেশাতে নফসের দাসত্ব করে আমরা নিজেকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে চলছি। এখনই সময় সতর্ক হওয়ার। এভাবে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে দাওয়াতের মেহনত করেছেন হাসান আল বান্না।

প্রিয় তাবলিগি ভাই! আমাদেরও অনুসরণ করতে হবে অগ্রজদের পথ ও পন্থা। উদ্ভাবন করতে হবে নতুন নতুন সময়োপযোগী পদ্ধতি। তৈরি করতে হবে দাওয়াতের ক্ষেত্র। মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর মতো আমরা যদি চিন্তা-শ্রম ও মেধা দিয়ে নিজের সবটুকুন সামর্থ্য ও যোগ্যতা দাওয়াতের পেছনে ব্যয় করতে পারি তবে আমাদের ময়দান হবে উর্বর। অল্প সময়ে আমরাও জয় করতে পারব মানুষের হৃদয় ও মন। তিন দিনে ইজতেমায় বা নির্দিষ্ট সময় মসজিদে অবস্থান করলেই তাবলিগ হয় না। তাবলিগের জন্য প্রয়োজন মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) এর মতো মানবদরদি একটি হৃদয়। তিনি যেমন মানুষ ও মানবতার কল্যাণে জীবনকে উৎসর্গ করেছেন, তেমনি আমাদের উচিত মানবতার প্রেমে জীবন বিলিয়ে দেওয়া। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। এ সময় করতে হবে প্রযুক্তির তাবলিগ। প্রযুক্তির মাধ্যমে কীভাবে সব মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়, কীভাবে ধ্বংস-উন্মুখ তরুণ প্রজন্মকে কোরআনের ছায়ায় নিয়ে আসা যায়- এসব বিষয় ভাবতে হবে ইলিয়াস (রহ) এর মতো দরদি হৃদয় নিয়ে। তিনি যেমন উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তার সময়ের মানুষের প্রধান সমস্যা ছিল অন্ন-বস্ত্রের অভাব, আর এ অভাব পূরণ করেই তিনি তাবলিগের মেহনত করেছিলেন। আজ আমাদেরও বুঝতে হবে এ বিশ্বের প্রধান রোগ হলো প্রযুক্তিনেশা। সুতরাং এ প্রযুক্তির মাধ্যমেই মানুষের মাঝে পৌঁছে দিতে কোরআনের দরদি বয়ান তাবলিগ। পৌঁছাতে হবে ‘ছয় উসুল’, ‘ইকরামুল মুসলিমিন’। মানুষকে ভালোবাসার মন্ত্র দিয়ে করতে হবে তাবলিগের মেহনত। যদি আমরা তা করতে না পারি তবে আমাদের জীবনে ইজতেমা আসবে-যাবে কিন্তু কোনো উপকার হবে না। যে কথাটি শুরুতেই বলেছিলাম। আমরা যেন সব বিভেদ ভুলে মানবতার কল্যাণে তাবলিগ করি। সময়ের চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে বয়ান করি। পবিত্র কোরআন যেমন মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে সৃষ্টির কল্যাণে নাজিল হয়েছে, তেমনি বিশ্ব ইজতেমা এবং তাবলিগের মেহনত ও গোটা মানব সমাজের জন্য পরিচালিত হতে হবে।

 

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর