শনিবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

সবার সুখে হাসব আমি কাঁদব সবার দুঃখে

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

সবার সুখে হাসব আমি কাঁদব সবার দুঃখে

সে অনেক দিন আগের ঘটনা। বনি ইসরাইলেরও আগের যুগের। সে সময় ছিল জাদুর প্রভাব। এখন যেমন আধুনিক প্রযুক্তির বলে মৃতপ্রায় ব্যক্তিকে সুস্থ করা যায়, তখন জাদু বা আধ্যাত্মিক ক্ষমতার বলে মৃত মানুষকেও সারিয়ে তোলা যেত। মাত্র দুই হাজার বছর আগেও হজরত ঈসা (আ.) আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতায় মৃতকে জীবিত করতে পারতেন। তো ওই সময় এক মস্তবড় বুজুর্গ ব্যক্তি ছিলেন। যার বুজুর্গির কথা ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। ওই বুজুর্গের কাছে একবার এক বিধবা এসে খুব কান্না জুড়ে দিলেন। বিধবা বললেন, ‘হে মানবদরদি আল্লাহর ওলি! আমার একমাত্র পুত্র সন্তান মারা গেছে। দয়া করে আপনি তাকে জীবিত করে দিন।’ জবাবে বুজুর্গ বললেন, ‘ওগো মা! আপনার সন্তানকে জীবিত করতে হলে আমার ওমুক গাছের পাতা প্রয়োজন।’ বিধবার চোখে-মুখে আনন্দ ফুটে উঠল। তিনি বললেন, ‘মহমতি! ওই গাছ তো প্রতি বাড়িতেই রয়েছে।’ বুজুর্গ বললেন, ‘যে বাড়িতে কোনো দুঃখ-শোক নেই এমন বাড়ির আঙিনায় জন্ম নেওয়া গাছের পাতা লাগবে আমার।’ বৃদ্ধা সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন। পাশের বাড়ি থেকে শুরু করলেন কাক্সিক্ষত গাছ খোঁজা। গিয়ে শোনেন একটু আগেই নতুন বিয়ে করা দম্পতি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। বাড়িতে শোকের ছায়া। চলে গেলেন অন্য বাড়ি। সেখানে গিয়ে  শোনেন দুরারোগ্যে ব্যাধিতে ভুগছে বাড়ির কর্তা। ডাক্তার বলে দিয়েছেন বেশি দিন বাঁচবে না। এ শোকে বাড়ির সবাই নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। এভাবে পাশের গ্রাম, শহর, নগর সব তন্ন তন্ন করে খুঁজেও দুঃখ নেই, শোক নেই এমন বাড়ি খুঁজে পেলেন না। যেখানে যান সেখানেই কোনো না কোনো দুঃখের দেখা পেয়েছেন। অন্যের দুঃখ শুনতে শুনতে নিজের ছেলে হারানোর দুঃখ ভুলে গেছেন বিধবা। এটাই চেয়েছিলেন বুজুর্গ। মৃতকে বাঁচানো নয় বরং সবার শোকের মাঝে ডুব দিয়ে নিজের শোক ভুলে যাও। এটাই ছিল তার শিক্ষা। তাই বিধবা মাকে তিনি অন্যের শোক নিয়ে খোঁজখবর করার দায়িত্ব দিয়েছেন। সোনা খাঁটি হয় আগুনে পুড়ে, মানুষের আত্মাও পরিষ্কার হয় দুঃখের আগুনে। দুঃখের মাহাত্ম্য এখানেই। তবে দুঃখ দুই রকমের হয়। একরকম দুঃখ নিজের দুঃখ। আরেকটা হলো অন্যের দুঃখ নিজের করে নেওয়া। বুজুর্গের কাছে বিধবা প্রথম এসেছিলেন নিজের দুঃখ নিয়ে। তিনি তাকে পাঠিয়েছেন অন্যের দুঃখে দুঃখী হতে। নিজের স্বার্থ হানি হলে, সম্পদ খোয়া গেলে, প্রিয়জন হারিয়ে গেলে মানুষের মনে যে দুঃখবোধ হয় সেটা আত্মাকে আরও নিচে নামিয়ে দেয়। আর অন্যের অভাব দেখে, দুর্দশা দেখে হৃদয়ে যে বেদনা জেগে ওঠে, এর ফলে আত্মায় নূর জন্মে। পয়গম্বরগণ এমন দুঃখেই কাতর ছিলেন। বিশ্বমানবের কষ্টকে অন্তর দিয়ে অনুভব করেছিলেন। দুঃখের মাহাত্ম্য নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এক জায়গায় লিখেছেন- ‘অন্যের দুঃখে দুঃখী হওয়াই আসল দুঃখ। এ দুঃখের মাঝে এক ধরনের গোপন আনন্দ লুকিয়ে থাকে। অন্যের দুঃখকে নিজের করে নেওয়ার আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এ সাধনার মাধ্যমেই মানুষ দেবতার স্তরে উঠে যায়। এ বেদনার গভীর আন্তরিকতাতেই ত্যাগের নির্বিকার প্রশান্তি এই চির ব্যথার বনেই আনন্দ-স্পর্শমণি খুঁজে পাওয়া যায়।’ দশটি টাকা হারিয়ে গেলে, প্রিয়জন মারা গেলে, ব্যবসায় লস খেলে শোকের শেষ থাকে না। সমাজের বেশির ভাগ মানুষই এ প্রকৃতির। কিন্তু বিশেষ আরেক প্রকৃতির মানুষও সমাজে দেখা যায়। পথশিশুদের জন্য তাদের মন পোড়ে। রাস্তার কুকুরের জন্য মন কাঁদে। বস্তিবাসীর দুর্দশা দেখে হৃদয় জ্বলে। এতিম ছেলেমেয়ে দেখলে চোখ ভিজে যায়। নিজের কষ্ট তাদের কাছে কষ্ট না, মানুষের কষ্টই বড়। এ শ্রেণির মানুষ কম হলেও এরাই সমাজ-সভ্যতার আত্মা।

আমরা যদি রসুলের (সা.) জীবন বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখব তিনি কখনোই নিজের কথা ভাবেননি। নবুওয়ত প্রকাশের আগে এবং পরে সবসময় তিনি অন্যের ব্যথায় ব্যথিত ছিলেন। চরম ভোগবাদী সমাজকে ত্যাগের সমাজে বদলে দিয়েছেন। যেখানে মানুষ একটি যবের দানাও ছাড়তে চাইত না, সেখানে তিনি জমি, বাড়ি এমনকি স্ত্রীও ভাগ করে দেওয়ার দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন। হ্যাঁ! হিজরতের দিকেই ইশারা করছি। ইয়ারমুকের যুদ্ধে ঘটনা আমাদের সবার জানা। মুজাহিদদের কাফেলা থেকে এক মুমূর্ষু যোদ্ধা পানি বলে চিৎকার করে উঠেছেন, সঙ্গে সঙ্গে মুখ থেকে পানির গ্লাস নামিয়ে ফেললেন আরেক মুমূর্ষু মুজাহিদ। বললেন, আমার চেয়ে ওই ভাইয়ের পানির প্রয়োজন বেশি। এভাবে সাতজন ব্যক্তি পানি বলে চিৎকার করে উঠেছে এবং সাতজনই অন্যজনের জন্য পানি পান না করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। অন্যের ব্যথাকে নিজের করে নেওয়ার শিক্ষা এমনই ছিল।

হায়! কোথায় আজ সেই ইসলাম। কোথায় আজ দরদি মুসলমান। চারদিকে শুধু আমাকে দাও, আমি খাই, আমি পাই অবস্থা। আমার ভাইয়ের প্রয়োজন আছে এমনটা কাউকে বলতে শুনি না। লোভাতুর এ মানুষগুলো জানে না, লোভ তাদের আত্মাকে কতটা কালো করে ফেলেছে। কত নিচে নামিয়ে দিয়েছে তাদের আধ্যাত্মিক জীবন। আসুন! আজ আবার নতুন করে আমরা আনসার-মুহাজিরদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করি। সবার সুখে সুখী হওয়ার, সবার দুঃখে দুঃখী হওয়ার ব্রত নেই। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন। আমিন।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর