সোমবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর গ্রন্থাগার ও কয়েকটি গুলিবিদ্ধ বই

এম রাশিদুজ্জামান

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর বর্বর-নির্মম আক্রমণ চালায়।  এ আক্রমণ শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আক্রমণই ছিল না, তারা পুরো জাতিকে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকলাঙ্গ করার পাঁয়তারা চালিয়েছিল। শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সভ্যতাকে পঙ্গু করার চক্রান্ত হয়েছিল। ‘বাঙালিদের লেখাপড়া শেখার দরকার নেই’- এটি ছিল ইয়াহিয়া-টিক্কা চক্রের নরপশু বাহিনীর স্লোগান। তারা এমন অবস্থা করতে চেয়েছিল যাতে ভবিষ্যতে বাঙালিরা প্যারিটি অর্থাৎ আর্থিক-রাজনৈতিক সমতার কথা আর বলবে না বরং চ্যারিটি চাইবে। তাদের কাছে দুহাত পেতে দুমুঠো খাবার ভিক্ষা চাইবে। বাংলাদেশে ইয়াহিয়া-টিক্কা চক্রের ব্যাপক গণহত্যা ও ধ্বংসের তান্ডবলীলা পরিচালনার সুপরিকল্পিত চক্রান্ত, ব্যাপক গণহত্যা ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে সম্পূর্ণ পঙ্গু করার ষড়যন্ত্র করেছিল। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে ২৫ মার্চ থেকে ৯ মাস তান্ডবলীলা চালানোর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সর্বত্র বিভিন্ন গ্রন্থাগারের বই নিয়ে বহ্নি-উৎসব শুরু করেছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে  হানাদার বাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের পর বিভিন্ন সময়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের সেই বাড়িটিতে চালানো হয় লুটপাট। বইয়ের প্রতি, লাইব্রেরির প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল সুউচ্চ। রাজনীতির সঙ্গে সাহিত্যের প্রেম না হলে জনসাধারণের ভালোবাসার উপলব্ধি হয় না। সাহিত্যের প্রতি অপার অনুরাগ থেকেই কবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে ছিল ভীষণ সখ্য, কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করে ঢাকায় ফিরিয়ে আনেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মর্যাদা সমুন্নত করে কড়া জবাব দিয়েছেন উগ্র-সাম্প্রদায়িকতাকে। আমার সোনার বাংলাকে করেছেন জাতীয় সংগীত। শুধু সাহিত্যই নয়, দেশি-বিদেশি সব আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক বইয়ের একজন একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন জাতির পিতা। জীবনের বৃহৎ অংশ কাটিয়েছেন জেলে। জেল জীবনের মুহূর্তগুলো কাটিয়েছেন বই পড়ে। ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘১৯৪৯ থেকে আব্বা যতবার জেলে গেছেন কয়েকখানা নির্দিষ্ট বই ছিল যা সব সময় আব্বার সঙ্গে থাকত। জেলখানার বই বেশির ভাগই জেল লাইব্রেরিতে দান করে দিতেন, কিন্তু আমার মা’র অনুরোধে এই বই কয়টা আব্বা কখনো দিতেন না। সঙ্গে নিয়ে আসতেন। তার মধ্যে রবীন্দ্র-রচনাবলি, শরৎচন্দ্র, নজরুলের রচনা, বার্নার্ড শর কয়েকটা বইতে সেন্সর করার সিল দেওয়া ছিল।’ মুক্তাবস্থায় বাসায় থাকাকালীন ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে বই পড়তেন। ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে পাঠরত অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর যে ছবি আমাদের নয়ন জুড়ায়, সেখানে দেখা যায় তিনি বিখ্যাত মনীষী আল বেরুনির ‘ভারততত্ত্ব’ বইখানা পাঠ করছেন। বই পড়ে শোনাতেন প্রিয় জীবনসঙ্গী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে। বইয়ের প্রতি কতটা ভালোবাসা, আর কতটা ভালো পাঠক হলে বার্টান্ড রাসেলের বই পড়ে নিজের ছেলের নাম রাখেন শেখ রাসেল! জ্ঞানচর্চা করা ও জ্ঞান সৃষ্টি করার প্রধানতম উপযুক্ত বিষয়টি হলো বই পড়া। বই পড়ার ফলে মানব শরীরে দুটি চক্ষের পরিবর্তে চতুর্মুখী চক্ষের সৃষ্টি হয়। দেখতে পায় অতীত-আগামীকে। আর একজন ভালো পাঠক অর্থই একজন দার্শনিক। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের দ্বারা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি আক্রমণের শিকার হয় এবং সপরিবারে জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর ঘাতকরা বাড়িটিতে পুনরায় লুটপাট চালায় এবং দীর্ঘ সময় বাড়িটি সিলগালা করে রাখে। এ সময়ও বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এলে, অনুমতি সাপেক্ষে বাড়িটিতে প্রবেশ করেন। বাড়িটিতে প্রবেশের পর চারদিক থেকে ডুকরে কাঁদার গোঙানো যেন সমস্ত হৃদয়কে চুরমার করে দিচ্ছিল। গ্রন্থাগারটির দরজা খুলতেই নিঃশব্দে থাকা হাজার হাজার শব্দ সশব্দে চিৎকার করে নির্মমতার কথা জানান দিল। এলোমেলো ও বিচ্ছিন্নভাবে ছিটিয়ে থাকা বইগুলোর করা প্রতিটি প্রশ্ন নিরুত্তর থেকে ছিল সেই দিন। গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত কোরআন, বাইবেল-গীতাসহ সমস্ত ধর্মীয় গ্রন্থগুলো অশ্রুজলে প্রার্থনায় সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ হাঁকিতে ছিল। বইয়ের শেলফগুলো বুলেটের আঘাতে বিচূর্ণ হয়ে প্রতিটা হত্যাকারীর প্রতিচ্ছবি তুলে ধরছিল। একটি গ্রন্থাগারে নারকীয় তান্ডব দেখে সহজেই অনুমান করা যায় সেদিনে বীভৎসতা নিয়ে। প্রশ্ন তোলা যায় তান্ডবকারীদের শিষ্টাচার ও শিক্ষা নিয়ে। বঙ্গবন্ধু লাইব্রেরির যে চেয়ারে বসতেন তার ঠিক পেছনের শেলফটি বন্দুকের বুলেটে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। শেলভে লাগানো কাচের গ্লাসগুলো পরবর্তীতে কষটেপ দিয়ে জোড়া লাগানো হয়েছে। টেবিলের পাশের শেলফটির গ্লাস দুটির মধ্যে একটিতে গুলি লেগে ছিদ্র হয়ে বেরিয়ে গেছে। চৌচির গ্লাসটি সাক্ষ্য দিতে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। অপর গ্লাসটি খোলে পড়ে গিয়েছিল হয়তো, আবার কেউ হয়তো মমতা করে স্কচটেপ দিয়ে জোড়া লাগিয়ে দিয়েছে। অথচ এই লাইব্রেরি কক্ষটিতে বসেই ২৫ মার্চে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা লিখেছিলেন।

