শনিবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

আমি কি এখন আর লিখি না

ইমদাদুল হক মিলন

আমি কি এখন আর লিখি না

গত দুই তিন বছর ধরে অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, আমি কি এখন আর লেখালেখি করি না? এখন কি আর আমার বই বেরোয় না? তাতে আমি বুঝতে পারি, এখন অনেকেই আগের মতো আর লেখক বা তাঁদের বইপত্রের খোঁজখবর রাখেন না। আবার অনেকেই বলেন, আগে আপনার বই পড়তাম। এখন আর সেভাবে পড়া হয় না। সময় পাই না। নতুন প্রজন্মের অনেকেই বলেন, আমার মা আপনার বই খুব পছন্দ করতেন। মায়ের মুখে আপনার বইয়ের অনেক কথা শুনেছি। একটি মেয়ে একদিন বলল, তার বাবার কাছে আমার প্রায় সব বই-ই আছে। কিন্তু সে নিজে বই তেমন পড়ে না। আবার কেউ কেউ বলে আপনার বই পড়ে আমরা বড় হয়েছি। আমাদের সময়ে হুমায়ূন আহমেদ আর আপনার বই-ই ছিল বিশেষ পছন্দের। সব কিছু মিলিয়ে আমি বুঝতে পারি বই থেকে মানুষ অনেকটা দূরে সরে গেছে। আগের মতো বই পড়ার ঝোঁকটা তাদের আর নেই। সেখানে তারা আসক্ত হয়েছে ফেসবুকে, ইউটিউব ইত্যাদিতে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বহু কিছুর চর্চা হয়। বইপত্রের চর্চা তেমন হয় বলে মনে হয় না। বছর ধরে লেখকরা কী লিখছেন, তার চর্চা হয় না।

আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে সারা বছর ধরে নানা রকমের বই প্রকাশিত হতো। সারা বছরই বই বিক্রি হতো। এখন প্রকাশনা জগৎ হয়ে গেছে একুশে বইমেলা কেন্দ্রিক। সারা বছর লেখকরা যা লেখেন, বইমেলায় সেগুলো প্রকাশিত হয়। দুই-একটি প্রকাশনা সংস্থা ছাড়া অন্য কোনো প্রকাশনী সারা বছর বলতে গেলে বই প্রকাশই করে না। কারণটা আমি ভেবে দেখেছি। মেলা ছাড়া অন্য সময়ে বই তেমন বিক্রি হয় না। যা বিক্রি হওয়ার হয় মেলায়। মেলার ওই একটি মাস। ফলে প্রকাশকরা সারা বছর ধরে বইয়ের পেছনে টাকাটা লগ্নি করে রাখতে চান না। ফেব্র“য়ারির বইমেলার মাস দুয়েক আগ থেকে হুড়োহুড়ি করে বই ছাপতে থাকেন। যাতে মেলার বিক্রি থেকেই তাঁদের ইনভেস্ট করা টাকাটা উঠে আসে। তবে সব প্রকাশকের ক্ষেত্রে এ কথাটা ঠিক না। বেশ কিছু প্রকাশনা সংস্থা আছে যারা সারা বছর ধরেই বই প্রকাশ করে যাচ্ছে। যেমন, ‘ইউপিএল’, ‘মাওলা ব্রাদার্স’, ‘প্রথমা’, ‘সময়’, ‘অন্যপ্রকাশ’, ‘অনন্যা’, ‘বাতিঘর’, ‘অবসর’, ‘ঐতিহ্য’ এরকম কিছু প্রকাশনা সংস্থা। ‘প্রথমা প্রকাশন’ ‘প্রথম আলো’র সঙ্গে যুক্ত। সারা বছর ধরেই ‘প্রথম আলো’তে বইগুলোর বিজ্ঞাপনও করে নিয়মিত। ফলে তাদের বইয়ের বেশ ভালো রকমের একটা চাহিদা তৈরি হয়। বেঙ্গল পাবলিকেশন্সও ভালো ভালো বই প্রকাশ করে। তারাও তাদের বইগুলোর বিজ্ঞাপন করে ‘বেঙ্গল গ্র“প’-এর সাহিত্য পত্রিকা ‘কালি ও কলম’-এ।  বইয়ের বিজ্ঞাপন খুব জরুরি। কখন কোথা থেকে কী বই বেরোচ্ছে, পাঠক ক্রেতাকে সেই সংবাদ জানান দরকার। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশনা সংস্থাগুলোর কথা বলা যায়। তাঁরা সারা বছর ধরেই বই প্রকাশ করছে। সারা বছর ধরেই বইয়ের বিজ্ঞাপন করছে। ‘আনন্দ পাবলিশার্স’-এর জন্মলগ্ন থেকে ‘দেশ’ পত্রিকা একটি পাতাই বরাদ্দ করে রেখেছে ‘আনন্দ পাবলিশার্স’-এর বইয়ের বিজ্ঞাপনের জন্য। ‘মিত্র ও ঘোষ’, ‘দে’জ’, ‘প্রতিভাস’ এরকম বেশ কিছু প্রকাশন সংস্থা ‘দেশ’ পত্রিকার প্রতি সংখ্যাতেই বইয়ের বিজ্ঞাপন করে। ফলে পাঠক জেনে যান ইদানীং কোন লেখকের কোন বই বাজারে এলো। এই জানাটা বড় জরুরি। আমাদের দেশে এ অবস্থাটা তৈরি হয়নি। গত চার-পাঁচ বছর ধরে কোনো কোনো নতুন লেখকের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করি তাঁরা সোশ্যাল মিডিয়াতে লেখালেখি করেন। সে সব লেখা বইমেলার সময় বই আকারে প্রকাশ করেন। তাঁদের কারও কারও অনেক অনুসারী। কোনো কোনো লেখকের বইয়ের বিক্রিও ভালো। এ-ও একদিকে ভালো লক্ষণ যে, এই লেখকরা সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে তাঁদের বইগুলো পাঠকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। লেখার ভালোমন্দ বিচার হয় পরে। পাঠক বইটি পড়ে দেখবেন সেই লেখা ভালো কি মন্দ। কিন্তু পড়তে তো হবে! না পড়ে তো কোনো মন্তব্য করা যাবে না! নিশ্চয় এঁদের মধ্যে অনেক ভালো লেখক আছেন বা তৈরি হচ্ছেন। আবার মানহীন লেখাও নিশ্চয় অনেক আছে।

কয়েক বছর ধরেই শুনছি এক মাসের বইমেলায় চার-পাঁচ হাজার বই প্রকাশিত হয়। এত বই কারা লিখছেন? নিশ্চয় নতুন নতুন লেখক। আর এখন বই প্রকাশ করা খুবই সহজ হয়ে গেছে। কোনো কোনো প্রকাশকের কথা শুনি তাঁরা নাকি লেখকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাঁর বইটি প্রকাশ করেন। নিজের লাভের অংশটা আগেই রেখে দেন। আবার এমন অনেক প্রকাশকও আছেন যাঁরা খুঁজে খুঁজে প্রতিশ্র“তিশীল নতুন লেখকদের বই ছাপছেন। ইদানীং কিছু নারীও প্রকাশনা ব্যবসায় এসেছেন। নারী লেখকের সংখ্যাও বেড়েছে। এটা শুভ লক্ষণ।

আমরা যখন শুরু করেছিলাম তখন অবস্থাটা এরকম ছিল না। তখন অনেক সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল, মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ছিল, সিনেমা পত্রিকা ছিল আর ছিল দৈনিক পত্রিকাগুলোর বেশ শক্তিশালী এক একটি সাহিত্য পাতা। নতুন লেখকরা তাঁদের গল্প কবিতা সেসব পত্রিকাতে পাঠাতেন। জাঁদরেল সম্পাদক ছিলেন একেকজন। যেমন, ‘দৈনিক বাংলা’য় ছিলেন কবি আহসান হাবীব, ‘ইত্তেফাকে’ রোকনুজ্জামান খান, ‘সংবাদে’ আবুল হাসনাত। এই সম্পাদকরা কারও মুখ চেয়ে লেখা ছাপতেন না। লেখা ছাপা হতো লেখার যোগ্যতায়। সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে ছিল ‘সচিত্র সন্ধানী’, ‘বিচিত্রা’, ‘রোববার’। ‘সচিত্র সন্ধানী’র সম্পাদক হিসেবে আমি পেয়েছি কবি বেলাল চৌধুরীকে। ‘বিচিত্রা’র সম্পাদক ছিলেন শাহাদত চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে শাহরিয়ার কবিরের মতো মেধাবী লেখক ও আরও অনেকে। ‘রোববার’ পত্রিকাতে ছিলেন কবি রফিক আজাদ। তিনি একাধারে বাংলা একাডেমির ‘উত্তরাধিকার’ সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হতো কিশোরদের পত্রিকা ‘ধানশালিকের দেশ’। সম্পাদক সেলিনা হোসেন। এঁদের হাত দিয়ে মানহীন লেখা কখনোই প্রকাশিত হতো না। সাপ্তাহিক সিনেমা পত্রিকা ছিল তিনটি। ‘অবজারভার গ্র“প’-এর ‘চিত্রালী’, ‘ইত্তেফাক’-এর ‘পূর্বাণী’, ‘বাংলার বাণী গ্র“প’-এর ‘সিনেমা’। এই পত্রিকাগুলোতেও নিয়মিত গল্প ছাপা হতো। আমি ‘চিত্রালী’র সম্পাদক হিসেবে পেয়েছি আহমদ জামান চৌধুরীকে। ‘পূর্বাণী’র সম্পাদক ছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক এবং পরে যুগান্তর ও সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। আর ‘সিনেমা’ পত্রিকাটির সাহিত্য পাতা দেখতেন আমার অগ্রজপ্রতিম বন্ধু আলমগীর রহমান। তিনি নিজেও এক সময় গল্প লিখতেন। পরে ‘বিচিত্রা’র সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। তারপর ‘অবসর ও প্রতীক’ নামে প্রকাশনা সংস্থা করলেন। কামাল বিন মাহতাব ‘ছোটগল্প’ নামে অসাধারণ একটি পত্রিকা করতেন। শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক থেকে শুরু করে অনেকেই এই পত্রিকাতে গল্প লিখতেন। আলমগীর রহমানের দুর্দান্ত একটি গল্প ছাপা হয়েছিল এই পত্রিকায়। গল্পটির নাম ‘প্রান্তরে অশ্বারোহী’। জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, মাহমুদুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কায়েস আহমেদ এরকম অনেক লেখকই ‘ছোটগল্প’ পত্রিকায় দুর্দান্ত সব গল্প লিখেছিলেন।

কয়েকটি মাসিক সিনেমা পত্রিকাও বেরোত তখন। কলকাতার ‘উল্টোরথ’, ‘প্রসাদ’, ‘জলসা’র আঙ্গিকে। যেমন- ‘ঝিনুক’ ও ‘জোনাকী’। এই পত্রিকাগুলোতেও গল্প উপন্যাস ছাপা হতো। কিন্তু সেসব লেখা মানহীন নয় কোনোটাই।

আমি বলছি স্বাধীনতা-পরবর্র্তীকালের কথা। সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’ শুরু করল ‘ঈদসংখ্যার’ প্রচলন। সে পথে এগোল অন্যান্য সাপ্তাহিক। একটা সময়ে দৈনিক পত্রিকাগুলোও ঈদসংখ্যা প্রকাশ শুরু করল। দেশের বাছাই করা লেখকদের সঙ্গে ধীরে ধীরে উঠে আসতে লাগলেন প্রতিভাবান তরুণ লেখকরা। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ছাপা শুরু হলো ঈদসংখ্যা ‘বিচিত্রা’য়। তারপর অন্যান্য পত্রিকায়। আমার দ্বিতীয় উপন্যাস ছিল ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’। ছাপা হলো ঈদসংখ্যা ‘সিনেমা’ পত্রিকাতে। আমাদের বেশির ভাগ উপন্যাসই ছাপা হতো তখন বিভিন্ন ঈদসংখ্যায়। তার জন্য একটা পরীক্ষাও ছিল। লেখা ভালো হতে হবে। বই প্রকাশ করতে গেলে পা-ুলিপি জমা দিতে হতো। মানসম্পন্ন লেখা না হলে বই বেরোত না। আমি লেখা শুরু করলাম ’৭৩ সালে। একটানা চার বছর লেখার পর ’৭৭ সালে প্রথম বই প্রকাশিত হলো।

নব্বই দশকের গোড়ার দিকে বাজারে এসেছিল পাক্ষিক ‘অন্যদিন’। এই পত্রিকার সাধারণ সংখ্যাগুলো তো চমৎকার বটেই, ঈদসংখ্যাটি হয়ে উঠল অতুলনীয়। দেশের সেরা লেখকদের বাছাই করা ১০টি উপন্যাস ছাপা হতো ‘অন্যদিন’ ঈদসংখ্যায়। শুরুর দিকে দুই বাংলার দুই জনপ্রিয় লেখক শিরোনামে অন্যদিন একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিল। একজন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আরেকজন এই অধম। তারপর তো হুমায়ূন আহমেদ এসে জনপ্রিয়তার নতুন ইতিহাস তৈরি করলেন। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র। হুমায়ূন ভাই তাঁকেও ছাড়িয়ে গেলেন।

অন্যদিন সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম তারপরে এলেন প্রকাশনা জগতে। শুরু হলো ‘অন্যপ্রকাশ’। রাতারাতি এই প্রকাশনা সংস্থা অনেক বড় জায়গায় পৌঁছে গেল।

গত পঁয়ত্রিশ চল্লিশ বছরে বেশ কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থা অনেক বড় জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। যেমন- ‘আগামী’, ‘অনুপম’, ‘মাওলা ব্রাদার্স’ তো ছিলই, ‘অনন্যা’, ‘সময়’, ‘বিদ্যাপ্রকাশ’, ‘কাকলী’, ‘পার্ল’, ‘ঐতিহ্য’ এই প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বাংলাদেশের প্রথম সারির প্রকাশনা সংস্থা। এক সময় ‘নওরোজ কিতাবিস্তান’, ‘স্টুডেন্ট ওয়েজ’ এরকম বেশ কিছু প্রকাশনা সংস্থা এখন কিছুটা যেন ম্লান হয়ে গেছে। মফিদুল হকের ‘সাহিত্য প্রকাশ’ও বেশ নামকরা প্রতিষ্ঠান। লেখক জীবনের শুরু থেকেই এসব প্রতিষ্ঠানের মেধাবী মানুষগুলোর মাঝখান দিয়ে আমি বেড়ে উঠেছি। ‘অনন্যা’ তাঁর প্রকাশনীর যাত্রা শুরু করেছিল আমার বই দিয়ে। ‘সময়’, ‘কাকলী’, ‘অন্যপ্রকাশ’ তারাও। আজ চারদিকে কত কত প্রকাশনা সংস্থা। একেক বইমেলায় ছয় সাত শ স্টল হয়। এর বাইরেও হয়তো থেকে যায় অনেক প্রকাশনা সংস্থা। তার মানে সব মিলিয়ে আমাদের প্রকাশনা জগৎ এখন বিশাল।

এই লেখা শুরু করেছিলাম নিজের লেখালেখির কথা বলার জন্য। আমার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। তার মানে লেখক জীবনের পঞ্চাশটি বছর পার করে ফেলেছি। এই পঞ্চাশ বছরে জীবনধারণের জন্য কত কী করার চেষ্টা করেছি। কোথাও সেভাবে দাঁড়াতে পারিনি। পেশা হিসেবে একটা ধরেছি, একটা ছেড়েছি। কোথাও আলোর মুখ দেখিনি। সর্বত্র ব্যর্থতা। অতিশয় দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে বড় হয়ে ওঠা। কত অনাহারি দিনরাত্রীর স্মৃতি রয়ে গেছে মনে। কত অপমান-অবহেলা। বারবারই সেই অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। বদলে ফেলতে চেয়েছি দুঃখ-দারিদ্র্যের জীবন। জার্মানিতে চলে গিয়েছিলাম সচ্ছল জীবনের আশায়। ফিরে এসেছি গভীর ব্যর্থতা নিয়ে। তারপর স্ত্রীসমেত বড় ভাইয়ের সংসার থেকে বিতাড়িত। দশটি টাকাও নেই পকেটে। একটি টিনের ঘরে বসে গরমে ঘামে সিদ্ধ হতে হতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম লিখেই জীবন ধারণের চেষ্টা করব। আর কোনো কাজ তো শিখিনি। এসব ’৮৪ সালের শেষদিককার কথা। কিন্তু লিখে ক’টাকা রোজগার করা যায়? পত্রিকাতে গল্প ছাপা হলে দু-তিন মাস পর পনেরো-বিশ টাকা বিল পাওয়া যায়। অনেক পত্রিকা বিল দেয়ও না। ঈদ সংখ্যায় উপন্যাস ছাপা হলে তিনশো টাকা পাওয়া যায়। তা-ও বড় পত্রিকাগুলোর মুখ চেয়ে বসে থাকতে হয়। তারা লেখা ছাপবে কি না, এই আশায়? এই পরিস্থিতিতে লিখে জীবনধারণ? এ তো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত! আমি সেই সিদ্ধান্তটাই নিলাম। এ ক্ষেত্রে আমার আদর্শ ছিলেন সমরেশ বসু। সমরেশ বসু অফিস করার মতো সারা দিন লিখতেন। সন্ধ্যাবেলা আড্ডা দিতে বেরোতেন। এই করে সংসারে সচ্ছলতা আনতে বেশ কিছু বছর সময় লেগেছিল তাঁর। আমার ক্ষেত্রেও তাই হলো। একজন প্রকাশক বললেন, মাসে একটা করে পাঁচ ফর্মার প্রেমের উপন্যাস লিখে দিন, পাঁচ হাজার করে টাকা দেব। তখন পাঁচ হাজার টাকা আমার জন্য অনেক। শুরু করলাম লেখা। ভোর ৬টায় উঠে লিখতে বসি। ১১টা পর্যন্ত লিখে বাংলাবাজারে আড্ডা দিতে যাই। দুপুরে বাসায় ফিরে খেয়েদেয়ে বিকেল সন্ধ্যায় যাই বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। এই লেখার ফাঁকে পত্রিকায় গল্প লিখছি, ঈদ সংখ্যায় উপন্যাস লিখছি। শুধুই লেখা, শুধুই লেখা। এক ফাঁকে বিটিভির জন্য নাটকও লিখতে শুরু করলাম। নাটকের জনপ্রিয়তা বই বিক্রির ক্ষেত্রে কাজে লাগল। দিন বদলাতে শুরু করল। পাঁচ হাজার হয়ে গেল দশ হাজার। পনেরো, বিশ। তার মানে বই বিক্রি হচ্ছে। দু’তিন বছরের মধ্যে দেখি আমার চারপাশে অনেক প্রকাশক। বই ছাপা হচ্ছে, বিক্রি হচ্ছে। তারপরও সময় মতো টাকা পাই না। অ্যাডভান্স নিতে শুরু করলাম। এক সময় পত্রপত্রিকায় লেখার জন্যও অ্যাডভান্স নিই। নব্বই সালের দিকে পায়ের তলার মাটি শক্ত হলো। গেন্ডারিয়ায় এক প্রকাশকের চারতলার ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম। পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন ‘কাকলী’ প্রকাশনীর সেলিম ভাই। ওইটুকু ফ্ল্যাটে তাঁর হয় না। তিনি চলে গেলেন অন্য বাড়িতে। লেখালেখি করার জন্য সেই ফ্ল্যাটটা আমি ভাড়া নিলাম। ফ্ল্যাট ভর্তি বই, বসার ব্যবস্থা আর লেখার টেবিল। তবে ’৮৬ সাল থেকে আমার সেই দুঃখ-দারিদ্র্যের দিনে একজন মানুষ গভীর ভালোবাসায় আমার হাত ধরেছিলেন। মাসের পর মাস টাকা দিয়ে আমাকে চালিয়ে রেখেছেন। মেয়ের দুধ কিনে দিয়েছেন, জামা-কাপড় কিনে দিয়েছেন। আর দিয়েছেন অপরিসীম ভরসা। ভালো লেখার চেষ্টা কর। তুমি পারবে। আমি চেষ্টা করে গেছি। ’৯৩ সালের যেদিন বাংলা একাডেমি প্রাইজ পেলাম, তিনি সেখানে ছিলেন। গভীর আবেগে মাঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন।

সমরেশ বসু লেখার জন্য কলকাতায় আলাদা একটা ফ্ল্যাট কিনে নিয়েছিলেন। অনেক সময় লেখার জন্য হোটেলে গিয়েও থাকতেন। আমিও এক সময় তাই করেছি। ফেব্র“য়ারির বইমেলার দু-তিন মাস আগে থেকে অথবা ঈদ সংখ্যার লেখার জন্য শান্তিনগরের ‘হোয়াইট হাউজ’ হোটেলে গিয়ে থাকতাম। সেখানে বসেই লিখেছিলাম ‘ভালোবাসার সুখ দুঃখ’। শুরু থেকে প্রচুর প্রেমের গল্প উপন্যাস লিখেছি, শিশু-কিশোরদের লেখা লিখেছি। বিভিন্ন বয়সী পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেছি। সহজ সরল পরিচ্ছন্ন গদ্য লেখার চেষ্টা করেছি। অনেক কিছু থেকে জীবনে সরে গেছি, শুধু লেখার জায়গাটি থেকে সরিনি। জার্মানিতে ছিল শ্রমিকের জীবন। সেই কঠোর কঠিন অবস্থার মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস লিখেছিলাম ‘কালোঘোড়া’। ‘গাহে অচিন পাখি’ নামে গল্প লিখেছিলাম। প্রথম উপন্যাস ‘যাবজ্জীবন’। দ্বিতীয় উপন্যাস ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’। প্রথম বই ‘ভালোবাসার গল্প’। দ্বিতীয় বই ‘নিরন্নের কাল’। নাম থেকেই বোঝা যায় শুরু থেকেই দুরকমের লেখা লিখার চেষ্টা করেছি আমি। একদিকে বাজার চলতি প্রেম ভালোবাসার গল্প উপন্যাস, অন্যদিকে গ্রামজীবন নিয়ে আরেক রকমের লেখা। একহাতে লিখেছি ‘এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’ বা ‘কেউ কথা রাখেনি’, আরেক হাতে লিখেছি ‘পরাধীনতা’, ‘ভূমিপুত্র’, ‘কালাকাল’, ‘নদী উপাখ্যান’, ‘টোপ’ ইত্যাদি।

সমরেশ বসু একবার ঢাকায় এলেন। বেলাল চৌধুরী আমাকে নিয়ে গেলেন তাঁর কাছে। ধানমন্ডিতে এক বাসায় উঠেছিলেন। অনেক ক্ষণ আড্ডা হলো প্রিয় লেখকের সঙ্গে। এক সময় তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “একই সঙ্গে আপনি দুরকমের লেখা কেমন করে লেখেন? একদিকে লিখছেন, ‘গঙ্গা’, ‘বিবর’, ‘কোথায় পাবো তারে’ অন্যদিকে লিখছেন, ‘বিকেলে ভোরের ফুল’ বা ‘ছুটির ফাঁদে’, কেন?” তিনি খুব সুন্দর একটি জবাব দিয়েছিলেন, “শোনো, ওই যে কথায় বলে না, কোনো কোনো লেখক দু’হাতে লেখেন! আমি দু’হাতে লিখি। ডানহাতে লিখি ‘গঙ্গা’ বা ‘বিবর’, বাঁহাতে লিখি ওইসব ‘বিকেলে ভোরের ফুল’। ডানহাতের লেখা পয়সা দেয় না, দেয় ওই বাঁহাতের লেখাগুলো। লিখে খেতে হলে ওসব লিখতে হবেই। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাই করেছেন।”

সমরেশ বসুর কথাটি আমার লেখক জীবনের ক্ষেত্রে অনেকটাই সত্য। লিখে খেতে হলে প্রচুর আবর্জনা লিখতে হয়। তবে একজন প্রকৃত লেখক শেষপর্যন্ত শুধু টাকার জন্যই লিখতে পারেন না। শুরু থেকেই বাজার চলতি লেখার ফাঁকে ফাঁকে আমি কিছু অন্য রকম লেখারও চেষ্টা করেছি। দীর্ঘ আঠারো বছর ধরে লিখেছি তিন পর্বের উপন্যাস ‘নূরজাহান’। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছি ‘সাড়ে তিন হাত ভূমি’। আত্মজৈবনিক উপন্যাস লিখেছি চার পর্বের, ‘কেমন আছ, সবুজপাতা’, ‘জিন্দাবাহার’, ‘মায়ানগর’, ‘একাত্তর ও একজন মা’। দেশভাগ নিয়ে লিখেছি ‘পর’। গত বছর লিখেছি আত্মজীবনীর প্রথম অংশ ‘যে জীবন আমার ছিল’। এখন আর পয়সার কথা ভেবে আমি লিখি না। তবে লিখি নিয়মিত। পেছনে ফেলে আসা দিনের মতো এখনো সকালবেলা উঠে লিখতে বসি। বাংলাদেশ ও কলকাতা মিলে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা ছাপা হয়। দুজায়গা থেকেই বছরে চার-পাঁচটা বই প্রকাশিত হয়। ঈদসংখ্যা ও পুজো সংখ্যাতে লিখি। গত পুজোয় কলকাতার বিখ্যাত ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকায় উপন্যাস লিখেছিলাম। কলকাতা বইমেলা উপলক্ষে ‘আনন্দ পাবলিশার্স’ থেকে বইটি বেরিয়েছে। নাম ‘বুলু ও অচিন দ্বীপ’। কিশোর উপন্যাস। ফেব্র“য়ারি বইমেলায় ‘অনন্যা’ প্রকাশনী থেকে এবার বেরিয়েছে দুটো নতুন বই। ‘অন্ধকার নামতে পারেনি’ ও ‘চোর এসে গল্প করেছিল’। ‘বেঙ্গল পাবলিকেশন্স’ থেকে বেরিয়েছে শিশুদের জন্য লেখা ‘বাবান ও ঘুঘু পাখির সংসার’। ‘অন্যপ্রকাশ’ থেকে বেরোচ্ছে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে লেখা ‘কেমন ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ’।

লেখালেখির মায়ায় গত পঞ্চাশ বছর ধরে আমি আবদ্ধ হয়ে আছি। মৃত্যু ছাড়া এই মায়া কখনো কেটে যাবে না।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

সর্বশেষ খবর