মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

বিদেশে অর্থ পাচারকারীরা জাতীয় দুশমন

ড. মইনুল ইসলাম

বিদেশে অর্থ পাচারকারীরা জাতীয় দুশমন

দুই বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মক সংকটে নিমজ্জমান। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বিপজ্জনক পতনের ধারা, টাকার হিসাবে ডলারের অব্যাহত দাম বৃদ্ধি, প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্স প্রেরণে গেড়ে বসা হুন্ডি ব্যবসার ক্রমবর্ধমান প্রভাবে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহে পতনের ধারা, মারাত্মক ডলার সংকটের কারণে আমদানি এলসি খুলতে অপারগতা, কার্ব মার্কেটে হু হু করে ডলারের দাম বেড়ে ২০২১ সালের ৮৭ টাকা থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ১২৫ টাকায় উল্লম্ফন, বাংলাদেশি টাকার বৈদেশিক মানের প্রায় ৩০ শতাংশ অবচয়ন, আমদানিতে ওভার-ইনভয়েসিং ও রপ্তানিতে আন্ডার-ইনভয়েসিং পদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে ব্যাপক পুঁজি পাচার, হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে ক্রমবর্ধমান ব্যাংক ঋণ পাচার, খেলাপি ব্যাংক ঋণ সমস্যার বিপজ্জনক অবনতি, রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না এনে সেগুলো দিয়ে বিদেশে ঘরবাড়ি-ব্যবসাপাতি ক্রয়, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে লাগামহীন মূল্যস্ফীতির প্রকোপ, দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন সম্পর্কে সরকারের অব্যাহত নিষ্ক্রিয়তা, দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে চার বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে মারাত্মক ঘাটতি পরিস্থিতি, ব্যালান্স অব পেমেন্টসের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে বহুদিন পর সৃষ্ট বিপজ্জনক ঘাটতি পরিস্থিতি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং ২০২৩ সালে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি স্তিমিত হওয়ার লক্ষণ। আরেকটু বিস্তৃতভাবে কয়েকটি সংকটের বর্তমান ভয়াবহতা দেখুন :

আইএমএফের নিয়ম অনুযায়ী ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ‘গ্রস রিজার্ভ’ ২০.৪০ বিলিয়ন ডলার এবং নিট রিজার্ভ ১৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্রুত পতনের যে ধারা আমাদের অর্থনীতিকে চরম টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে গেছে তা সামাল দিতে পারছে না সরকার।

২০২১ সালের আগস্টে দেশে ১ ডলারের দাম ছিল ৮৭ টাকা। গত দুই বছরে ডলারের দাম হু হু করে বেড়ে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত বাজারে ১ ডলারের দাম দাঁড়ায় ১১৪.৫০ টাকা। কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম এখন ১২৫-১২৭ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে। এর মানে, এই দুই বছরে টাকার বৈদেশিক মান কমপক্ষে ৩০ শতাংশ অবচয়নের শিকার হয়েছে।

কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গত দেড় বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের পতন থামানোর চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি, কারণ হুন্ডি ব্যবসা চাঙা হওয়ায় ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। গত আগস্টে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স আগের বছরের আগস্টের চেয়ে ২১ শতাংশ কমে গেছে, সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে ১৩৪.৩৬ কোটি ডলার, যা গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। অবশ্য ২০২৩ সালের নভেম্বরে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স বেড়ে ১৯৩ কোটি ডলার এবং ডিসেম্বরে ১৯৯ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।

কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে আমদানিকারকরা এলসি খুলতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেক আমদানিকারক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে ১১৭-১১৮ টাকায় ডলার কিনে এলসি খুলছেন বলে পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। আমদানির ওভার-ইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডার-ইনভয়েসিং, রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনা এবং হুন্ডি পদ্ধতিতে ব্যাংক ঋণ বিদেশে পাচার-এই চারটি প্রধান অর্থ পাচার প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সংখ্যায় এসব পুঁজি পাচারকারী কয়েক হাজারের বেশি হবে না। দুর্নীতিবাজ সিভিল আমলা, প্রকৌশলী, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক, বিত্তবান ব্যবসায়ী কিংবা মার্জিনখোর রাজনীতিবিদ হিসেবে বাংলাদেশের সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত, উচ্চ-বিত্তশালী ও ‘এলিট’ অংশে তাদের অবস্থান। আমি তাদের ‘জাতীয় দুশমন’ অভিহিত করছি। তারা দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমকে অপব্যবহার করে ব্যাংক ঋণ নিয়ে তা বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করে চলেছে। তারা ব্যাংকগুলোর ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হিসেবে ঋণ-লুটপাটকারীর ভূমিকা পালন করছে। তারা রাজনীতিক পরিচয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী। তারা ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ‘এক নম্বর সমস্যা’ দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে অর্থবিত্তের মালিক হয়ে তাদের অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচার করে কানাডার টরন্টোয় ‘বেগমপাড়া’, অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ফ্রেটারনিটি এবং মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম বানাচ্ছে।

আমাদের মূল্যস্ফীতির হার সরকারের দাবি মোতাবেকই এখনো ৯.৬ শতাংশে রয়ে গেছে! সাধারণ ক্রেতাদের জীবনকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দামস্ফীতির লাগামহীন পাগলা ঘোড়া যেভাবে অসহনীয় করে তুলেছে তাদের অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেবে যে প্রকৃতপক্ষে মূল্যস্ফীতির হার আরও অনেক বেশি!! ভারত ও শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশে মূল্যস্ফীতি এখন নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে, অথচ বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতিকে দক্ষ হাতে নিয়ন্ত্রণের কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না।

২০২১ সালে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছি। তখন প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ সূচক বিশ্বকে জানান দিয়ে চলেছিল যে বাংলাদেশ একটি আত্মনির্ভরশীল এবং দ্রুত-বর্ধনশীল অর্থনীতিতে পরিণত হতে চলেছে। কিন্তু ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিপজ্জনক সংকটে নিমজ্জমান। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ২০.৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এহেন পতনের ধারা অত্যন্ত বিপজ্জনক। রিজার্ভের পতনের এ ধারাকে আমি ২০২২ সালের এপ্রিলে বিপজ্জনক আখ্যায়িত করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ইঙ্গিত করে ‘অর্বাচীন অর্থনীতিবিদ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এখন প্রমাণিত হয়ে গেছে আসলে কারা ‘অর্বাচীন’। ২০২২ সালের মে মাসে জার্মান টিভি ডয়েচে ভেলে আমাকে এ-ব্যাপারে মন্তব্য করতে বলায় আমি বলেছিলাম, ‘‘২০১২ সালে যখন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বাতিল করেছিল তখন বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আমিই প্রথম তাঁকে সমর্থন জানিয়েছিলাম নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য। আবার, তাঁর হাত থেকেই আমি ‘একুশে পদক’ নিয়েছি। এখন তিনি আমাকে অর্বাচীন অর্থনীতিবিদ বলছেন! তা তিনি বলতেই পারেন, কিন্তু আমি আমার অবস্থান বদলাব না।” আমার এই সাবধান বাণীকে আমলে না নেওয়ার ফলে এখন যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্রুত পতনের ধারা আমাদের অর্থনীতিকে চরম টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে গেছে তা সামাল দিতে পারছে না সরকার। ইতোমধ্যে দেশের আমদানি নিয়ন্ত্রণের নানাবিধ ব্যবস্থা গৃহীত হওয়ায় ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ১৬ মাসে এলসি খোলা ১৬ শতাংশ কমে এসেছে, কিন্তু হুন্ডি ব্যবস্থায় রেমিট্যান্স প্রেরণকে কোনোমতেই নিরুৎসাহিত করা যাচ্ছে না। হুন্ডি ব্যবসার রমরমা অবস্থা দিন দিন বাড়তে থাকার প্রধান কারণ আন্তব্যাংক লেনদেনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ডলারের দামের সঙ্গে কার্ব মার্কেটের ডলারের দামের পার্থক্য ৭-৮ টাকায় স্থির থাকা। এ পার্থক্য বজায় থাকলে ডলারের দামের ক্রম-বাজারীকরণের সিদ্ধান্ত তেমন সুফল দেবে না, হুন্ডি ব্যবসা চাঙাই থেকে যাবে শক্তিশালী চাহিদার কারণে। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর চাহিদা এবং সরবরাহ উভয় দিক থেকে হুন্ডি ব্যবসা অনেকখানি গুটিয়ে গিয়েছিল, যার সুফল হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্সের উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জনে সমর্থ হয়েছিল। এ প্রবৃদ্ধির কারণেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত বেড়ে গিয়ে ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল। (অবশ্য আইএমএফের হিসাব মোতাবেক রিজার্ভ ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলার)। ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধে যখন করোনাভাইরাস মহামারির তান্ডব কমে আসে তখন আবার চাঙা হয়ে ওঠে হুন্ডি ব্যবসা। প্রত্যেক বছর এখন কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। এর মানে, বাংলাদেশ থেকে বছরে কমপক্ষে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি এখন বিদেশে পাচার হয়ে চলেছে (অথবা ডলার দেশে আসছে না), যার অর্ধেকের মতো পাচার হচ্ছে হুন্ডি প্রক্রিয়ার লাগামহীন বিস্তারের মাধ্যমে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্স গত ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১.৬১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যার প্রধান কারণ হুন্ডি প্রক্রিয়ায় রেমিট্যান্স প্রেরণ আবার চাঙা হওয়া।

২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল নির্ধারিত ‘উন্নয়নশীল দেশের’ ক্যাটাগরিতে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ওই প্রক্রিয়ার সফল পরিসমাপ্তির পর ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে। এর আগে ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের ‘নিম্ন আয়ের দেশ’ ক্যাটাগরি থেকে বাংলাদেশ ‘নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের ক্যাটাগরিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৫.৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮.১৩ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। করোনাভাইরাস মহামারির আঘাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৩.৮ শতাংশে নেমে গেলেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই ২০১৯ অর্থবছরের ১৯০৯ ডলার থেকে বেড়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন তারিখে ২৭৬৫ ডলারে পৌঁছেছে বলে সরকার দাবি করছে। আইএমএফের প্রাক্কলন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর চেয়ে কম হলেও তারা বলেছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশ একটি মাইলফলকে পৌঁছেছে। ২০২০ সালের অক্টোবরে আইএমএফ তাদের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে দাবি করেছে, করোনাভাইরাস মহামারির আঘাতে ভারতীয় অর্থনীতি ১০.৩ শতাংশ সংকুচিত হয়ে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ২০১৯ সালের ২১০০ ডলার থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ১৮৭৭ ডলারে নেমে গেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতি মহামারির ক্ষতি দ্রুত কাটিয়ে উঠে বাংলাদেশ ৩.৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করার ফলে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ১৮৮৮ ডলারে পৌঁছেছে। এর মানে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু নমিনাল জিডিপি ভারতের মাথাপিছু জিডিপিকে ছাড়িয়ে গেছে। মাথাপিছু জিডিপির বিচারে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে বহু আগেই ছাড়িয়ে গেছে, ২০২০ সালে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেল। ২৪ বছরের ঔপনিবেশিক শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্যের শিকার হওয়ায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি পশ্চিম পাকিস্তানের চাইতে ৭০ শতাংশ কম ছিল। অথচ ২০১৫ সালেই মাথাপিছু জিডিপির বিচারে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের তুলনাটা দেখুন :

মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের তুলনায় ৬৫ শতাংশ এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের রপ্তানি আয় পাকিস্তানের দ্বিগুণেরও বেশি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ৫৫.৫৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আইএমএফের হিসাব-পদ্ধতি মোতাবেক ২০.৪০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ালেও সেটা পাকিস্তানের ছয় গুণেরও বেশি। বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু ৭৩ বছর, পাকিস্তানের ৬৬ বছর। বাংলাদেশের জনগণের সাক্ষরতার হার ৭৬ শতাংশ, আর পাকিস্তানের ৫৯ শতাংশ। বাংলাদেশের মোট জিডিপি ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার, আর পাকিস্তানের ৩৪৬ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.১২ শতাংশ, আর পাকিস্তানের ২.১ শতাংশ। ফলে পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেড়ে ২০২২ সালে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ২৩ কোটিতে, আর বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। বাংলাদেশে ১১০-১১৫ টাকায় ১ ডলার পাওয়া যায়, পাকিস্তানে  ১ ডলার কিনতে ২৯০ রুপি লাগে। অথচ ২০০৭ সাল পর্যন্ত রুপির বৈদেশিক মান টাকার তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি ছিল। বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণ জিডিপির ২৩ শতাংশ, অথচ পাকিস্তানে তা জিডিপির ৪৬ শতাংশ।

বাংলাদেশের নারীদের ৪১ শতাংশ বাড়ির আঙিনার বাইরে কর্মরত, পাকিস্তানে এই অনুপাত মাত্র ১৪ শতাংশ। বাংলাদেশের শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ২১, আর পাকিস্তানের ৫৯। বাংলাদেশের শতভাগ জনগণ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে, অথচ পাকিস্তানের ৭৩ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে।

ওপরের তথ্য-উপাত্তগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে, পাকিস্তান অর্থনৈতিক উন্নয়নের দৌড়ে আর কখনই বাংলাদেশের নাগাল পাবে না ইনশাআল্লাহ। তথ্য-উপাত্তগুলো সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে চলেছে যে, ১৯৪৭-৭১ পর্যায়ে বাংলাদেশ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে সীমাহীন বঞ্চনা, শোষণ ও পুঁজি-লুণ্ঠনের শিকার হওয়ায় ওপরের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে পাঞ্জাবের চেয়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান পিছিয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পেরেছিলাম বলেই এখন পাকিস্তানকে সব ক্ষেত্রে পেছনে ফেলে দিয়েছি। কিন্তু মাথাপিছু জিডিপি যেহেতু একটি গড় সূচক তাই মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যদি দেশে আয়বণ্টনে বৈষম্যও বাড়তে থাকে তাহলে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্সা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। অর্থনীতিতে আয় বৈষম্য বৃদ্ধি বা হ্রাস পরিমাপ করার জন্য জিনি সহগ সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত পরিমাপক। কোনো অর্থনীতির জিনি সহগ যখন বেড়ে ০.৫-এর কাছাকাছি পৌঁছে যায় বা ০.৫ অতিক্রম করে তখন ওই দেশকে উচ্চ আয় বৈষম্যের দেশ অভিহিত করা হয়। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের জিনি সহগ ছিল মাত্র ০.৩২, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ মোতাবেক সেটা বেড়ে ০.৪৯৯-এ পৌঁছে গেছে। ধনাঢ্য ও উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠীগুলোর দখলে জিডিপির ক্রমবর্ধমান অংশ পুঞ্জীভবনের ফল কী হতে পারে তা নাটকীয়ভাবে ধরা পড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’-এর প্রতিবেদনে। ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ এই পাঁচ বছরে অতি-ধনীর সংখ্যা-বৃদ্ধির বিচারে বাংলাদেশ বিশ্ব-চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছে। ওই পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ৩০ মিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদের মালিক অতি-ধনীর সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭.৩ শতাংশ হারে। দেশের আয় এবং সম্পদের এহেন পুঞ্জীভবন বাংলাদেশের রাজনীতিকে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ নিকৃষ্ট নজির হিসেবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতির মধ্যে ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র পুনঃস্থাপিত হয়েছে। ২০১১ সালে সংসদে পাস হওয়া সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন মহাজোট সে রায়কে সংবিধানে ফিরিয়ে আনলেও সরকার এখনো ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির’ অহিফেনের মৌতাতে মেতে রয়েছে। ২০০১-২০০৫-ওই পাঁচ বছরে পাঁচবার বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্ব-চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করেছিল, এবার বিশ্ব-চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করল ধনকুবেরের সংখ্যা-বৃদ্ধির দৌড়ে। এসব ‘রবার ব্যারন’ সৃষ্টির জন্য কি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলাম আমরা? একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আয় বৈষম্য এভাবে বাড়তেই পারে না, যদি শাসকরা সমাজতন্ত্রকে ‘বাৎ কা বাত’ বানিয়ে না ফেলে! এসব ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছেই দেশের খেলাপি ব্যাংক ঋণের ৮০ শতাংশেরও বেশি আটকে রয়েছে এবং খেলাপি ঋণের সিংহভাগ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ২০২৩ সালের দুর্নীতির র‌্যাঙ্কিং অনুযায়ী বাংলাদেশ আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের র‌্যাঙ্কিং অনুসারে ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান খারাপের দিক থেকে ১০ নম্বরে। এখনো এ দেশের জনগণের জীবনের সবচেয়ে বেশি দুর্দশা, যাতনা ও হয়রানি ঘটিয়ে চলেছে সর্বব্যাপ্ত দুর্নীতি। ২০১৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করেছিল, কিন্তু গত পাঁচ বছরে সরকার এই অঙ্গীকার পূরণকে ‘বাৎ কা বাতে’ পর্যবসিত করেছে। হুন্ডি ডলারের চাহিদার দিক বিবেচনা করলে হুন্ডি প্রক্রিয়ায় বিদেশে পুঁজি পাচারের সঙ্গে দুর্নীতির ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকারভাবে কঠোর না হলে পুঁজি পাচার দমন করা অসম্ভব। পুঁজি পাচার দমন না করলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন থামানো যাবে না।

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি আরেকটি একতরফা নির্বাচন হয়ে গেল। ২০১৪ সালের নির্বাচনটিও একতরফা নির্বাচন ছিল, কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণমূলক হওয়া সত্ত্বেও নির্বাচনের আগের রাতে পুলিশ ও প্রশাসনের সক্রিয় অংশগ্রহণে ক্ষমতাসীন দল দেশের অধিকাংশ স্থানে ব্যালটে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলার মাধ্যমে নির্বাচনটিকে প্রহসনে পরিণত করেছিল। ফলে সংসদের তিন-চতুর্থাংশের বেশি আসন ক্ষমতাসীন জোটের দখলে চলে যাওয়ার পাশাপাশি বিরোধী দলসমূহের ৯৬ শতাংশ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ক্ষমতাসীন দল এই অভূতপূর্ব কারচুপির মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়েছিল যে ক্ষমতাসীন দলকে সরকারে রেখে এ দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।

এবারের নির্বাচনটা আবারও ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে হওয়ায় বিএনপিসহ দেশের প্রধান বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বয়কট করেছে। এবারের নির্বাচনে ভোট সম্পন্ন হয়ে ফলাফল ঘোষিত ২৯৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসনে জয়ী হয়েছে। কিন্তু ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী যারা জয়ী হয়েছেন তাঁদের মধ্যে ছয়জন ছাড়া ৫৬ জন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী হওয়ায় ২৭৯টি আসনে আওয়ামী লীগই বিজয়ী হয়েছে বলা চলে। (জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ এবং কল্যাণ পার্টির বিজয়ী প্রার্থীরাও আওয়ামী লীগ-সমর্থিত)। নির্বাচনের দিন বিকাল ৩টায় নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছিল তখন পর্যন্ত ২৭.১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে, যেটাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। ভোটের পর এখন তারা বলছে, নির্বাচনে ৪১.৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। শেষের ১ ঘণ্টায় ১৪.৮৪ শতাংশ বৈধ ভোট পড়ার বিষয়টি একেবারেই অবিশ্বাস্য! লাইনচ্যুত গণতন্ত্রকে আবার ফিরিয়ে আনা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

 

লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর,

অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর