শনিবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

সেইসব গানের দিন ২

ইমদাদুল হক মিলন

সেইসব গানের দিন ২

শ্যামল মিত্রেরও জনপ্রিয় গানের সংখ্যা অনেক। তাঁর গায়নভঙ্গি অন্যরকম। নাকে বেঁধে বেঁধে যায় এমন কণ্ঠস্বর এবং অত্যন্ত রোমান্টিক। ‘আহা ওই আঁকাবাঁকা যে পথ যায় সুদূরে’ ‘সেদিনের সোনাঝরা সন্ধ্যায়’। ‘যা যারে যা পাখি’ রমাপদ চৌধুরীর প্রথমদিককার লেখা ‘দ্বীপের নাম টিয়ারঙ’ ছবির পরিচালকের কথা মনে নেই তবে শ্যামল মিত্রের সেই গান ‘আমি চান্দের সাম্পান যদি পাই’ ভোলা যাবে না। উত্তম কুমার ও তনুজা অভিনীত ‘দেয়া নেয়া’ ছবির প্রযোজক ছিলেন শ্যামল মিত্র। তিনি বেশকিছু ছবি প্রযোজনা করেছেন। ‘দেয়া নেয়া’ ছিল একজন গানের শিল্পীকে নিয়ে। শিল্পীর ভূমিকায় উত্তম কুমার। এ ছবির প্রতিটি গান হিট। বিশেষ করে ‘জীবনখাতার প্রতি পাতায়’ আর ‘গানে ভুবন ভরিয়ে দেবে’ অতুলনীয়। সুরকার হিসেবেও ছিলেন উচ্চমানের। বহু ছবির সংগীত পরিচালনা করেছেন। উত্তম কুমারের শেষ দিককার জনপ্রিয়তম সিনেমা ‘অমানুষ’ এর সংগীত পরিচালক ছিলেন শ্যামল মিত্র। কিশোর কুমারকে দিয়ে চমৎকার চমৎকার গান গাইয়েছিলেন। যেমন, ‘কী আশায় বাঁধি খেলাঘর’ বিপীনবাবুর ‘কারণসুধা’। মহান সত্যজিৎ রায় ‘চারুলতা’য় কিশোর কুমারকে দিয়ে রবীন্দ্রসংগীত গাইয়েছিলেন, ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের বেশির ভাগ গানই ছিল বিরহের। ঢাকার আরমানিটোলার উচ্চবিত্ত ঘরের মেয়ে উৎপলা সেন নামকরা সংগীতশিল্পী। উৎপলা সেনের প্রেমে মগ্ন ছিলেন সতীনাথ। স্বামীর মৃত্যুর পর সতীনাথকেই বিয়ে করেছিলেন উৎপলা। সতীনাথের গান ‘জীবনে যদি দীপ জ্বালাতে নাহি পারো’ ‘আকাশ এত মেঘলা যেয়ো নাকো একলা’ ‘পাষাণের বুকে লিখো না আমার নাম’ ‘যদি তুমি না, এ গান কোনোদিন শোনো’ এ রকম অনেক গান সতীনাথকে ব্যাপক জনপ্রিয় করেছিল। মান্না দের কথা আগে কিছুটা বলেছি। তিনি সংগীত জগতের কিংবদন্তি। তাঁর একটু কম জনপ্রিয়, একটু কম শোনা দুতিনটা গানের কথা খুব মনে পড়ে। ‘হারমোনিয়াম’ সিনেমাতে গেয়েছিলেন ‘ময়নামতির পথের ধারে দেখা হয়েছিল’। সিনেমাটির নাম ভুলে গেছি কিন্তু গানটির কথা মনে আছে। উত্তম ছিলেন নায়কের ভূমিকায়। নায়িকা সম্ভবত সুপ্রিয়া দেবী। গানটি হলো ‘এবার মরলে সুতো হবো, তাঁতীর ঘরে জন্ম লবো, পাছাপেড়ে শাড়ি হয়ে দুলবো তোমার কোমরে’ যতবার এ গানটি শুনি, খুব মজা পাই। উত্তম কুমারের মতো চির রোমান্টিক নায়কের মুখে ‘পাছা’ শব্দটি শুনে খুব হেসেছি। ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যায়ে খুব ভালো লেগেছিল মান্না দের রাগাশ্রয়ী গান ‘রাধা চলেছে মুখটি ঘুরায়ে কাঁদে শ্যামের বাঁশরী’। আমার বন্ধু এখন বিখ্যাত হস্তরেখাবিদ আহমেদ মাসুদ এই গানটি খুব সুন্দর করে গাইত। আমাদের দুজনের আরেক প্রিয় বন্ধু লুৎফর রহমানের ডাকনাম ছিল ধলা। মিউজিক কলেজের ছাত্র ছিল। শ্যামল মিত্রের গান ভারি সুন্দর গাইত। কয়েক বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ধলা।

বিক্রমপুর থেকে ঢাকায় পাকাপাকিভাবে চলে এলাম ’৬৪ সালে। গেন্ডারিয়ায় থাকি, গেন্ডারিয়া হাইস্কুলে পড়ি। দীননাথ সেন রোডে আমার মায়ের একমাত্র মামার বাড়ি। ওই বাড়ির মামা-খালারাই আমাদের সবচেয়ে কাছের। বীণাখালা আমার বন্ধু। আমার নানা গানপাগল মানুষ। বাড়িতে গ্রামোফোন, হারমোনিয়াম সবই আছে। গল্পের বই পড়ার ব্যাপক অভ্যাস প্রত্যেকেরই। আমার টুনুমামা অনুমামা কলেজে পড়েন। এতক্ষণ ধরে যাঁদের নাম বললাম সেসব শিল্পীর যে কোনো নতুন রেকর্ড বেরোলেই পাটুয়াটুলির রেকর্ডের দোকান থেকে সেই রেকর্ড কিনে আনেন। বাড়িতে কাঠের সুন্দর দোতলা ঘর। গেটের কাছে বেশ কয়েকটা লিচু গাছ। বাঁধানো ঘাটলার পুকুর। ভারি সুন্দর পরিবেশ। টুনুমামার অনুমামার জন্য সুন্দর একটা বাংলাঘর তৈরি করা হয়েছে। সেই ঘরেই তাঁরা থাকেন, পড়াশোনা করেন আর বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেন। নিঝুম দুপুরগুলোতে গ্রামোফোনে একটার পর একটা গান বাজান। সেই গানের টানে আর বীণাখালার টানে সুযোগ পেলেই ওই বাড়িতে চলে যাই। নতুন নতুন গান শুনে মুগ্ধ হই। আমার মিনুখালা গাইতেন। বীণাখালা তো অপূর্ব গাইতেন। তাঁর রবীন্দ্রসংগীতের ক্যাসেটও বেরিয়েছিল। একদম ছোটমামা সেন্টু বিটিভির মিউজিক ডিরেক্টর হয়েছিল। অল্প বয়সে মারা গেছেন।

ছেলেবেলা কিংবা যৌবনকালের শুরুর সময়কার যেসব গান আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে সেসব গান নিয়ে বিস্তারিত লিখলে শ’খানেক পৃষ্ঠার একটা বই লেখা যাবে। যাঁকে নিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, এবার তাঁর কথা বলি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়েছিলেন। পড়া ছেড়ে চলে এলেন গানের জগতে। কোনো ওস্তাদ ছিল না। নিজে নিজেই গান শিখতে লাগলেন। আবার একটু লেখালেখিও করতেন। দুচারটি গল্পও ছাপা হয়েছিল পত্রিকাতে। তাঁর বিখ্যাত কবিবন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায় রেডিওতে নিয়ে গেলেন হেমন্তকে। গান গাইলেন। সেই শুরু হলো তাঁর জয়যাত্রা। ভরাট মিষ্টি রোমান্টিক এক মায়াবী কণ্ঠের অধিকারী হেমন্ত গানের জগতে পা ফেলতে লাগলেন দৃঢ় ভঙ্গিতে। অল্পদিনের মধ্যেই ইতিহাস হয়ে উঠতে লাগল তাঁর একেকটি গান। বাংলা সিনেমা ও সিনেমার বাইরে তাঁর প্রায় প্রতিটি গানই জনপ্রিয়তার রেকর্ড ভাঙতে লাগল। ‘ও নদী রে’ ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’ ‘আজ দু’জনার দুটি পথ’ ‘ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস’ ‘শোনো বন্ধু শোনো’ ‘অলির কথা শুনে’ ‘তুমি এলে অনেকদিনের পরে যেনো বৃষ্টি এলো’ ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই’ ‘ছেলেবেলার গল্প শোনার দিনগুলো’ ‘জীবনপুরের পথিক রে ভাই’। হেমন্তের কত গানের কথা বলব? এক কথায় তাঁর প্রায় প্রতিটি গানই আমার পছন্দ। এখনো হেমন্তের আধুনিক, রবীন্দ্রসংগীত, হিন্দি সব গানই আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যাই। এক সময় বোম্বাইতে চলে গেলেন তিনি। হিন্দিতে তাঁর নাম হলো হেমন্ত কুমার। ’৫৬ সালে ‘নাগিন’ সিনেমার সংগীত পরিচালক হিসেবে হিন্দি সিনেমার জগৎ কাঁপিয়ে দিলেন। তাঁর সুরে, লতা মুঙ্গেশকরের কণ্ঠে ‘মেরা মান দোলে’ জনপ্রিয়তায় আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিল। ওই সিনেমায় হেমন্তের নিজের গাওয়া ‘কাশি দেখা মথুরা দেখা’ও ব্যাপক জনপ্রিয় হলো। ‘ষোলা সাল’ সিনেমায় হেমন্তের গাওয়া ‘আয় আপনা দিল তো আওয়ারা’ সেই সময়কার সবার মুখে মুখে। লতা ও আশা এই দুই বোন হেমন্তকে মাথায় তুলে রেখেছিলেন। আশা তো তাঁর ছেলের নামই রাখলেন হেমন্ত। লতাকে দিয়ে একটার পর একটা জনপ্রিয় বাংলা গান গাওয়ালেন হেমন্ত। সুর হেমন্তের, বাণী হেমন্তের প্রিয়সঙ্গী সলিল চৌধুরী। লতা বাংলা জানেন না। বাংলা গান হিন্দিতে লিখে নিতেন গাওয়ার আগে। তাঁকে বাংলা উচ্চারণ শেখাতেন হেমন্ত।

একবার এক যুবক তাঁর লেখা একটা কবিতা নিয়ে এলেন হেমন্তের কাছে। কবিতাটির তিনি সুরারোপও করেছেন। হেমন্তকে দিয়ে গাওয়াতে চান। হেমন্তের কাছে লেখার খাতাটি রেখে যুবক উধাও হয়ে গেলেন। স্বদেশি আন্দোলনের কারণে পুলিশ তাঁকে খুঁজছে। তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘের একজন কর্মী। এ যুবকটির নাম সলিল চৌধুরী। সলিল চৌধুরীর লেখা ও সুর করা সেই দীর্ঘ গানটি এক সময় গাইলেন হেমন্ত। সেই গান বাঙালি জাতিকে উদ্দীপ্ত করল- ‘কোন এক গাঁয়ের বধূ’। এক রেকর্ডের দুই পিঠে একই গান। দুই পর্বে। চোখে পানি এসে যায় শুনলে। পরে হেমন্ত নিজেও ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। কত কত জনপ্রিয় গান হেমন্ত-সলিলের। ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্র“বতারা’ হেমন্তের ভীষণ জনপ্রিয় গান। বাণী ও সুর সলিল চৌধুরী। অমিতাভ বচ্চন ও রাজেশ খান্না অভিনীত ঋষিকেশ মুখার্জির মন খারাপ করা সিনেমা ‘আনন্দ’। সংগীত পরিচালক সলিল চৌধুরী। ‘নীল ধ্র“বতারা’ গানটি তিনি হিন্দিতে এই সিনেমায় মুকেশকে দিয়ে গাওয়ালেন। ‘কাহি দূর যাব দিন ঢল যায়ে’। চেন্নাই তখন মাদ্রাজ। সলিল চৌধুরী প্লেনে করে মাদ্রাজ থেকে ফিরছেন, প্লেনটি ঝড়ের কবলে পড়ল। যাত্রীরা ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার চেঁচামেচি করছেন। সেই অবস্থায় সলিল চৌধুরীর মনে একটি গান এলো। বেঁচে ফিরলেন কলকাতায়। হেমন্তকে দিয়ে সেই গানটি গাওয়ালেন ‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা’ গানটি ইতিহাস হয়ে গেল। এ রকম কত ইতিহাস বড় বড় শিল্পীদের নিয়ে, বলে শেষ করা যবে না।

একটা সময়ে বাংলা সিনেমার পুরুষ কণ্ঠ মানেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ছবিতে একাধারে কণ্ঠ দিচ্ছেন, অন্যদিকে সংগীত পরিচালনার কাজও করছেন। আবার দেশের ক্রান্তিকালে জাতির রক্তে দোলা লাগানোর মতো গানও করছেন। ’৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় দুটো গান লিখলেন গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার। ‘মাগো ভাবনা কেন’ ও ‘এদেশের মাটির পরে অনেক জাতির অনেক দিনের লোভ আছে’ একই রেকর্ডের দুই পিঠে দুই গান। ‘মাগো ভাবনা কেন’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করল। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এ গানটি দারুণভাবে বাঙালি জাতিকে উদ্দীপ্ত করেছে। এক সময় বাংলা সিনেমা মানেই সাহিত্যনির্ভর। শক্তিপদ রাজগুরু নামে একজন লেখক ছিলেন। লেখক হিসেবে তেমন সুবিধার না। তবে এই লেখককে অমরত্ব দিয়েছেন উপমহাদেশের মহান এক চলচ্চিত্রনির্মাতা। তাঁর নাম ঋত্বিক ঘটক। শক্তিপদ রাজগুরুর ‘মেঘে ঢাকা তারা’ উপন্যাসটির চলচ্চিত্রায়ণ করেছিলেন তিনি। সুপ্রিয়া চৌধুরী খুব ভালো অভিনয় করেছিলেন এ সিনেমাতে। ঋষিকেশ মুখার্জি বাংলা ও হিন্দি দুই ভাষাতেই ‘অমানুষ’ সিনেমাটি বানিয়েছিলেন। তুমুল জনপ্রিয় এ সিনেমার গল্পটিও শক্তিপদ রাজগুরুর লেখা। ‘শাপমোচন’ সিনেমার গল্প ছিল ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের। হেমন্তের কত বিখ্যাত গান সেই সিনেমায়। ‘দীপ জ্বেলে যাই’ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের গল্প, বাংলা হিন্দি দুই ভাষাতেই সিনেমা হয়েছে। হেমন্তের ‘এই রাত তোমার আমার’ রোমান্টিক গানের এক মাইলফলক হয়ে আছে। ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ ছিল ‘অবধূত’ এর গল্প। এ সিনেমায় হেমন্ত গাইলেন এক আরাধনা সংগীত ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’। ‘স্ত্রী’ ছিল বিমল মিত্রের গল্প। সেই সিনেমায় হেমন্ত গাইলেন ‘খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার এই তোমাদের পৃথিবী’। ‘পলাতক’ ছিল মনোজ বসুর গল্প। এ সিনেমায় হেমন্ত গাইলেন ‘জীবনপুরের পথিক রে ভাই’। আমার অত্যন্ত প্রিয় লেখক সমরেশ বসু। তাঁর ‘অচিনপুরের কথকতা’ উপন্যাস সিনেমা হলো ‘বিভাস’ নামে। এ সিনেমায় উত্তমের ঠোঁটে ভীষণ রোমান্টিক একটা গান গাইলেন হেমন্ত। ‘এতদিন পরে তুমি গভীর আঁধার রাতে মোর দ্বারে আজ এলে বন্ধু, ঠিকানা কোথায় পেলে বন্ধু’। সময় সুযোগ পেলেই এই গানটা আমি শুনি। জার্মান ভাষার লেখক হারমান হাস গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে ‘সিদ্ধার্থ’ নামে উপন্যাস লিখেছিলেন। একজন ফরাসি পরিচালক ভারতের পটভূমিতে সিনেমাটি করলেন। মূল চরিত্রে অভিনয় করলেন শশী কাপুর। সংগীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বহু আগে ‘নীল আকাশের নিচে’ সিনেমাতে ‘ও নদী রে’ গানটি গেয়েছিলেন হেমন্ত। এ গানের কিছুটা অংশ ‘সিদ্ধার্থ’তেও ব্যবহার করলেন।

স্বাধীনতার পর সেই যে প্রথম ঢাকায় এলেন হেমন্ত, বিটিভিতে তাঁর গান শোনার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। আমাদের বাসায় টেলিভিশন নেই। যে বাড়িতে টিউশনি করি, সন্ধ্যাবেলা ছাত্র পড়িয়ে সেই বাড়িতে অপেক্ষা করছি টেলিভিশনে হেমন্তের গান শোনার জন্য আর তাঁকে চোখ ভরে দেখার জন্য। তিনি পর্দায় এলেন, সাদা ঝুলপকেটঅলা শার্ট পরা, কনুই পর্যন্ত হাতা গুটানো। বুকপকেটে একটা ফাউনটেন পেন। দেবদূতের মতো সৌম্য শান্ত ও ধ্যানি চেহারা। আচমকাই তাঁর গান শুরু হলো- ‘যৌবন সরসীনী রে মিলন শতদল’। রবীন্দ্রসংগীত। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনছি। এই গান শেষ হতেই অনুষ্ঠান ঘোষক জানালেন তাদের প্রচারে একটু বিঘ্ন ঘটেছে। অনুষ্ঠানটি আবার নতুন করে শুরু হবে। শুরু হলো। একের পর এক তাঁর বিখ্যাত গানগুলো গাইতে লাগলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আধুনিক গান শেষ করে গাইলেন কয়েকটি রবীন্দ্রসংগীত। সবশেষে গাইলেন ‘যৌবন সরসীনী রে’। ভুল করা শুরুতে এবং শেষে একই গান শুনেও সমান মুগ্ধ দর্শক-শ্রোতারা।

