শনিবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

লক্ষ্য ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ

অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী

লক্ষ্য ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ

‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য’ (এমডিজি) অর্জনের রোডমডেল হওয়ার পরে বাংলাদেশের বর্তমান লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যগুলো পূরণ করা। এ নিবন্ধে আমি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৩ নিয়ে বিস্তারিত  আলোচনা করব। এতে বলা হয়েছে- সব বয়সী মানুষের জন্য সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিত করা।

প্রথমবারের মতো এসডিজিতে অসংক্রামক রোগ তথা এনসিডিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়; যাতে প্রতি বছর ৪১ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু এবং বিশ্বব্যাপী মোট মৃত্যুর ৭৪ শতাংশের সমান (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)। এ অসংক্রামক রোগগুলো হওয়ার অন্যতম একটি প্রধান কারণ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার। এর ফলে হৃদরোগ, স্ট্রোক, রক্তনালির রোগ, ফুসফুসের রোগ, ক্যান্সার ও ডায়াবেটিসসহ আরও অনেক অসংক্রামক রোগ হয়। এসব রোগের প্রকোপ কমিয়ে আনতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো পারস্পরিক অংশীদারির ভিত্তিতে কীভাবে কাজ করতে পারে তার জন্য ২০১৬ সালের ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি ঢাকায় দক্ষিণ এশীয় স্পিকার সম্মেলন ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জন’ শীর্ষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের সমাপনী ভাষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসডিজির ১৭টি উদ্দেশ্য এবং ১৬৯টি লক্ষ্য পূরণে সরকারের দৃঢ় সংকল্পের কথা জানান। এ জন্য তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তামাক নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কনভেনশন এফসিটিসির (FCTC) বাস্তবায়নের কথা বলেন। একই সঙ্গে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এ  লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনটি পদক্ষেপের ওপর জোর দেন তিনি। সেগুলো হলো- স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ব্যবহার করে একটি তহবিল গঠন করা। যা দিয়ে দেশব্যাপী জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি গ্রহণ করা যায়। দ্বিতীয়ত, তামাকের ওপর বর্তমান শুল্ক কাঠামো সহজ করে একটি শক্তিশালী তামাক শুল্কনীতি গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া, যাতে দেশে তামাকজাত পণ্যের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং এ অঞ্চলের সর্বোত্তম ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারের শুল্ক আয় বৃদ্ধি করা। সর্বোপরি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নের জন্য সব ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এ জন্য এসডিজি বাস্তবায়নের অগ্রাধিকারের সঙ্গে মিল রেখে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে এফটিসিটির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা। প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার আট বছর পূর্তি হয়েছে। এখনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করতে আমাদের আরও বহু পথ পাড়ি দিতে হবে। রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর নির্দেশনার এত বছর পরেও আমরা উল্লিখিত তিনটি বিষয়ের ওপর জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে কিছুটা ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। একজন তামাকবিরোধী কর্মী হিসেবে আমার বক্তব্য হলো- স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ তহবিল গঠন হলেও এ টাকা কীভাবে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হবে এর কোনো নীতিমালা এখনো হয়নি। ফলে এ তহবিলের সুবিধা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। তামাক কর নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হয়নি। এ ছাড়া বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে পরিবর্তন আনা হয়নি। অথচ আমাদের দেশে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারকারীর সংখ্যা এবং এ-সংক্রান্ত মৃত্যু আমাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সর্বশেষ তথ্যানুয়ায়ী, বর্তমানে ৩ কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ধোঁয়াযুক্ত (সিগারেট, বিড়ি ইত্যাদি) এবং ধোঁয়াবিহীন (জর্দা, গুল, সাদাপাতা ইত্যাদি) তামাক সেবন করে (গ্যাটস ২০১৭)। দেশে প্রতি বছর তামাকজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করে প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার জন (The Tobacco Atlas- Six Addition); পঙ্গুত্ববরণ করে প্রায় ৪ লাখ মানুষ। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৪৪২ জন তামাকজনিত রোগে প্রাণ হারাচ্ছেন। The economic cost of tobacco use in Bangladesh : A health cost approach, February 2019-এ দেখা যায়, বর্তমানে দেশের ১৫ লাখের অধিক প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষ তামাক সেবনের কারণে এবং ৬১ হাজারের অধিক শিশু পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাবে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। তামাকজনিত ব্যাধি ও অকাল মৃত্যুর কারণে বাংলাদেশ প্রতিবছর ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জাতীয় আয়ের (জিডিপি) ১.৪ শতাংশ। মূলত পাবলিক প্লেস এবং পরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান (স্মোকিং জোন) সংরক্ষণের সুযোগ, বিক্রয়স্থলে তামাকপণ্য প্রদর্শন (বিজ্ঞাপনের নামান্তর), তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি (সিএসআর)-এর নামে কৌশলী বিজ্ঞাপন/প্রচারণা, খুচরা বা খোলা তামাকপণ্য বিক্রয়ের সুযোগ (যার ফলে কিশোর/তরুণদের কাছে তামাক পণ্য সহজলভ্য), আধুনিকতা ও কম ক্ষতির তকমায় ই-সিগারেট ও হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টের ব্যাপক বিস্তার, তামাক পণ্যের মোড়কের আয়তন অপেক্ষা সচিত্র সতর্কবার্তার ক্ষুদ্র আকার প্রভৃতি দুর্বলতার কারণে বিদ্যমান আইনটি তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। সম্প্রতি বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও বিষয়টি এখন থমকে আছে। কার্যকরভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য এ আইনের কিছু ধারা শক্তিশালী করা এখন সময়ের দাবি। বিশেষ করে কোনো অবস্থাতেই পাবলিক প্লেস এবং পরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান (স্মোকিং জোন) সংরক্ষণের সুযোগ না রাখা। কারণ এটি অধূমপায়ীদের স্বাস্থ্যরক্ষার সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করে। দোকানে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ, তামাক কোম্পানির সিএসআর নিষিদ্ধ, ই-সিগারেট আমদানি, উৎপাদন, বিক্রয়  ও ব্যবহার নিষিদ্ধ, তামাকজাত দ্রব্যের ওপর সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর আকার বৃদ্ধি এবং এক শলাকা বা খুচরো সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ করার জন্য আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগ, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট

সর্বশেষ খবর