রবিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

বন্ধুত্বের কঠিন বাস্তবতা সুচিত্রা থেকে এখন

নঈম নিজাম

বন্ধুত্বের কঠিন বাস্তবতা সুচিত্রা থেকে এখন

‘বন্ধু তোমার পথের সাথিকে চিনে নিও... মনের মাঝেতে চিরদিন তাকে ডেকে নিও...।’ হেমন্তের গাওয়া গানের মতো চলার পথে সঠিক বন্ধু চিনতে পারি? বুঝতে পারি কি সঙ্গে চলা মানুষের ভিতরের মনোজগৎ? একটা জীবন কেটে যায় মানুষকে বুঝতে বুঝতে। তার পরও আপনজন চেনা হয়ে ওঠে না। চারপাশটা অচেনা রেখেই পথ চলতে হয়। শাপমোচন ছবিতে গ্রামের যুবক উত্তম কুমার শহরে আসেন। বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে বাবার বড়লোক বন্ধুর বাড়িতে ওঠেন। কলকাতার বনেদি বাড়ির মেয়ে সুচিত্রা সেন দুই হাতে সংসার সামলান। বাড়ির সবকিছুতে নাক গলান। বন্ধুর ছেলেকে পরিচয় করে দেন বাবা। বলেন, উত্তমের বাবা বড় খারাপ সময়ে পাশে ছিল। তার সহায়তা না পেলে আজ হয়তো বেঁচে থাকতেন না। সুচিত্রার ওপর দায়িত্ব এলো গ্রাম্য পোশাকের উত্তমকে শহরের মতো গড়ে তোলার। সুচিত্রা খেয়াল করলেন তার বাবা ছাড়া বাড়ির লোকজন পাত্তাই দিচ্ছে না উত্তমকে। পরিস্থিতি বুঝলেন সুচিত্রা। উত্তম কুমারকে বললেন, এ চেহারা এখানে চলবে না। ধুয়েমুছে এখানকার মতো করতে হবে। দেখছেন না এখানকার দামি আসবাবপত্র? জবাবে উত্তম কুমার বললেন, আমি তো দামি আসবাব হয়ে থাকতে আসিনি। সুচিত্রা হাসলেন। তারপর বললেন, শহরের জীবনে চাকরি করার জন্য আপনার পোশাক পরিবর্তন দরকার। চলুন...।

দারুণ একটি ছবি। সুচিত্রা নেমে পড়লেন বাবার বন্ধুর ছেলেকে শহরের আদলে গড়ে তুলতে। নতুন পোশাক পরানো হলো। টাই পরাতে গিয়ে হিমশিম। ঝামেলার শেষ নেই। সুচিত্রা বললেন, নাঃ পারলাম না। অনেক সময় লাগবে। উত্তম জানতে চান কীসে? জবাবে সুচিত্রা বললেন, ‘তোমাকে ভেঙে গড়ে তুলতে।’ চাইলেই কি একজন মানুষ আরেকজনকে ভেঙে গড়ে তুলতে পারে? সুচিত্রার সেই কঠিন চেষ্টার পরতে পরতে ছিল অনেক প্রতিকূলতা। পথে পথে সামাজিক বাধা। জটিলতার শেষ ছিল না বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে। ওস্তাদের কাছে গান শিখতেন সুচিত্রা। ভালো গান করতেন উত্তমও। পারিবারিকভাবে উত্তমের গান করা নিয়ে একটা অভিশাপ ছিল। তাই ভাইয়ের কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল শহরে গান না করতে। গুরুর অভিশাপ অনুযায়ী গান করলেই পরিবারের কেউ বিপদে পড়বে। মারাও যেতে পারে। সে নিষেধাজ্ঞার বাইরে গেলেন উত্তম। গান করলেন। বিপদ নেমে এলো পরিবারে। চিন্তা হলো এখন শাপমোচন কীভাবে হবে? সুচিত্রা পাশে থাকলেন। গল্প এগিয়ে যেতে থাকল। জীবনের বহতা নদী পথ চলতে থাকল। উত্তমকে বন্ধুর মতো আগলে রাখলেন সুচিত্রা। আবেগ-অনুভূতির মায়াবী বাঁধনে চেষ্টা করলেন সবকিছু অতিক্রমের।

সাতকাহনের জীবনে একটা সময় মানুষের মনে আবেগ ছিল। নাটক, সিনেমায়ও উঠে আসত সেই ইমোশন। ছবি দেখতে দেখতে দর্শক চোখ মুছত। এখন সে আবেগ নেই। ভিতরের অনুভূতিগুলো হারিয়ে গেছে। ব্যক্তিজীবনের মতো ছবি তৈরি হয় সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। ভালো লাগার চিঠি নিয়ে ডাকপিয়ন কারও বাড়িতে কড়া নাড়ে না। অপেক্ষায়ও কেউ থাকে না। ইনস্টাগ্রাম, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপে চ্যাটিং হয়। দুই দিনেই প্রেম, তৃতীয় দিনে দেখা। চতুর্থ দিনে সব শেষ। পঞ্চম দিনে বিচ্ছেদ! মানুষের মন বদল হয়েছে। পথ ঠিকানা হারিয়েছে। আড্ডার আনন্দ কাউকে আপ্লুত করে না। অথচ এ শহরে শাহবাগের রেখায়নে জমত মেলা। পুরান ঢাকার বিউটি বোর্ডিং শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হকদের স্মৃতি বহন করে টিকে আছে কলকাতার কফি হাউসের মতো। আগের লেখকরা আড্ডা দিতেন। তাতে সাহিত্য আসত। এখন আসে দলবাজি আর গালাগালি। পরস্পরকে আক্রমণ আর হিংসা। এ যুগের বন্ধুরা আড়াল হলেই সমালোচনা ছাড়া অন্য কিছু উৎপাদন করতে পারে না। জাকারবার্গ ফেসবুক আবিষ্কার করে মানুষের হিংসা-বিদ্বেষে ভরা হৃদয়টা প্রকাশ্যে আনার সুযোগ দিয়েছেন। চাইলেই বুঝতে পারবেন আপনার পাশে চলা মানুষটি কতটা হিংসুটে, নোংরা, অভদ্র ও মিথ্যাবাদী। কোনো গবেষণার দরকার নেই। কাউকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। ফেসবুক ওয়াল দেখেই বুঝতে পারবেন এ যুগে বন্ধু হয় না কেউ। আপনি বিপদে পড়লে পাশের মানুষটি বেশি খুশি হবেন। যার সঙ্গে বেশি চলছেন তিনিই বদলে যাবেন চোখের পলকে। আপনার ওপর হামলে পড়বে। জীবন করে দেবে বীভৎস। আপনি মন খারাপ করবেন, তাতে আশপাশের কী যায় আসে!

এখন কেউ বিপদে পড়লে আপনজনরা বেশি খুশি হয়। ২৪ ঘণ্টা যার জন্য করছেন তিনি সবার আগে আপনার বিরোধিতা করবেন। পাড়াপড়শির কাছে আপনার খারাপ খবরটি জানান দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবেন। মানুষ চেনা বড়ই কঠিন। এরশাদ জমানায় কবি শামসুর রাহমানকে কিছু মানুষ অকারণে তুলাধুনা করত। তাঁর বন্ধু হিসেবে খ্যাত বড় কবিরা মজা নিতেন মদের আসরে। এক দিন শামসুর রাহমানকে বললাম, আপনার কাছের মানুষ কি কেউ নেই? কিছু নাম দিন যারা আপনার পক্ষে বলবে। তিনি বললেন, তুমি বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলতে পারো। ভীষণ সজ্জন। সামনে পেছনে আলাদা নন। তিনি আরও বললেন, অধ্যাপক সৈয়দ মন্জুরুল ইসলাম, কায়সুল হক তাঁরাও কথা বলবেন ইতিবাচক চোখে। এমন অনেক আরও সজ্জন আছেন। বললাম, তাঁদেরও আপনার পাশে ভিড় করতে দেখি না। যারা চাটুকারিতা করে তারাই আপনার সমালোচনা বেশি করে। কবি বললেন, জগতে এটাই নিয়ম। সবাই আপন, আবার কেউই নয়। কবির সামনে মারুফ রায়হান বসে ছিলেন। তিনিও মাথা নাড়লেন। সমালোচকদের বাজে ব্যবহারে কবির মন খারাপ থাকত। তার পরও চুপ থাকতেন। কাউকে কিছু বলতেন না। শিশুর মতো সরল ছিলেন শামসুর রাহমান। মন খারাপের গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতেন জম্পেশ আড্ডায়।

আশির দশকের সেই সময়ে কবি শামসুর রাহমান তল্লাবাগে থাকতেন। বেলাল চৌধুরী কাকরাইল। রফিক আজাদ ধানমন্ডি। ইমদাদুল হক মিলন গেন্ডারিয়ায়। শফদার নামে একজন কবি ছিলেন। তিনি পাটের বস্তা পরে এলোমেলো ঘুরতেন টিএসসি থেকে শাহবাগ। এ পোশাককে সবাই শৈল্পিকভাবে নিতেন। ঢাকার মাঝারি কবিরা তাঁকে সঙ্গে নিয়ে চলতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির পেছনে দলবেঁধে তাঁরা আড্ডা দিতেন। সিগারেট ফুঁকতেন। গাঁজাও থাকত। শফদারের পোশাকে এখন কেউ চললে সবাই পাগল ছাড়া কিছু বলবে না। সে সময় দুই বাংলার বড় লেখকের সবাই কমবেশি আড্ডাবাজ ছিলেন। মধ্যরাত অবধি মিলন ভাইয়ের গেন্ডারিয়ার বাড়িতে আমরা হইচই করতাম। রফিক আজাদ, বেলাল চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ অনেকে সে আড্ডায় যেতেন। আমার সঙ্গে বেশ কয়েকজন তরুণ রাজনীতিবিদ মিলন ভাইয়ের আড্ডায় যেতেন। আড্ডার পর নিচে নেমে পেতাম বেবিট্যাক্সি। আমাদের সবাইকে বাড়ি পৌঁছে দিত। মিলন ভাইয়ের আয়োজনটা খারাপ ছিল না। তখন ঢাকা শহরে যানজট ছিল না। মধ্যরাতে শুনসান নীরবতা। ঢাকা শহরও ছোট ছিল। এখন সব বদলে গেছে। সম্পর্কের সেই গভীরতাও। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ছিল। এখন সব শেষ। শিল্পসংস্কৃতিও দলকানাদের কাছে জিম্মি। সবখানে ডিভাইড অ্যান্ড রুল।

করোনাকালে আমরা চার বন্ধু একসঙ্গে আড্ডা দিতাম। সবাই মাস্ক পরে ভরদুপুরে এক হতাম গুলশান এসিসিএলে। লোকজন ঘর থেকে বের হতো না তেমন। হঠাৎ মনে হলো আমরা যে কোনো সময় মারা যাব। মৃত্যুর আগে কাছের বন্ধুরা আড্ডা দিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করব। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেবুর রস আর সেভেন আপের আড্ডা চলত। নিরাপদ দূরত্বে বসে লাঞ্চ শেষ করতাম। খাবারের মেন্যু পছন্দ করতেন পীর হাবিবুর রহমান। হাওরের সংস্কৃতিতে প্রাণবন্ত পীর ছিলেন ভোজনরসিক। খেতে ও খাওয়াতে পছন্দ করতেন। হিউমার করতেন সারাক্ষণ। দুবার কভিডে আক্রান্ত হয়েছিলাম। ভাবতাম কে কখন চলে যাব জানি না। আমাদের সেই চারজনের একজন পীর হাবিব চলে গেলেন করোনার শেষ দিনগুলোয়। ওপারে পীর কেমন আছেন জানি না। নুর মোহাম্মদ এবার এমপি হয়েছেন। শাম্মী ছেড়েছেন সেনা কর্মকর্তার চাকরি। নুর মোহাম্মদকে নিয়ে পীর মজা করতেন। তারা দুজন আলাদা গোপন কথা বলতেন। পীরকে শর্ত দিতেন নুর মোহাম্মদ আমাকে যেন কোনো কিছু না জানানো হয়। পরের আড্ডায় পীর মজা করে সবকিছু বলে দিতেন। আড্ডা আরও জমত। কোনো কিছু গোপনীয় থাকত না। বন্ধু পীর হাবিবুর রহমান যাওয়ার দুই বছর পার হয়ে গেল। সময় থেমে থাকে না। এ জগৎ ক্ষণস্থায়ী। হয়তো আমরাও একদিন পীর হাবিবকে খুঁজতে চলে যাব। কেউই থাকব না এ দুনিয়াতে।

করোনাকালে আমরা হারিয়েছিলাম অনেক গুণী মানুষকে। তাঁদের একজন অভিনেত্রী কবরী। বাইরে কঠিন একটা ভাব নিয়ে চলতেন। ভিতরে ছিলেন দারুণ একজন মানুষ। মৃত্যুর আগে মিডিয়ায় তাঁর একটা বক্তব্য তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। কবরী আক্ষেপ করেছিলেন। বলেছিলেন সারা জীবনে একজন ভালো বন্ধুর অভাবের কথা। যার সঙ্গে একসঙ্গে বসা যায়। খাওয়া যায় এক কাপ চা। হাত ধরে ঘোরা যায়। কবরীর মতো আক্ষেপ নিয়ে একটা জীবন অনেকেই কাটিয়ে দেন। তারপর চলে যান না-পাওয়ার বেদনা নিয়ে। অজানা দাহ নিয়ে সুচিত্রা সেন অন্তরালে কাটালেন শেষ জীবনটা। মানুষের সামনে আসতেন না। কারও মুখোমুখি হতেন না। ছবি তুলতেন না। নিজেকে আড়ালে রেখেই সুচিত্রা চলে গেলেন। সবাই এভাবে পারে না। বেশির ভাগ মানুষ দীর্ঘশ্বাসটা নীরবে লালন করে। নিজেকে আড়ালে লুকিয়ে রাখে। না-বলা কথাগুলো বলে যায় না। লিখে রাখে না। করোনার ঠিক আগে আগে দেখতে গিয়েছিলাম বুদ্ধদেব গুহকে। বাড়িতে যেতেই তাঁর মেয়ে জানালেন, আমাকে সোজা বেডরুমে যেতে বলেছেন। রঙিন লুঙ্গি পরে বসে আছেন বিখ্যাত এই লেখক। জীবনে তাঁকে এমন ড্রেসে দেখিনি। সব সময় ধোপদুরস্ত চলতেন। স্যুট-টাই পরতেন। তাঁর চলাফেরায় একটা বনেদি ভাব ছিল। গল্প করতে করতে তিনি ফরিদা ইয়াসমিনকে বললেন, তোমার স্বামীর ওপর খেপে আছি। ফরিদা কিছু বলার আগে বললাম, মন খারাপ নাকি? কী করেছি বলুন। তিনি বললেন, তুমি আমাকে বাংলাদেশে নিয়ে যাচ্ছ না। তুমি অন্য দুই লেখককে নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলে। ছোটবেলার স্মৃতিঘেরা বরিশাল আর রংপুর আমার আর দেখা হলো না। মন ভীষণ টানছে সেই স্মৃতির শহর দেখতে। বললাম, আপনার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। সুস্থ হয়ে উঠুন। মেয়েকে নিয়ে আসুন। সব ব্যবস্থা করে রাখব। তিনি বললেন, মেয়ে সময় পাবে না। বললাম, আপনাকে চলাফেরায় সহায়তাকারী দুজনকে নিন। ঘুরিয়ে আনব আপনার রংপুর ও বরিশাল। বুদ্ধদেব গুহের বাংলাদেশে আর আসা হলো না। তিনিও চলে গেলেন। শেষ বয়সে নস্টালজিক হয়ে উঠেছিলেন। শৈশবের স্মৃতিচারণা করলেন। তাঁর বাবা ছিলেন ব্রিটিশ আমলের সরকারি কর্মকর্তা। বদলির চাকরি। এ কারণে বরিশাল ও রংপুরে কিছু বছর কাটিয়েছিলেন। শেষ বয়সে এসে আবার সেই স্মৃতিতে হারিয়েছিলেন। ব্যবস্থাও করেছিলাম বাংলাদেশে আসার। হঠাৎ করোনার আগমনে সবকিছু বদলে গেল। বুদ্ধদেব গুহ এখন না-ফেরার দেশে। আর ফিরবেন না। বলবেন না, নিয়ে চলো রংপুর ও বরিশাল। শৈশবে হারিয়ে যাব আবার।

                লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

সর্বশেষ খবর