বুধবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

বিচারক ও বিচারব্যবস্থা

অধ্যাপক জীবেন রায়

বিচারক ও বিচারব্যবস্থা

ছোটবেলায় আমার প্রথম সিনেমা দেখা মায়ের সঙ্গে বসে ‘সবার উপরে’। কিশোরগঞ্জ শহরে রংমহল হলে। উত্তম-সুচিত্রা জুটির দারুণ ইমোশনাল সিনেমা। ‘সবার উপরে’ সিনেমাতে কোর্টে উকিলদের সওয়াল-জওয়াব এবং বিচারকের ভূমিকার কথা অনেকেরই হয়তো মনে আছে। ছবি বিশ্বাসকে (প্রশান্ত চৌধুরী) ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মামলা করে ১২ বছর জেল খাটতে হয়েছে এবং তার ছেলে, শঙ্কর উকিল হয়ে খালাস করিয়ে নেন। বলার অপেক্ষা রাখে না বিচার ও বিচারব্যবস্থা একটি দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সাম্প্রতিককালে শিবপ্রসাদ ও নন্দিতা রায়ের ‘পোস্ত’ মুভিতে কোর্টে মনস্তাত্ত্বিক ইসুকে কেন্দ্র করে মজা করে উকিল যুদ্ধ দেখানো হয়েছে এবং সেই সঙ্গে বিচারকের ভূমিকাও অত্যন্ত যুক্তিশীল দেখানো হয়েছে।  হইচই টিভি সিরিজে বাংলাদেশের গল্প নিয়ে ‘মোবারকনামা’য় অভিনেতা মোশারফ করিমের প্রাণবন্ত এবং যৌক্তিক ওকালতিতে ধর্ষণকারীর শাস্তি হয়।

একটি দেশের ইথিক্যাল জীবনযাপন করার প্রধানতম মানদন্ড হলো সে দেশের বিচারিক ব্যবস্থা। দেশের সব মানুষই শুদ্ধতম মানুষ হবে- তেমন নয়। কাজেই দুষ্টলোক, ষড়যন্ত্রকারী, দুর্নীতিবাজ, ধান্ধাবাজদের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচানোর জন্য পক্ষপাতদুষ্টহীন সঠিক বিচারব্যবস্থা থাকতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সাল থেকে পরিবার নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছি। তার আগে ১৯৮০ সালে প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে পা রেখেছিলাম। ১৯৮৪ সালে এক বছর বসবাসও করেছি। ডেমোক্র্যাট, রিপাবলিকান দুই শাসনামলেই থেকেছি এবং থাকছি। আর ১৯৬৪-’৬৫ সাল থেকে দেশ-বিদেশের খবরাখবর পড়া এবং জানা আমার এক ধরনের নেশা। প্রায় তিন দশক ধরে টাইম ম্যাগাজিন পড়ে আসছি।

আমার অভিজ্ঞতার আলোকে আমি বলতে চাই, আমেরিকান বিচারিক ব্যবস্থা সারা বিশ্বের মধ্যে অদ্বিতীয়। এই বিচারব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এফবিআই, সিআইএ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, অ্যাটর্নি, ব্যারিস্টার এবং সর্বোপরি বিচারকগণ। প্রায় এক দশক আগের কথা। আমি ও আমার বড় মেয়ে খৃত্বিকা আলাদা আলাদা গাড়ি করে জ্যাকসন (মিসিপির রাজধানী) থেকে আমাদের বাড়ি কলম্বাসে আসছিলাম। তখন ছিল বিকাল বেলা। খৃত্বিকা এই প্রথম হাইওয়েতে আড়াই ঘণ্টা ড্রাইভ করছিল। তাই ওকে সামনে দিয়ে আমি পেছনে। ১০ মাইল চলার পর ট্রাফিক পুলিশ খৃত্বিকার গাড়ির পেছন নিল। গাড়ি রাস্তার ডান পাশে থামাল। আমি তখন খুব ধীর গতিতে পুলিশের গাড়ি পার হয়ে মেয়ের পেছনে থামলাম। এবং পুলিশ আমাদের দুজনকেই টিকিট দিল। কারণটা হলো, আমরা ‘মুভ ওভার ল’ মেনে চলিনি। আমি তখন জানতাম না এরকম একটা ল সম্প্রতি চালু হয়েছে। না জানাটা আমাদের দোষ, পুলিশের নয়। যাই হোক গাড়ি চালিয়ে বাড়ি চলে এলাম। এক সপ্তাহের মধ্যেই চিঠি পেলাম। সাড়ে তিন শ করে দুজনের সাত শত ডলার পেনাল্টি। দিয়ে দাও অথবা কোর্টে গিয়ে ফাইট কর। অবশ্য আমাদের নির্দিষ্ট দিনে বিচারকের কাছে হাজিরা দিয়ে বলতে হবে আমরা কী করতে চাই। আমরা যদি গিল্টি না বলি তখন কোর্টে ফাইট করতে হবে। আর যদি গিল্টি বলি তাহলে বিচারক পেনাল্টির বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন। সঠিক দিনে দুজনেই হাজির হলাম। আমাদের আগে প্রায় এক ডজন নানাবিধ কেস একের পর এক চলছে আর বিচারক তাৎক্ষণিক রায় দিয়ে দিচ্ছেন। একটি উদাহরণ দেই। এক ছেলে ১০০ মাইল স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছিল, তারপর দেখা গেল সে অবৈধভাবে বসবাস করছে। বিচারক তাকে জেলে পাঠিয়ে দিল। এক সময় আমাদের ডাক এলো। আমরা দুজনেই একসঙ্গে এবং খৃত্বিকা আগে আমি পেছনে। বিচারক খৃত্বিকাকে জিজ্ঞেস করল, “ডু ইউ প্লিড গিল্টি”? ও বললো “ইয়েস, গিল্টি”। বিচারক বলল “ওকে, ইউ গো টু দি ক্লার্ক”। আমাকেও তাই জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম, “ইউর অনার, আই এম গিল্টি বাট আই ডিড সেøা ডাউন দি কার”। বিচারক বলল, “ইউ কুড হ্যাভ গন টু দি আদার লেইন। পুলিশ মেনশান্ড দ্যাট নো কার অয়ার দেয়ার ইন দ্যাট লেইন”। কথাটা অবশ্য সত্যি। আমিও ক্লার্কের কাছে গেলাম। শেষ পর্যন্ত দুজনে মিলে ৩০০ ডলার ফাইন এবং একটা ডিফেন্সিভ কোর্স নিলে রেকর্ডে থাকবে না। তথৈইবচ। ছোট্ট একটা অভিজ্ঞতা তো হলো। এবার আসছি আসল কথায়।

‘প্রতিদিন’ এর পাঠকবৃন্দ, আপনাদের হয়তো মনে আছে, ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে একটা বিভীষিকাময় ঘটনা ঘটেছিল। কয়েক হাজার ট্রাম্প সাপোর্টার ক্যাপিটল বিল্ডিং তচনচ করে দেয়। পুলিশসহ পাঁচজনের প্রাণহানি হয় এবং প্রায় ২৯ লাখ ডলারের ক্ষতি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি অফিসের তথ্য অনুযায়ী এ পর্যন্ত ১২৬৫ জনকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। অর্ধেকের বেশি গিল্টি প্লিড করেছে এবং বিভিন্ন ধরনের সাজা হয়েছে এ পর্যন্ত ৭৪৫ জনের মতো। আর ট্রাম্পেরও ট্রায়াল চলছে। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বলে কোনো মাফ নেই। অন্য একটা কেসে তাকে মাগশট (যা চোর, ডাকাত অর্থাৎ ক্রিমিনালরা দিয়ে থাকে) দিতে হয়েছে। আবার এই মাগশটের কল্যাণে সাত মিলিয়ন ডলারের বেশি ফান্ড রাইজ করেছে ট্রাম্প। এত কিছুর পরও, মনে হচ্ছে ইলেকশন তিনি করতে পারবেন। আবার জয়ের সম্ভাবনাও রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে দুর্নীতি যে হয় না তেমন নয়। তুলনামূলক খুবই কম। তবে বিচার বিভাগ থেকে রক্ষা নাই। সিনেটর হোক আর কংগ্রেসম্যান হোক, ধরা পড়লে বিচার হবেই। খুন করে এ দেশে বেঁচে থাকা খুবই কঠিন। ৩০-৪০ বছর পরে হলেও হঠাৎ ধরা পড়ে যায়। আবার বিচারে কারাদন্ড হওয়ার পরে নতুন করে এভিডেন্সের ভিত্তিতে বিশেষ করে ডিএনএ টেস্টিংয়ের মাধ্যমে খালাসও পেয়ে যায়। তারপর বিরাট অঙ্কের টাকাও পায়।

বিচার বিভাগে পলিটিক্স যে কাজ করে না, তেমনটি নয়। এখন সুপ্রিম কোর্টে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট কর্তৃক মনোনীত বিচারকের সংখ্যা বেশি। তাই আগের গর্ভপাত আইনটির পরিবর্তন করা হয়েছে। আবার সব স্টেট যে মানবে, তেমন নয়। কোনো স্টেট আছে কোনো অবস্থাতেও গর্ভপাত করা যাবে না। তাদের গর্ভপাত করানোর জন্য অন্য স্টেটে চলে যেতে হয় যেখানে নিষেধাজ্ঞা নেই। খবরাখবর পড়ে মনে হয় বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা অনেকটাই নাকি রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট। ক্ষমতাসীন দলের এমপি দুর্নীতি করে পার পেয়ে যায়। একই দুর্নীতি করে বিরোধী দলের লোকজনকে জেলে যেতে হয়। আবার সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, জায়গাজমি ষড়যন্ত্র করে দখল করে নেয়- তাতে মামলা-মোকদ্দমাতেও কাজ হয় না। মজার ব্যাপার এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন বা অক্ষমতাসীন প্রয়োজন হয় না।

সত্যিকথা বলতে কী বাংলাদেশে গরিবমাত্রই সংখ্যালঘু। জনসংখ্যার প্রায় ২১% জনগোষ্ঠী গরিব। এই গোষ্ঠী কোনো বিচার আশা করতে পারে কি? উকিল নিয়োগ করার টাকাইবা পাবে কোথায়? সরকারের কাছে আবেদন এই ২১% জনগোষ্ঠীর জন্য বিনা খরছে পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে বিচার চাইতে পারে কি না? ঘরহীনকে যেমন প্রধানমন্ত্রী ঘর দেন, তেমনি এদেরও প্রয়োজনে বিচারিক ব্যবস্থা করে দিতে পারলে একটা দারুণ জনসেবামূলক কাজ হবে।

অতি সম্প্রতি একটি পত্রিকায় অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী রেহমান সোবাহান একটি লেখা লিখেছেন আমাদের নোবেল লরেট ইউনূস সাহেবকে নিয়ে। লেখাটিতে অনেক যৌক্তিকতা আছে। তবে প্রশ্ন জাগতেই পারে বিচারের রায়টা পক্ষপাতদুষ্ট নয়তো? অবশ্য আইনের চোখে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং নোবেল লরেট অথবা আবদুল- সবই সমান। বিভিন্ন দেশে প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীদের কারাদন্ড হতে দেখা গেছে তবে নোবেল লরেটদের তেমন দৃষ্টান্ত নেই। একমাত্র ২০২৩ সালের প্রথমদিকে বেলারুশিয়ান কোর্ট সে দেশের শান্তিতে নোবেল লরেট, এলেস বিয়ালিয়েটস্কিকে ১০ বছরের জন্য কারাদন্ড দিয়েছে।  ২০২৪ সালটা হোক বাংলাদেশের বিচার বিভাগ এবং সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভাগ আইন মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ, আনসার, র‌্যাব, অ্যাটর্নিবৃন্দ, সবারই কাজকর্ম যেন শুদ্ধতমর দিকে অগ্রসর হয়। আমাদের এই ছোট্ট একটা জীবনে মানুষ মানুষকে হিংসা, ঘৃণা করে লাভই বা কী? দুর্নীতির টাকা দিয়ে জীবনের আয়ুষ্কাল বাড়ে কি? বরং যমদূত সর্বক্ষণ আশপাশেই থাকে।

লেখক : অধ্যাপক, বিজ্ঞান ও অঙ্ক বিভাগ, মিসিসিপি ইউনিভার্সিটি ফর উইম্যান, কলম্বাস, যুক্তরাষ্ট্র

সর্বশেষ খবর