রবিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

এ প্রবণতা ভালো লক্ষণ নয়

প্রিন্সিপাল এম এইচ খান মঞ্জু

 এ প্রবণতা ভালো লক্ষণ নয়

প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও এক বা একাধিক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি বেসরকারি সংস্থার হিসাবে গত বছর ৫১৩ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তার মধ্যে ৬০ শতাংশ ছাত্রী, ৪০ শতাংশ ছাত্র। সংস্থাটি জানিয়েছে, আত্মহত্যাকারীর ৬৭ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৯ বছর। স্কুল পর্যায়ের ২২৭ শিক্ষার্থী গত বছর আত্মহত্যা করেছে, যা আত্মহননকারী মোট শিক্ষার্থীর ৪৪ শতাংশ। কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থী ১৪০ জন (২৭ শতাংশ), বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৯৮ জন (১৯ শতাংশ) এবং মাদরাসা শিক্ষার্থী ৪৮ জন (৯ শতাংশ)। ২০২২ সালে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসার মোট ৫৩২ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছিল। এত শিক্ষার্থী যদি প্রতি বছর আত্মহত্যা করতে থাকে তবে জাতির অবস্থা আগামীতে কী দাঁড়াতে পারে, সহজেই অনুমান করা যায়। আত্মহত্যার পেছনে আবেগীয় কারণ, মানসিক কারণ, ব্যর্থতা, হতাশা ইত্যাদি যা কিছুই থাক তার জন্য প্রধানত আত্মনিয়ন্ত্রণের অক্ষমতাই দায়ী। সামাজিক বৈষম্য, পারিবারিক কলহ, মাদক, ইন্টারনেটের অপব্যবহার, সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের উদাসীনতা, পারিবারিক বন্ধন ফিকে হয়ে আসার মতো কারণগুলো প্রকট আকার ধারণ করায় মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার মতো জঘন্য অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে। এ ছাড়া নৈতিক স্খলন, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার, ব্ল্যাকমেইলিং অনেককে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আত্মহত্যা প্রবণতা বৃদ্ধি দেশের জন্যই ভালো লক্ষণ নয়। এজন্য পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালকরা দায় এড়াতে পারেন না। নীতি-আদর্শ ও ধর্মচর্চা পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে কমে গেছে। মূল্যবোধের প্রতি আস্থা হ্রাস পেয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবেগ নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা, সামাজিক বন্ধন ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পেলে আত্মহত্যার হার ও সংখ্যা কমে আসতে পারে।

শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, দেশের বিভিন্ন বয়সী মানুষ অবলীলায় আত্মহত্যা করছে। এক পরিসংখ্যানমতে, প্রতি বছর দেশে অন্তত ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থী ও যুবকরাও আত্মহত্যা করছে। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, বৈষম্য, অবিচার এর প্রধান কারণ। আত্মহত্যা মহাপাপ। ইসলামে আত্মহত্যা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। অন্যান্য ধর্মেও। তাই আত্মহত্যা প্রতিরোধ বা কমাতে হলে ধর্মের অনুশীলন, চর্চা ও অনুসরণ বাড়াতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় এর প্রতিফলন থাকতে হবে। আত্মহত্যার অন্য যেসব কারণ আছে তা অপনোদনের ব্যবস্থা নিতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রে সুশাসন, সুবিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে আত্মহত্যা নিরোধে তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। আত্মহত্যার ঘটনা নির্মূলে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ ও প্রয়াস থাকলেও এ প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। তবে প্রচেষ্টাগুলো আরও বেশি মনোযোগ পাওয়ার দাবি রাখে। পাশাপাশি অবকাশ রাখে নতুন ভাবনা ভাবার। শিল্পায়নের সঙ্গে নগরায়ণ, একই সঙ্গে প্রযুক্তি-নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় পাল্লা দিয়ে সমাজ নানা জটিল বাঁক নিচ্ছে। আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক মূল্যবোধগুলো দিন দিন হালকা হয়ে যাচ্ছে। সঠিক সামাজিকীকরণ, শক্তিশালী ও কার্যকর সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধগুলো ধারণ ও লালন, সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সংহতি স্থাপন সম্ভব হলে তা হবে আত্মহত্যা নিরসনের মূল হাতিয়ার। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটকে আরও বেশি শক্তিশালী করা প্রয়োজন এবং বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যন্ত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়া বিশেষভাবে প্রয়োজন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-গুলোয়ও জরুরি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে হবে। মেয়েদের জন্য তৈরি করতে হবে সামাজিক সুরক্ষার বলয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মেয়েরা শুধু মেয়ে হওয়ার কারণেই নানা সংকটের সম্মুখীন হয়, যা তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার আবহ তৈরি করে। সেই সঙ্গে নারীবান্ধব নীতি প্রণয়ন ও এর যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হতে হবে। কেউ কোনো সমস্যায় আক্রান্ত হলে তার সঠিক চিকিৎসা না হলে বিষণœতা ও হতাশায় নিমজ্জিত হয়। ভুগতে থাকে মানসিক রোগে। আর এর শেষ পরিণতি গিয়ে ঠেকে আত্মহত্যায়।

আত্মহত্যা মহাপাপ। আইন অনুযায়ী অপরাধ। জগতের সব ধর্ম এবং নীতিশাস্ত্রে আত্মহত্যার সমর্থনে কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। তাহলে কেন মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়? আত্মহত্যা নিরসনে সরকারি-বেসরকারি নানাবিধ উদ্যোগ ও প্রয়াস রয়েছে, তথাপি আত্মহত্যা ঘটছেই। আত্মহত্যার পেছনের গল্প যদি তালাশ করি তাহলে স্বভাবতই যে চিত্রটি মানসপটে ভেসে আসে তা হলো যৌতুক, বেকারত্ব, পারিবারিক কলহ, প্ররোচনা, চাপ, হতাশা, প্রেমে ব্যর্থতা, চাহিদা এবং আকাক্সক্ষার মাঝে ফারাক, নেতিবাচক চিন্তা, জীবনের উদ্দেশ্যহীনতায় হীনম্মন্যতা, আস্থাহীনতাসহ নানা উপাদান অনুঘটক হিসেবে রসদ জোগায়। এ থেকে পরিত্রাণের পথ কী? এ থেকে পরিত্রাণে মানসিক চিকিৎসা, ইতিবাচক মনোভাব, সহমর্মিতা, বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো, বক্তব্য শেয়ার করার পরিবেশ তৈরি, আত্মসমালোচনা। আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে সমাজের নীতিনির্ধারকদের সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে হবে। আর ছেলেমেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। একই সঙ্গে সিনেমা-নাটক, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় জীবন সম্পর্কে সচেতন হওয়া ও আত্মহত্যার কুফল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে পারলে তবেই আত্মহত্যা প্রবণতা অনেকটা কমে আসবে। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার পেছনে যেসব কারণ দায়ী তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা না নিলে এর প্রবণতা বাড়তেই থাকবে। তাই আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবাইকে সজাগ, সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে, সবাইকে সচেতন করতে হবে।

 

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রিন্সিপাল, এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ

সর্বশেষ খবর