শনিবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

খেজুর গুড়ের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বব্যাপী

শাইখ সিরাজ

খেজুর গুড়ের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বব্যাপী

যশোরের যশ, খেজুরের রস- এই প্রবাদের প্রচলন অনেক পুরনো। ইতিহাস বলে, শত শত বছর আগে থেকেই যশোরের খেজুর গুড়ের সুখ্যাতি ছিল। ব্রিটিশ আমলে এখানে গড়ে উঠেছিল শতাধিক খেজুর চিনির কারখানা। ঐতিহাসিক নিহাররঞ্জন রায় তাঁর গ্রন্থ বাঙালির ইতিহাস আদিপর্ব-এ নলেন গুড়ের বন্দনার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, এই বঙ্গদেশে যে তিন রকমের রস থেকে গুড় তৈরি হয় তা হলো আখ, খেজুর ও তাল।  তবে এর মধ্যে স্বাদে-গন্ধে খেজুরের রসই সেরা। ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র মিত্রের যশোহর খুলনার ইতিহাস বইতে পাওয়া যায়, ১৯০০-১৯০১ সালে পূর্ববঙ্গে খেজুরের গুড় তৈরি হয়েছে ২১ লাখ ৮০ হাজার ৫৫০ মণ। এর মধ্যে শুধু যশোরেই তৈরি হয়েছে ১৭ লাখ ৯ হাজার ৯৬০ মণ গুড়। ১৮৬১ সালে মিস্টার নিউ হাউস চৌগাছার কপোতাক্ষ নদের পারে তাহেরপুরে প্রথম খেজুরের গুড় উৎপাদনের যান্ত্রিক কারখানা গড়ে তোলে। ওই কারখানার উৎপাদিত গুড় ইউরোপে রপ্তানি হয়েছে। পরবর্তী সময়ে যশোরের বিভিন্ন গ্রামে ১১৭টি কারখানা গড়ে ওঠে। কিন্তু কালের পরিক্রমায় নানা অনিয়মে খেজুরের রস আহরণে গাছিরা অনাগ্রহী হয়ে ওঠেন। কমে যায় রস আহরণ এবং গুড়ের উৎপাদন। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আমি খেজুর গুড়ের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরছি টেলিভিশন অনুষ্ঠান ও আমার লেখালেখিতে। তুলে ধরেছি গাছিদের নানা সংকটের কথা। প্রচার-প্রচারণায় বেড়েছে ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড়ের চাহিদা। সরকারের প্রশাসন উদ্যোগী হয়েছে পুরনো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার। এরই ধারাবাহিকতায় যশোরের চৌগাছা উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা পরিষদ আয়োজন করে ‘গুড় মেলার’। ২০২৩ সালে প্রথমবার খেজুর গুড়ের মেলার আয়োজনের উদ্যোগ নেন সেই সময়কার চৌগাছা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা। আমি কথা বলেছি তার সঙ্গে। তিনি বলেন, শুধু মেলার আয়োজনই নয়, গাছিদের ডেটাবেইজ তৈরি থেকে শুরু করে অনলাইনে গুড় বিক্রির প্ল্যাটফরম তৈরির উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, স্কাউটদের গাছকাটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। চৌগাছা উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে স্বরূপদাহ ইউনিয়নের খড়িঞ্চা বাঁওড়ের দুই পাশে প্রায় ৭২ একর খাস জমি দখলমুক্ত করে দুটি খেজুরবাগান প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। বাগান দুটিতে ২৫০০ খেজুরগাছ রোপণ করা হয়। এ ছাড়াও উপজেলার কপোতাক্ষ ও ভৈরব নদের তীর, বিভিন্ন স্কুল-কলেজের সীমানা এবং বিভিন্ন সড়কের ধারে ৫০ লক্ষাধিক খেজুর বীজ রোপণ করা হয়। ইরুফা সুলতানা এখন কর্মরত আছেন কুষ্টিয়ার খোকশা উপজেলায়। তার নেওয়া উদ্যোগগুলোকে সযতেœ ধারণ করছেন চৌগাছার বর্তমান নির্বাহী কর্মকর্তা সুস্মিতা সাহা। তার আমন্ত্রণে এবার গুড় মেলা দেখতে যাই আমি। সুস্মিতা সাহা বলেন, গুড় মেলার মাধ্যমে গুড়ের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরার পাশাপাশি, এতে গুড় শিল্পের বিকাশ হবে বলে আশা করছেন তারা। গুড় মেলায় কৃষক এবং ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে সেতুবন্ধ রচিত হয়েছে। এর মাধ্যমে সচেতন হচ্ছেন মানুষ। মেলায় অংশগ্রহণ করা গাছিরা বললেন, মেলার ফলে তাদের বিক্রি বেড়েছে। গুড়ের ন্যায্য দাম যেমন তারা পাচ্ছেন, পাচ্ছেন মানুষের ভালোবাসাও। খেজুরগাছকে বলা হয় মধুবৃক্ষ। সবচেয়ে অযতেœ-অবহেলায় বড় হয়, অথচ এ গাছ থেকেই পাওয়া যায় সুঘ্রাণের মধুরস। যশোরের আবহাওয়া ও পরিবেশ খেজুরগাছের জন্য উপযোগী। তাই এখানে অনেক আগে থেকেই খেজুর গাছের আধিক্য। খেজুরগাছ কাটা থেকে রস সংগ্রহ এবং গুড় তৈরির কাজটি করতে হয় দক্ষতার সঙ্গে নিপুণ হাতে। না হলে গুড়ে কাক্সিক্ষত স্বাদ আসে না। যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে বলছে, এ জেলায় মোট খেজুরগাছের সংখ্যা ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৫৫টি। এর মধ্যে রস উৎপাদিত হয় এমন খেজুরগাছের সংখ্যা ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৫টি। বছরে ৫ কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার ২৫০ লিটার রস উৎপাদন হয়। গুড় উৎপাদিত হয় ৫২ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৫ কেজি। যার মূল্য ১০০ কোটি টাকার ওপরে। বর্তমানে জেলার আট উপজেলায় গাছির সংখ্যা ১৩ হাজার ১৭৩ জন। মেলায় যাওয়ার আগে ভোররাতে গিয়েছিলাম চৌগাছা উপজেলার হাজীপুর গ্রামের রস পাড়া ও গুড় তৈরির প্রক্রিয়া দেখতে। অন্ধকার থাকতেই রস নামাতে হয়। রস সংগ্রহ করতে করতে বেশ কয়েকজন গাছির সঙ্গে কথা হয় আমার। গাছিদের একজন হারুন-অর-রশীদ। তিনি চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন। গাছকাটা, রস সংগ্রহ থেকে শুরু করে গুড় বানানো পর্যন্ত সব কাজই করেন নিজ হাতে। তিনি জানালেন, আগের মতো খেজুর গাছ নেই, একই সঙ্গে কমছে গাছির সংখ্যাও। গাছিদের পরবর্তী প্রজন্ম এই পেশায় আগ্রহী হচ্ছেন না। সংকটের আরেকটি কারণ পরিশ্রম ও উৎপাদন খরচ অনুযায়ী গুড়-পাটালির ন্যায্য দাম না পাওয়া। রফিকুল ইসলাম ও কেনু মন্ডল নামের দুজন খেজুর গাছ থেকে রস পাড়ছিলেন। কথা হয় তাদের সঙ্গে। রফিকুল ইসলাম বলেন, কালের বিবর্তনে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে খেজুরের গাছ ও রস। এক সময় রাস্তার মেঠো পথের দুই পাশে চোখ বুলালেই চোখে পড়তো খেজুরগাছের সারি। আর এখন এমন দৃশ্য চোখে পড়ে না। বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে দিন দিন খেজুরের গাছ কমতে থাকায় গাছিরাও বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা। বছর বিশেক আগেও কনকনে শীতে হারিকেন জ্বালিয়ে চোরের ভয়ে গভীর রাত পর্যন্ত রসের হাঁড়ি পাহারা দিতে হতো। পুরো শীতকাল ব্যস্ত থাকতে হতো খেজুরের রস এবং রসের গুড় তৈরি নিয়ে। এখন যে গাছ আছে তাতেও তেমন রস মিলছে না। শীতের সময় রস সংগ্রহের পরে খেজুর গাছগুলোতে আর পরিচর্যা করা হয় না বলে গাছে শীতের সময় রস হয় না। বিশেষ করে প্রতিটি এলাকায় কৃষকরা তাদের অভাব-অনটনের কারণে রসের খেজুর গাছগুলো কেটে ইটভাটায় বিক্রি করে দিয়েছে অনেকেই। রস সংগ্রহের জন্য গাছের সংকট দেখা দিচ্ছে। একদিকে চাহিদার তুলনায় রসের জোগান অনেক কম, অন্য দিকে ভেজাল গুড়ে বাজার সয়লাব। এতে করে আসল খেজুর গুড়ের স্বাদ হতে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। গ্রামের অনেকের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানালেন, ইটভাটা, গাছি সংকট, ধান-সবজি চাষ- এই তিন কারণে যশোরের ঐতিহ্যের খেজুর গুড় হারিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি অসৎ ব্যবসায়ীরা খেজুর গুড়ে চিনি মেশানোর কারণে চিরচেনা সেই স্বাদও আর থাকছে না। শীত মৌসুমে নলেন গুড়ের পায়েস, রস পিঠা, নারিকেল কুলি ঐতিহ্যের এই পিঠা-পায়েসও কেবল খেজুর গুড়ের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। খেজুরের গুড় উৎপাদনের সংকট নিরসনে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।  আমাদের ঐতিহ্যের মর্যাদা তুলে ধরতে হবে বিশ্বের কাছে। প্রকৃতির এই আশীর্বাদকে সম্পদে রূপান্তর করতে পারলে লাভবান হবেন কৃষক, লাভ হবে দেশের।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর