মঙ্গলবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ প্রসঙ্গে দুটি কথা

রণ্‌জিৎ কুমার

ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ প্রসঙ্গে দুটি কথা

১৪ ডিসেম্বর ২০২২-এর ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এ প্রকাশিত ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ সাহেবের ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’ লেখাটি পড়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে কি, লেখাটি এ পর্যন্ত আমি দু-তিনবার পড়েছি। আমার মতে, এটা একটা অসাধারণ লেখা। আমি অভিভূত! তাই বিবেকের তাড়নায় এতদিন পরে হলেও তাঁর সম্পর্কে একটু না লিখে পারলাম না। লেখাটিতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের বাইরেও বাংলা সাহিত্য, দর্শন শাস্ত্র, ইতিহাস, নীতি শাস্ত্র, ধর্ম শাস্ত্র, সংগীত প্রভৃতি বিষয়ের ওপর তাঁর মনীষা ও পান্ডিত্যের ছাপ প্রশংসার দাবি রাখে। লেখাটিতে একজন মানুষ হিসেবে সেই সত্যটি তুলে ধরা হয়েছে। 

লেখাটির শুরুতেই তিনি মানুষের ক্ষণস্থায়ী জীবনে মৃত্যুর অনিবার্যতার কথা উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি গীতিকবিতাধর্মী সংগীত এবং বাউল সংগীত থেকে উপমা টেনেছেন... ‘একদিন মাটির ভিতরে হবে ঘর রে মন আমার’ প্রণিধানযোগ্য। বিশ্বকপি তাঁর ‘দুর্লভ জন্ম’ কবিতায় বলেছেন, ‘...পরদিন এই মতো পোহাইবে রাত, জাগ্রত জগৎ পরে জাগিবে প্রভাব। কলরবে চালবে সংসারের খেলা।’ ঠিক একইভাবে আলোচ্য প্রবন্ধের রচয়িতাও বলেছেন, ‘আমি বা আমাদের মৃত্যুর পরেও পৃথিবীর চলমানতা থেমে যাবে না, কর্মযজ্ঞ একই নিয়মে চলতে থাকবে।’ তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘তখন এমনি করেই, বাজবে বাঁশি এই নাটে, কাটবে গো দিন আজও যেমন দিন কাটে...।’ অপূর্ব উপমা!

তিনি তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, অর্থ যশ খ্যাতি ক্ষমতার জন্য আমরা এ বিশ্ব সংসারে অবিরত ছুটে চলেছি। এ প্রসঙ্গে তিনি কবিগুরুর ‘শাজাহান’ কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন-

‘বার বা কারো পানে ফিরে চাহিবার নাই যে সময়, নাই নাই’। অথচ ‘কালস্রোতে’-ভেসে যায় জীবন যৌবন ধনমান।’ চমৎকার উদাহরণ।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় মৃত্যুর আগে লিখেছিলেন,

‘জীবন এত ছোট কেনে?

এই খেদ মোর মনে।’

তিনি লিখেছেন, ‘এ জীবনটা আমাদের কল্পনার চেয়েও ছোট।’ তাই পরার্থে জীবন উৎসর্গ করাই হবে সবচেয়ে বড় অর্জন। এ প্রসঙ্গে তিনি কবি কামিনী রায়ের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন,

‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি

এ জীবন মন সকলি দাও,

তার মত সুখ কোথাও কি আছে, আপনার কথা ভুলিয়া যাও।’

নারী নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন, শিশু হত্যা, অ্যাটম বোমা থেকে শুরু করে ভয়ানক মারণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা প্রভৃতি লেখককে দারুণভাবে ব্যথিত করে। এর ভয়াবহতা বোঝাতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘মানুষের দ্বারাই অস্বাভাবিকের চেয়েও অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেই চলেছে।’ ‘রুদ্ধগৃহ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন, ‘এখানে মৃত্যুর যেন মৃত্যু হইয়াছে-’। ঠিক তেমনি লেখকের কথাটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এই উক্তিটির তুলনা চলে। ধর্ম সম্বন্ধে বলতে গিয়ে প্রাবন্ধিক বলেছেন, ‘সর্ব ধর্মই মানবসেবার কথাই বলে’।

প্রবন্ধের শেষের দিকে তিনি একটি শাশ্বত সত্যকে তুলে ধরেছেন- ‘জীবনের যা অর্জন তার কিছুই মৃত্যুর পর সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যাবে না’। ইতিহাস থেকে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মৃত্যুর আগ মুহূর্তের একটি কাহিনি উল্লেখ করেছেন এবং একটি বাউল সংগীতের উপমা টেনেছেন, ‘খ্রিস্টান হইলে কফিনে, মুসলিম হইলে কাফনে, হিন্দু হইলে চিতায় পুড়ে ছাই। দুই দিনের এই দুনিয়াতে গৌরব করার কিছু নাই।’ অসাধারণ উপমা! পরিশেষে স্বামী বিবেকানন্দের একটা বাণী দিয়ে তিনি লেখাটির ইতি টেনেছেন, ‘হে মানুষ! কোথায় চলে যাবিরে, পদচিহ্ন রেখে যা!’

আলোচ্য প্রবন্ধে শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আবদুল্লাহের হৃদয়ের বিশালতার পরিচয় ফুটে উঠেছে। ভাবতেও অবাক লাগে Chamber, OT, ছুরি-কাঁচি, হাসপাতাল, রোগী, ক্লাস নেওয়া- এসব কিছু সামলিয়ে জ্ঞানের এতগুলো শাখায় বিচরণ তথা পান্ডিত্য অর্জন কী করে সম্ভব? সামনাসামনি আমি তাঁকে দেখিনি, তবে দূর থেকে আমি তাঁকে অন্তর্নিহিত শ্রদ্ধা এবং শতকোটি প্রণাম জানাই।

 লেখক : সাবেক শিক্ষক, মিরপুর বাংলা উচ্চবিদ্যালয়, ঢাকা

সর্বশেষ খবর