বৃহস্পতিবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা
শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী

কামাল বারি

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী

কর্মনিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে জায়গা করে নেওয়া ধীমান দেশপ্রেমী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। আপন আলোয় উদ্ভাসিত একজন মহান পুরুষ। শিক্ষা, সংস্কৃতি, আইন, রাজনীতি-প্রতিটি অঙ্গনে তিনি তাঁর কাজের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। জন্ম ১৯২১ সালের ৩১ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের নাগবাড়ী গ্রামে। তাঁর পিতা আবদুল হামিদ চৌধুরী তদানীন্তন প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত স্পিকার ছিলেন। শিক্ষাজীবনে তিনি ছিলেন কৃতী শিক্ষার্থী। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ ও আইন শাস্ত্রে ¯স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। লন্ডনের লিংকন্স ইন থেকে বার-এট-ল ডিগ্রি নিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জুনিয়র হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করেন। মেধাবী আইনজীবী আবু সাঈদ চৌধুরী ছিলেন পেশাগত জীবনে অত্যন্ত সফল মানুষ। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাডভোকেট জেনারেল এবং ঢাকা হাই কোর্টের বিচারপতি ছিলেন। বিচারপতি চৌধুরী কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে উপাচার্যের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তখন তিনি জেনেভায় অবস্থান করছিলেন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগ দিতে। খুব দ্রুত সিদ্ধান্তে তিনি প্রাদেশিক শিক্ষা সচিবকে পত্র দিলেন, ‘আমার নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর পর আমার আর ভাইস চ্যান্সেলর থাকার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। তাই আমি পদত্যাগ করলাম।’ জেনেভাস্থ জাতিসংঘ প্রাসাদে অনুষ্ঠিত মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ভেনিজুয়েলার বিশিষ্ট কূটনীতিবিদ এগিলারের অনুমতি নিয়ে সভার শুরুতেই বিবিসির খবরের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে আমি অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে পড়েছি। আমি এখনই আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। আজকেই লন্ডনে ফিরে যাব এবং সেখান থেকে সম্ভব হলে ঢাকায়। বর্তমান অধিবেশনের সমাপ্তি পর্যন্ত থাকতে পারছি না।’

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণে জেগে ওঠে বাংলাদেশ। পরাধীন স্বদেশকে স্বাধীন করার দৃঢ় প্রত্যয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয় সমগ্র বাঙালি। এরপর ২৫ মার্চের সেই ভয়াল কালরাত। বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মম গণহত্যা চালায় নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। নির্মম এই গণহত্যার খবরে আবু সাঈদ চৌধুরী বিবিসির খবরে জানতে পারলেন, ঢাকা বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে; গুরুতর কিছু ঘটেছে। তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘...সাতাশে মার্চ শনিবার সকালে ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের বিবরণী এবং ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের খবর বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। এরপর ভয়াবহ হত্যার কথা সব কাগজেই উল্লেখ করে। কেনেথ ক্লার্কের পাঠানো করাচি থেকে একটি রিপোর্টে বলা হয়, ‘জিন্নার একতার স্বপ্ন রক্তে ধুয়ে-মুছে গেছে।’ এদিকে দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে স্বাধীনতার স্বপক্ষে জনমত গড়ে তোলায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন অকুতোভয় দেশপ্রেমী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। পাকিস্তানি সরকারের নানা ভয়ভীতি প্রদর্শনেও একবিন্দু বিচলিত না হয়ে সাহসী দেশপ্রেমী সাঈদ চৌধুরী দীপ্তকণ্ঠে বলেন, ‘লন্ডনের রাস্তায় আমার শবদেহ পড়ে থাকবে তবু পাকিস্তানের সঙ্গে আপস করে দেশে ফিরব না।’

আবু সাঈদ চৌধুরী বিশ্বের দেশে দেশে ঘুরে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের গণহত্যার বিরুদ্ধে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপক্ষে বিশ্বমত গড়ে তোলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর এ মহৎ কাজ অব্যাহত রাখেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং তাঁর অনুরোধে তিনি ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেন। বলার অপেক্ষা রাখে না মেধা, দক্ষতা, সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা এবং কর্মকুশলতার গুণে তাঁর অর্জিত প্রতিটি পদকে সাঈদ চৌধুরী গৌরবান্বিত করে গেছেন।

১৯৭৩ সালে তিনি রাষ্ট্রপতির পদ ত্যাগ করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৮৫ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি নির্বাচিত হন।

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়নকালে ১৯৩৯ সালে তিনি কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি সম্পাদনা করতেন ‘রূপায়ণ’ নামে গুরুত্বপূর্ণ একটি সাহিত্য মাসিক। পত্রিকাটি গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য যে, অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রকাশে ব্রতী হয়ে তিনি পত্রিকাটি প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি রূপায়ণের জন্য কবি নজরুলের কবিতা সংগ্রহ করতেন। পত্রিকাটি প্রকাশের প্রেরণা পান তিনি কবি নজরুলের থেকেই। পত্রিকার নামও কবির দেওয়া। অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার প্রগতিশীল সেরা কবি-সাহিত্যিকদের লেখা সংগ্রহ করা হতো এ পত্রিকাটির জন্য। আর এসবই হতো কবি নজরুলের পরিকল্পনা মতোই।

দেশের স্বাধীনতার জন্য বিশ্বমত গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে বিচারপতি চৌধুরী আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন অগ্রসৈনিকের গুরুদায়িত্ব পালন করে গেছেন।  তাঁর এই অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মান ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ‘ডক্টর-অব-ল’ ডিগ্রিতে ভূষিত করে।

১৯৮৭ সালের ২ আগস্ট তিনি লোকান্তরিত হন। বাংলাদেশ এবং বাঙালির ইতিহাস যতদিন থাকবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর মতো বীর বাঙালির নাম ততদিন গৌরবোজ্জ্বল অক্ষরে লেখা থাকবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ভিতর সঞ্চারিত হবে তাঁদের বীরত্বগাথা।  গতকাল ছিল বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর শুভ জন্মদিন। তাঁর অমর স্মৃতির উদ্দেশে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক : কবি-সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর