শিরোনাম
সোমবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

নবীজি (সা.)-এর রাষ্ট্রনীতি

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

নবীজি (সা.)-এর রাষ্ট্রনীতি

আধুনিক ইসলামী গবেষকরা বলছেন, ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র গঠন হবে এ নিয়ে ইসলামের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। আমরা দেখেছি রসুল (সা.) ওফাতের সময় তাঁর স্থলাভিষিক্ত শাসক কে হবেন এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কিছু বলে যাননি। ফলে জনগণ হজরত আবু বকর (রা.)-কে রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসেবে নির্বাচন করে নেয়। পরবর্তীতে হজরত আবু বকর (রা.) হজরত ওমরকে নিজের স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করে যান। হাজার হাজার সাহাবি ও তাবেয়ি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তাঁর আনুগত্য করেন। আবার হজরত ওমর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে কাকে নির্বাচন করা যায় এজন্য একটি ছয় সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করেন। এভাবে তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান (রা.) খেলাফতের দায়িত্বে আসেন। খলিফা বা রাষ্ট্রপ্রধান যে প্রক্রিয়াতেই নির্বাচিত হোক না কেন সেটা বড় বিষয় নয়, কোরআনের দৃষ্টিতে বড় বিষয় হলো ন্যায়-ইনসাফের সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। পক্ষ-বিপক্ষের সব জনগণ সমান অধিকার পাবে এটাই কোরআনের রাষ্ট্র পরিচালনার বড় নীতিমালা। আসলে রাষ্ট্রে যদি ন্যায়বিচার থাকে, ইনসাফ থাকে তাহলে সেখানে কম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি রাষ্ট্রপ্রধান হলেও তাতে ইসলামের বড় কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু রাষ্ট্রে যদি ইনসাফ প্রতিষ্ঠা না থাকে আর সবচেয়ে পরহেজগার ব্যক্তি রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হন তাতে জনগণের খুব একটা উপকার হবে না। ইসলামের ইতিহাসে অনেক কম পরহেজগার ব্যক্তি রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন এটা ঠিক, তবে যখনই ইনসাফের ব্যত্যয় ঘটেছে, তখনই একদল প্রতিবাদী আলেম জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছেন।

কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অনেকগুলো মৌলিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ন্যায়বিচার একটি। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! আপনি বলুন, আমাকে আদেশ করা হয়েছে যেন তোমাদের মাঝে ন্যায়বিচার করি।’ (সুরা শুরা, আয়াত ১৫) আরবি ‘আদল’ শব্দের অর্থ ন্যায়, ইনসাফ, ন্যায্যতা, নিরপেক্ষ, সমান। পরিভাষায়, যে যতটুকু যোগ্য তাকে ততটুকু প্রদান করাকে ন্যায়বিচার বলে। আল্লাহর এক নাম আদল বা আদিল। কেননা তিনি যোগ্যতা অনুযায়ী মানুষ ও সৃষ্টিকুলের মাঝে ভালোমন্দ বণ্টন করে থাকেন। যিনি ন্যায়বিচার করেন তাঁকে বলা হয় আদিল। আর যে স্থানে ন্যায়বিচার করা হয় তাকে বলা আদালত।  কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রধান অবশ্যই আদিল তথা ন্যায়বিচারক হবেন। তাঁর দেখাদেখি রাষ্ট্রের নির্বাহী ও বিচারিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিটি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ন্যায়বিচার করবেন। ন্যায়বিচারের সহজ অর্থ হলো- সব ধরনের দলাদলি থেকে দূরে থেকে নিরপেক্ষ বিচার করা। দলীয় স্বার্থ কিংবা বিরোধীপক্ষকে পরাস্ত করার মানসিকতা থেকে মুক্ত হয়ে বিচার করা। আপন-পর, দলীয়-বিরোধী সব মানুষের সঙ্গে সমান সম্পর্ক বজায় রাখা। আর সে সম্পর্কে ভিত্তি হবে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার। কোনো রায় যদি বিচারকের নিকটাত্মীয় বা দলীয় লোকের বিরুদ্ধেও যায় তবুও সে রায় কার্যকর করতে হবে নির্র্দ্বিধায়। আবার কোনো রায় যদি দূরের কোনো মানুষ কিংবা ব্যক্তির শত্রুতা আছে অথবা মতের অমিল রয়েছে এমন কারও পক্ষে যায় তবুও সে রায় কার্যকর করতে হবে বিনা বাক্যে।

আমরা যদি রসুলের জীবনের দিকে তাকাই তাহলে দেখব তিনিও ন্যায়বিচারের সবগুলো প্যারামিটারে ছিলেন আপসহীন। একবার মক্কার এক সম্ভ্রান্ত নারী চুরির দায়ে পাকড়াও হয়। নবীজি (সা.) কোরআনের ক্রিমিনাল কোড অনুযায়ী তার হাত কাটার শাস্তি ঘোষণা করেন। কেউ কেউ বলল, উনি তো সম্মানিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার জন্য শাস্তি কিছুটা সহজ করা যায় কি না বা মওকুফের কোনো সুযোগ আছে কি না? এমন প্রস্তাব শুনে রসুল (সা.) দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের আগে যেসব জাতি অতিবাহিত হয়েছে তারা ঠিক এ কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে। তারা দুর্বল অপরাধীদের কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করত আর প্রভাবশালীদের ছেড়ে দিত। আল্লাহর কসম! আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য আমার মেয়ে ফাতেমাও যদি আজ চুরি কত, তবে আমি অবশ্যই তার হাত কেটে ফেলতাম।’ (বুখারি, কিতাবুল হুদুদ)। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের জন্য ন্যায়বিচার শর্ত। আর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য শর্ত হলো নির্লোভ থাকা। তাফসিরে কুরতুবি থেকে জানা যায়, ওলিদ ইবনে মুগিরা ও শায়বা ইবনে রাবিয়া ছিলেন মক্কার প্রভাবশালী দুই নেতা। তারা একবার রসুলের (সা.) দরবারে এসে বলল, হে মুহাম্মদ! তুমি যে ধর্মের দাওয়াত দিচ্ছ সেটা বন্ধ করে দাও। বিনিময়ে ওলিদের সব সম্পদের অর্ধেক আর মুগিরার অতি রূপবতী কন্যা তোমাকে দিয়ে দেওয়া হবে। এমন লোভনীয় প্রস্তাবের জবাবে আল্লাহতায়ালা সুরা শুরার ১৫ নম্বর আয়াত নাজিল করে সাফ জানিয়ে দেন- ‘হে নবী! আপনি বলুন, আমাকে আদেশ করা হয়েছে যেন তোমাদের মাঝে ন্যায়বিচার করি।’ আজকের মুসলিম বিশ্ব অনেক দিকে এগিয়েছে। অনেক আধুনিক হয়েছে। প্রযুক্তিসমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু কোনো কোনো দেশে এখনো ইনসাফ ও ন্যায়বিচার অধরা রয়ে গেছে। এ দুর্বলতা সাধারণ কোনো দুর্বলতা নয়। বরং রসুলের (সা.) ঘোষণা অনুযায়ী একটি জাতি ধ্বংস হওয়ার জন্য বেইনসাফি সমাজই যথেষ্ট। আল্লাহতায়ালা মুসলিম বিশ্বে ইসনাফ ও ন্যায়বিচারের সুবাতাস বইয়ে দিন। আমিন।

 

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব আউলিয়ানগর।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর