বুধবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

রেজওয়ানা বন্যাকে শত সহস্র অভিনন্দন

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

রেজওয়ানা বন্যাকে শত সহস্র অভিনন্দন

বহু দুঃসংবাদের মধ্যেই কিছু সুসংবাদ চলে আসে, যা অবাঞ্ছিত সংবাদের নেতিবাচক প্রভাব ক্ষুণ করে আনন্দের জোয়ার ঘটায়। এটি সম্ভবত প্রকৃতিরই নিয়ম। গাজা অঞ্চলে প্যালেস্টাইনিদের ওপর চালানো গণহত্যা, বিএনপি-জামায়াতিরা অগ্নিসন্ত্রাস বন্ধ করবে না এমন ঘোষণা, ধর্মান্ধদের আস্ফালন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে ড. ইউনূসের পক্ষে কিছু মার্কিন সিনেটরের অনাধিকারমূলক চিঠি এবং সবশেষে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পরিচয়ে এক জামায়াত-তালেবানি চরের ধৃষ্টতা, অপরাধমূলক কান্ড ও বক্তব্য, সবকিছু মিলে মনে অনেক ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছিল। ঠিক তখনই আমাদের গর্ব, বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী বন্যাদিকে (আমি তাকে বন্যাদি বলেই সম্বোধন করি) ভারত সরকার পদ্মশ্রী খেতাব প্রদান করে সম্মানিত করবে, এমনি এক আনন্দধারাসম, গৌরবের খবর, জমাট বাঁধা দুঃখগুলোকে বহুলাংশে ম্লান করে দিয়েছে। বন্যাদির সম্মাননার খবরটি আমাদের দেশের অনেকের মনকেই উল্লাসের বন্যায় প্লাবিত করেছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে তিনি এই সম্মানের নিশ্চিত দাবিদার। অতীতে তিনি বাংলাদেশ সরকার থেকে স্বাধীনতা পদক এবং পশ্চিম বাংলা সরকারের দেওয়া ‘বঙ্গভূষণ’ পদক পেয়ে আমাদের সবাইকে গৌরবান্বিত করেছিলেন।

পদ্মশ্রী ভারতের তৃতীয় শীর্ষ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। ভারতের যে সব সংগীত ও চলচ্চিত্র শিল্পী এ পদকে ভূষিত হয়েছেন, তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যরা হলেন-সত্যজিত রায়, সুচিত্রা সেন, পংকজ মল্লিক, ওয়াহিদা রহমান, অপর্ণা সেন, অশোক কুমার, মান্না দে, রাশিদ খান, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যাম বেনেগল, সচিন কর্তা, সাবিত্রি, সুপ্রীয়া, সুনিল দত্ত, ঋত্বিক ঘটক, ভূপেন হাজারিকা, শাবানা আজমি, অমিতাভ বচ্চন, জয়া বচ্চন, ফিদা হুসেন, আমির খান, সাইফ আলি খান, শাহরুখ খান, অক্ষয় কুমার হেমা মালিনি, শ্রীদেবী, মোহাম্মদ রফি, এ আর রহমান, ঐশ্বরিয়া, শংকর জয়কিসান, কুমার সানু, তপন সিনহা, পংকজ উদাস, বৈজয়ন্তিমালা, অনুরাধা পাওয়াল, রেখা, মাধুরী দীক্ষিত, নানা পাটেকার, বিদ্যা বালান প্রমুখ।

সন্ধ্যা এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো কিংবদন্তিতুল্য সংগীত শিল্পীদ্বয় পদ্মশ্রী পদক অগ্রাহ্য করেছিলেন সম্ভবত এ কারণে যে তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি। লতা মুঙ্গেশকরকে অবশ্য সর্বোচ্চ ভারত রত্ন পদক দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে এই পদক পেয়েছেন বাংলাদেশে রবীন্দ্র সংগীতের দিকপাল সনজিদা খাতুন, বীর মুক্তিযোদ্ধা (প্রবাসী তালিকা) ড. এনামুল হক (জাদুঘরের প্রাক্তন প্রধান), বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল সাজ্জাত আলী জহির, বীরপ্রতীক, সমাজকর্মী ঝর্ণাধারা চৌধুরী, প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এবং কূটনীতিবিদ সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীকে অবশ্য একধাপ ওপরের ‘পদ্মভূষণ’ সম্মাননা দেওয়া হয়েছিল।

বন্যাদির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল আকস্মিকভাবে। ১৯৮৬ সালের কথা। আমি তখন বিলেত প্রবাসী, যুক্তরাজ্য ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইজরি সার্ভিসের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলাম। সে সময় লন্ডনস্থ ভারতীয় বিদ্যাভবনে এক সংগীত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের দুজন শিল্পী, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা এবং রথীন্দ্রনাথ রায় গান গাইবেন বলে জানতে পারলাম। প্রবাস জীবনে ছিলাম বলে বন্যাদির নাম আগে শুনিনি। বাংলাদেশে থাকাকালীন রবীন্দ্র সংগীত জগতে খ্যাতনামাদের মধ্যে সনজিদা, ফাহমিদা, কলিম শরাফি, মাহমুদুল হক, অজিত রায়, পাপিয়া সরওয়ার, আবদুল ওয়াদুদ, সুধীন দাস, ইকবাল আহমেদ, কাদেরি কিবরিয়াদের (লতা) নাম জানতাম, কিন্তু প্রবাস জীবনে চলে যাওয়ার কারণে পরবর্তীকালের শিল্পীদের নাম জানা বা গান শোনার সুযোগ হয়নি। আমি, গাফ্ফার ভাই, আমাদের এক সংগীতপ্রেমী বন্ধু ফারুক হায়দার মিলে ভারতীয় বিদ্যাভবনে প্রথমবারের মতো বন্যাদিকে দেখা ও তার গান শোনার সৌভাগ্য অর্জন করে তার গান শুনে বুঝতে পেরেছিলাম তিনি বাংলাদেশের গন্ডি পেরিয়ে গোটা উপমহাদেশেই প্রসিদ্ধি লাভ করবেন। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় স্টাইলে তার গান, যা সুচিত্রা মিত্র, দেবপ্রিয় বিশ্বাস, পংকজ মল্লিক এবং চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় স্টাইল থেকে আলাদা, শুনে এটাও বুঝতে পেরেছিলাম যে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় (মোহর দি) তার নিজ উদ্যোগে শিখিয়েছেন বন্যাদিকে। সেদিন তার সঙ্গে দেখা না হলেও তার কদিন পরেই অপ্রত্যাশিতভাবে সুযোগটি এসেছিল এক সমস্যাজনিত কারণে। প্যারিসে বসবাসকারী কিছু বাঙালির আমন্ত্রণে সে দেশে গিয়ে কয়েকদিন পর জাহাজযোগে তিনি বিলেতের ফোকস্টন বন্দরে ফিরে এলেই বিভ্রাট ঘটল। ইমিগ্রেশন কর্তারা তাকে বিলেতে প্রবেশাধিকার না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। রাত ১টার দিকে গাফ্ফার ভাই আমার হস্তক্ষেপ চেয়ে ফোন করলে ইমিগ্রেশন কর্তাদের থেকে জানতে পারলাম বন্যাদি অতি সত্যবাদী হওয়ার কারণেই সমস্যা। ইমিগ্রেশন কর্তাদের বলেছিলেন তিনি গান গাওয়ার জন্য এসেছেন। ব্রিটিশ ইমিগ্রেশন আইন অনুযায়ী গান গাওয়াসহ যে কোনো কর্ম সংক্রান্ত উদ্দেশ্যে আসার জন্য প্রয়োজন ওয়ার্ক পারমিটের। পর্যটন ভিসার ধারকরা তা পারেন না। যাই হোক আমার হস্তক্ষেপের কারণে বন্যাদির বিলেত প্রবেশের বাধা সরে যাওয়ায় পরদিনই তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য দেখা করতে চাইলে সেই গৌরবময় ক্ষণটি চলে এলে, গাফ্ফার ভাই, ফারুক হায়দার, পূর্ব লন্ডনের রাজনীতির এক দিকপাল, জানে আলমসহ তার নিমন্ত্রণে কফি পানের সময় দেখা এবং অনেক কথা।

এর কিছুদিন পর কার্ডিফ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বন্যাদি, রথীন্দ্রনাথ রায়কে গান গাওয়ার নেমন্তন্য করা হলে নিমন্ত্রিতদের তালিকায় আমার এবং গাফ্ফার ভাইয়েরও স্থান হয়েছিল। নিমন্ত্রণকারীদের এক নেতার বৃহদাকার গাড়ি চড়ে বন্যাদি, রথিন এবং সম্ভবত লন্ডনভিত্তিক গায়ক, হিমাংসু গোস্বামীসহ ভ্রমণকালে, চালক, আওয়ামী লীগ নেতা কিছুক্ষণ হেমন্ত, সন্ধ্যা, মান্না, শ্যামল মিত্র, সতিনাথ, গিতা দত্ত, লতা প্রমুখের গান বাজানোর পর হঠাৎ বলে ফেললেন এবার আপনাদের দেলওয়ার হোসেন সাঈদীর ওয়াজ শোনাব। গাফ্ফার ভাই রেগে আগুন। আমার অবস্থাও অভিন্ন। তবে গাফ্ফার ভাই রুক্ষতার আশ্রয় না নিয়ে বরং সাঈদী নামক ধর্মান্ধ গংয়ের সম্পর্কে বুঝালে কার্ডিফের আওয়ামী নেতা তার ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। পরবর্তীতে লন্ডনে বন্যাদির সঙ্গে বহুবার দেখা হয়েছে, তার সুরের মূর্ছনায় সম্মোহিত হয়েছি। বিশেষ করে সেদিনটির কথা মনে পড়ে যেদিন বেশ ঘটা করে তার ছোট বোন ঊর্মি মাজহারের (বর্তমানে নাটক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব) বিয়ে হয় লন্ডন শহরে।