হেমন্তভক্ত একজন খুব বড় মানুষের কথা আমার মনে পড়ছে। সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। তিনি যখন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তখন এক দুপুরে স্যারের সঙ্গে প্রায় ঘণ্টাখানেক হেমন্তের গান নিয়ে কথা হয়েছিল আমার। ওরকম স্মৃতিধর মেধাবী মানুষ ও হেমন্তভক্ত এ জীবনে আমি আর দেখব না, এ আমি নিশ্চিত। আলোচনার একেবারে শেষে স্যার কবিতার মতো করে হেমন্তের একটি লাইন শুনিয়েছিলেন, ‘আমিও পথের মতো হারিয়ে যাবো, আমিও নদীর মতো আসবো না ফিরে আর, আসবো না ফিরে কোনোদিন’।

আমার কত প্রিয়বন্ধু প্রবাসে জীবন কাটাচ্ছে। মিজানুর রহমান কামালের সঙ্গে জার্মানিতে চলে গিয়েছিলাম। সে থেকে গেল, দুই বছর পর আমি ফিরে এলাম। সিনডেলফিনগেনে থাকতাম আবদুল্লাহ আল মামুনের ছোটভাই আবদুল্লাহ আল হারুনের সঙ্গে। সেই ভদ্রলোক ছিলেন শিল্পপাগল মানুষ। ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন একটি কলেজের। পরে জার্মানি প্রবাসী হন। সে দেশেই জীবনটা কাটিয়ে দিচ্ছেন। কামালও তাই। চুয়াল্লিশ বছর ধরে জার্মানিতে আছে। আবদুল্লাহ আল হারুন যেমন সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতেন আমার সঙ্গে, সিনেমা এবং গান নিয়েও করতেন। সেই ’৮০ সালে জার্মানিতে বসে কোথা থেকে কোথা থেকে বাংলা ও হিন্দি জনপ্রিয় গানের ক্যাসেট জোগাড় করতেন। অবসর সময়ে আমরা দুজন বসে বসে সেসব গান শুনতাম আর স্মৃতিচারণ করতাম। প্রতিটি গানের সঙ্গেই পেছনে ফেলে আসা জীবনের কোনো না কোনো স্মৃতি ভেসে আসে। কামালদের বাড়ি গেন্ডারিয়াতেই। বাড়িতে গ্রামোফোন ছিল। মনে আছে এক দুপুরে ওদের বাড়ির গ্রামোফোনেই শুনেছিলাম হেমন্তের ‘কত রাগিনীর ভুল ভাঙাতে’ গানটি। এখনো স্মৃতির ভিতর থেকে সেই গানের সুর ভেসে আসে। বীণাখালা বহু বছর ধরে ফ্লোরিডার ওয়েস্ট পামবিচে থাকে। কবিতা লেখে, রবীন্দ্রসংগীত গায়। লেকের ধারে ছবির মতো বাড়ি। সেই বাড়িতে সে শিল্পীর মতো জীবন কাটায়। একবার ওয়েস্ট পামবিচে গিয়ে বীণাখালার সঙ্গে অনেক দিন থেকেছিলাম। গানে গল্পে আর পেছনে ফেলে আসা দিনগুলোর মধুর স্মৃতিতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতাম। কবে কোন কিশোর বয়সে গভীর এক বৃষ্টির দুপুরে বীণাখালাদের বাড়ির দোতলার রেলিংয়ে আমি আর বীণাখালা দাঁড়িয়ে আছি। তাঁর ঘরে বসে অনুমামা রেকর্ডে বাজাচ্ছেন হেমন্তের গান। ‘আমি বন্ধুবিহীন একা, বাহিরে বাদল ঝরে, ঝরো ঝরো অবিরল ধারে’। এখনো কোনো কোনো বৃষ্টির দুপুরে এ গানটি মনে পড়ে। গভীর বর্ষার রাতে, নিঝুম হয়ে বৃষ্টি নামলে হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। স্মৃতির অনেক ভিতর থেকে ভেসে আসে হেমন্তের সেই মন খারাপ করা বিষণ্ন সুরের গানটি ‘আমি বন্ধুবিহীন একা’।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

সর্বশেষ খবর