১৫ আগস্টে হত্যাকান্ড পরিচালনাকারী ও লুণ্ঠনকারীদের হিংস্রতা নারকীয়তাকেও হার মানিয়েছিল। তাদের ছোড়া বুলেট বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের সবার বুক ঝাঁজরা করেছিল। ঝাঁজরা করে দিয়েছিল গ্রন্থাগারের সংরক্ষিত বইগুলোকেও।  খান ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত হুমায়ূন আহমেদের ‘তোমাদের জন্য ভালবাসা’ গ্রন্থটির বুকের ভিতর বুলেট আজও ভালোবাসার রক্ত বাঙালির হৃদয়কে স্পর্শ করছে। মমতাজ মতিন নীরার ‘শ্রদ্ধাঞ্জলী কাজী নজরুল ইসলাম’ গ্রন্থটিতে কবি নজরুলের বুকে আঘাত করে যেন অসাম্প্রদায়িক এই বাংলাকেই হত্যা করেছে।

শ্রী ভুপেশ সেনগুপ্তের শিশু উপন্যাস ‘উড়োজাহাজে কয়েদী’ গ্রন্থটির গায়ের বুলেটটি শিশুদের কচি হৃদয়ের লালিত বাসনাকেই হত্যা করেছে। এ ছাড়াও সেদিনের ছোড়া বুলেট এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে জাদব চক্রবর্তীর ‘এরিথম্যাটিক ফর দ্য স্কুল অ্যান্ড কলেজ’, ডন মরগানের ‘ডিরেক্ট ফ্রম ইংল্যান্ড : দ্য গ্রেট নিউ গাইড টু প্লেয়িং গিটার’ অধ্যাপক এল  মুখার্জির ‘হিস্টরি অব ইন্ডিয়া’ এবং ভøাদিমির ইলিচ লেলিনের ‘কালেকটেড ওয়ার্ক, ভলিয়ম-৪৫’ গ্রন্থগুলো।

লেখক : উপ-গ্রন্থাগারিক, ঢাবি

সর্বশেষ খবর