আমার থেকে পাওয়া সামান্য উপকারের কথা বন্যাদি কখনো ভোলেননি। আমার স্ত্রীর প্রয়াণের পর ঢাকা ফিরে এলে ছোট মেয়ে নাদিয়া চৌধুরীর (বর্তমানে ব্যারিস্টার) এক জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বন্যাদিকে অনুরোধ করা মাত্রই তিনি আমার মেয়ের জন্মদিবসের ঘরোয়া অনুষ্ঠানে গান গাইতে রাজি হয়েছিলেন যদিও তখন একজন বড় মাপের কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তিনি কোনো ঘরোয়া অনুষ্ঠানে গান গাইতেন না। এরপরও তিনি একাধিকবার আমার ঘরোয়া অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন ড. হাসান মাহমুদ, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, হাসানুল হক ইনু প্রমুখের বিশেষ অনুরোধে।

যে ঘটনাটি ভোলার নয়, তা ঘটেছিল ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের মাসখানেক আগে। অনুজসম সবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মইনুজ্জামান মুক্তা সে বছরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থিতা প্রত্যাশী হয়ে পঞ্চগড়ে এক বিশাল জনসমাগমের আয়োজন করে ঢাকা থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন মোস্তফা জব্বার সাহেবকে (তখনো মন্ত্রী হননি), বন্যাদিকে, আমাকে এবং মুন্নী সাহাকে। বন্যাদির দায়িত্ব ছিল রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া। আমি মুক্তাকে বলেছিলাম এই প্রান্তিক অঞ্চলে কে রবীন্দ্র সংগীত শুনবে? আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল যখন একটি রবীন্দ্র সংগীত গাওয়ার পর হাজারো শ্রোতা বন্যাদিকে একের পর এক রবীন্দ্র সংগীত গাইতে অনুরোধ করছিলেন। মুক্তা সে যাত্রা মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হলেও এই বছর ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। মুক্তার অনুষ্ঠান শুরুর আগে বন্যাদি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের একটি জনপ্রিয় গান ‘ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা, এ মাধবী রাত’ গানটি গুনগুন করে বারবার গাইছিলেন। রবীন্দ্র সংগীত শিল্পীর কণ্ঠে সন্ধ্যার এই পুরনো দিনের আধুনিক গান শুনে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন বারবার এটি গাইছেন? উত্তরে বলেছিলেন কদিন আগে পদক গ্রহণের জন্য কলকাতার অনুষ্ঠানে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাছোড় বান্দার মতো সন্ধ্যা মুখার্জিকে অনুরোধ করলে সন্ধ্যা (যখন তার বয়স ৯০’র কাছাকাছি) এ গানটি গেয়েছিলেন যা এখনো তার কানে বাজছে। রবীন্দ্র সংগীতের শিল্পী হয়েও পুরনো দিনের এই আধুনিক গানটিও তিনি যে নৈপুণ্যের সঙ্গে গাইছিলেন তাতে মনে হচ্ছিল যেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ থেকেই গানটি শুনছি। কয়েক বছর আগে সকাল বেলা বন্যাদি এক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে রবীন্দ্র সংগীত গেয়েছিলেন। সেদিনটি ছিল তার জন্মদিবস। হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে গান গাওয়াকালেই ফোন করে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালে, বন্যাদি নিজে যেমন অবাক হয়েছিলেন, তেমনি বিস্মিত হয়েছিলেন সবাই। ভারতে বহু প্রথিতযশা রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী থাকা সত্ত্বেও বন্যাদি সে দেশের রবীন্দ্র সংগীত জগতে বিশেষ অবস্থান তৈরি করতে পারায় আমাদের গর্বিত হওয়াই স্বাভাবিক। একইভাবে পদ্মশ্রী পদক প্রাপ্তিতেও আমরা গর্বিত।

২০১৬ সালে ভারত সরকারের নিমন্ত্রণে বর্তমান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে আমরা কয়েকজন দিল্লি গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানের শেষ সেশনে সভাপতিত্বের ভার পড়েছিল আমার ওপর যাতে প্রধান অতিথি ছিলেন ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি, যার মা বাঙালি হওয়ার কারণে তিনি বাংলায় পারদর্শী, বক্তৃতাও দিয়েছিলেন বাংলায়। ভাষণের এক পর্যায়ে বলেছিলেন ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের রবীন্দ্র চর্চা অধিক। তিনি আরও বলেছিলেন বাংলাদেশে এমন কয়েকজন রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী রয়েছেন যারা গুণগতমানে ভারতের অনেক শীর্ষ রবীন্দ্র সংগীত শিল্পীর সমকক্ষ। শুনে গর্বে বুক ভরে গিয়েছিল। বন্যাদিসহ অন্যান্য খ্যাতনামা রবীন্দ্র সংগীত শিল্পীর কারণেই স্মৃতি ইরানি এমনটি বলেছিলেন।

অভিনন্দনের সঙ্গে সঙ্গে বন্যাদির সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘায়ু কামনা করছি, যাতে তিনি আরও অনেক বছর বাঙালির সংস্কৃতির দিকপাল হয়ে সেবাদান করতে পারেন।

                লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

সর্বশেষ খবর