বৃহস্পতিবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

বিদেশি ষড়যন্ত্র সফল হয়নি বাংলাদেশে

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

বিদেশি ষড়যন্ত্র সফল হয়নি বাংলাদেশে

জানুয়ারির গোড়ায় বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের পর ঢাকায় গিয়েছিলাম। দুই বছর পর ঢাকায় গিয়ে আমার মনে হচ্ছিল, এই এক নতুন ঢাকা। দেখা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও। আমার মনে পড়ছিল বঙ্গবন্ধুর আমলের গণভবন আর এ গণভবনের মধ্যে কত তফাত। জানুয়ারি মাসের বাংলাদেশ সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনাই নতুন বিশ্ব রেকর্ড স্থাপন করেছেন। যা পারেননি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী গোল্ড মেয়ার। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভ বন্দর নায়েকে আর যাকে নিয়ে বিশ্বে আলোচনা সাতের দশকে বাংলাদেশ নিয়ে সেই ইন্দিরা গান্ধীও।

ইন্দিরা গান্ধী পরপর চারবার বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। শেষ বারে ভারতের নির্বাচনের মাত্র ৩ মাস আগে তাকে তার নিজের বাড়িতেই হত্যা করা হয়। ঢাকার ৩২ নম্বর ধানমন্ডি রোড আর দিল্লিতে ২ নম্বর সফদরজং রোড একই কায়দায় সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের শিকার হয়েছিল।

ঢাকার ৩২ নম্বর ধানমন্ডির ঐতিহাসিক বাসভবনে বিদেশি চক্রের এজেন্টদের হাতে নিহত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। শেখ হাসিনার ঘরে ঢুকতেই তার নিরাপত্তা বাহিনীর এক মেজর জেনারেল আমাকে বললেন, দাদা আপনি বঙ্গবন্ধুর পাশে বসেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর একটি আবক্ষ ভাস্কর্য ছিল। আমাকে তাঁর পাশেই বসিয়ে দিলেন ওই মেজর জেনারেল। বিশ্বের মহিলা নেত্রীদের মধ্যে শেখ হাসিনা পাঁচবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কৃতিত্বের অধিকারী। তিনবার সংসদের বিরোধীদলীয় নেতাও হয়েছেন তিনি। এ রেকর্ড আর কারোর নেই। শেখ হাসিনাকে হটানোর বিদেশি ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। ঢাকায় সাড়ে তিন বছর থাকাকালীন আমি প্রায়ই বঙ্গবন্ধুর ঘরের সামনে একটি টুলে বসে থাকতাম। আমার সেসব স্মৃতি মনে পড়ছিল সেই মহান মানবের ভাস্কর্যের পাশে বসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর মার্কিন বিদেশ সচিব হেনরি কিসিঞ্জার ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিলেন, সেই প্রসঙ্গ তুলে তাদের অপনীতির কথা উল্লেখ করলেন।

ঢাকা গিয়ে এবার দেখেছি সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রিকশাচালক পর্যন্ত সবাই দল মত নির্বিশেষে শেখ হাসিনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আইনজ্ঞ থেকে শুরু করে অনেকেই আমাকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী সব খবর রাখেন, কোথায় কে কীভাবে ষড়যন্ত্র করছে। আমি ঢাকায় থাকাকালীন বাংলাদেশের এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীকে তিনি আঁতেল বলে সম্বোধন করেন। বস্তুত এ আঁতেলরাই মাঝেমধ্যে সরকারের নানা কাজের সমালোচনা করে আসছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ সেসব গায়ে মাখে না। তারা চায় রুটি-রুজির ব্যবস্থা। জিনিসপত্রের দাম এই সাধারণ মানুষের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা অসৎ ব্যবসায়ীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঢাকা শহরে আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করলাম। বায়ুদূষণ কমাতে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। একজন প্রবীণ সাংবাদিক বললেন, আমাদের শহরে মেট্রো হয়ে যাওয়ার পর অন্যান্য পরিবহন দূষণ অনেক কমে এসেছে। আরও সাতটি মেট্রোর কাজ শিগগিরই শুরু হবে। শেখ হাসিনা যে প্রতিশ্রুতি দেন, তা তিনি পালন করেন বলে সেখানকার বিশেষজ্ঞ মহল মনে করে। তার এ সাফল্য দেখে বিএনপি তিড়িংবিড়িং করে লাফাচ্ছে। তাদের মদত দিচ্ছে আমেরিকা। সে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব জানিয়েছেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তো বটেই এমনকি শেখ হাসিনার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজেও সাম্রাজ্যবাদীরা বারবার বাধা দিয়ে এসেছে।

ওয়াশিংটন ও হাওয়া ভবনের ষড়যন্ত্র দুরমুজ করে দিয়েছে গণভবন। সেই গণভবন থেকে তিনি বিশ্বকে দেখিয়ে দিলেন, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখলেই দেশের অগ্রগতি সম্ভব। সেই অগ্রগতির পথে ছুটছেন শেখ হাসিনা। গত দুই বছরে বাংলাদেশে এক শ্রেণির কুচক্রী ব্যবসায়ী বিদেশি মুদ্রা লুট করে নিয়েছে। ফলে বাংলাদেশে টাকার দাম পড়ে গেছে। দুই-আড়াই বছর আগে যখন ঢাকায় গিয়েছিলাম তখন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে টাকার বিনিময় হার ছিল বাংলাদেশের ১০০ টাকায় ভারতের ৮৩ টাকা। দুই বছরের মাথায় কমতে কমতে এসে দাঁড়িয়েছে ৬৩ টাকায়। প্রতিদিনই বাংলাদেশি মুদ্রার দাম কমছে। এটি একটি খারাপ প্রবণতা। সরকারি মহলের ভাষ্য এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ঢাকার এক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আমাকে বলেছেন, আগে মধ্যপ্রাচ্য থেকে কর্মরত লাখো বাঙালি ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশে টাকা পাঠাতেন। তাই বিদেশি মুদ্রার অভাব ছিল না। কিন্তু এখন সে দেশের কিছু ভুঁইফোঁড় ব্যবসায়ী এ বিদেশি মুদ্রা কিনে নিয়ে বেশি দামে বিক্রি করছে। ঢাকার এক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মনে করেন, এটা সাময়িক ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন। যাই হোক, এবার যে জিনিসটা আমার নজরে এসেছে তা হলো, হাওয়া ভবন বা পেন্টাগন যতই ষড়যন্ত্র করুক না কেন, শেখ হাসিনাকে দমাতে পারেনি। টানা চতুর্থবার নির্বাচিত হয়ে তিনি বিশ্বের মহিলা রাজনীতিকদের মধ্যে নতুন নজির সৃষ্টি করেছেন। আগেই উল্লেখ করেছি, ইন্দিরা গান্ধীকে পঞ্চমবারের নির্বাচনের আগেই হত্যা করে ষড়যন্ত্রকারীরা ভেবেছিল ভারতের গণতন্ত্র ধ্বংস করা যাবে। কিন্তু তাদের হিসাব ভুল হয়ে গেছে। একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। ২০০২ সালে অটল বিহারি বাজপেয়ি যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী তখন বিরোধী নেত্রী সোনিয়া গান্ধী। সন্ত্রাসবাদীরা সংসদে হামলা চালায়। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সংসদে হামলার খবর পেয়ে বিরোধী নেত্রী আমাকে ফোন করে জানতে চান, আমি কোথায় আছি। আমার কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না। উপমহাদেশে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের নেপথ্যেও রয়েছে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। এবার ঢাকায় গিয়ে পরিষ্কার হয়ে গেল জাতপাতের বিভেদ সৃষ্টি না করে মানুষের কল্যাণে কাজ  করলে তার ফল পাওয়া যায় ব্যালট বাক্সে। যা সম্প্রতি প্রত্যক্ষ করলেন শেখ হাসিনা। সৌজন্য সাক্ষাতে শেখ হাসিনা এও বলেছিলেন যে, তার দল এখন আগের চেয়ে ঢের শক্তিশালী।

লেখক : ভারতীয় সিনিয়র সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর