মঙ্গলবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

মিয়ানমার সমস্যার শেষ কোথায়

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

মিয়ানমার সমস্যার শেষ কোথায়

তখন আমি বেশ ছোট। সেটা ১৯৫৮ সাল। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী হাউসের মধ্যেই আক্রান্ত হয়ে গুরুতর আহত হন। পরে তিনি মারা যান। প্রাদেশিক পরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ তখনকার বার্মা এখন মিয়ানমার, সেখানে সামরিক শাসন জারি করা হয়। নে উইন ছিলেন বার্মার রাষ্ট্রপতি। স্বাধীনতা তার হাত ধরেই এসেছিল। তাকে সরিয়ে দিয়ে সামরিক শাসন জারি করা হয়। সেই যে বার্মা বা মিয়ানমারে গণতন্ত্র বিদায় নেয়, তা অদ্যাবধি ফিরে আসেনি। মাঝখানে হঠাৎই অং সান সু চি নির্বাচিত হয়েছিলেন কদিনের জন্য। দুই বছর হলো তারও ক্ষমতা চলে গেছে। আবার সামরিক জান্তা। আমরা এমন একটি অবস্থানে বাস করি, যেখানে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কিলোমিটার ভারতীয় সীমান্ত। পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর প্রায় সবটাই ভারত। পূর্বে শুধু দেড় শ-দুই শ কিলোমিটার মিয়ানমার বা বার্মা, দক্ষিণে পুরোটাই  বঙ্গোপসাগর। যতকাল পৃথিবী ধ্বংস না হবে রাষ্ট্রীয় কাঠামো অবশ্যই অদলবদল হতে পারে। কিন্তু ভৌগোলিক সীমারেখা ভূখন্ড যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকবে। একসময় আমরা সবাই ছিলাম একই ভূখন্ডের অধিবাসী। বেশকিছু সময় ২০-৩০ হাজার কিলোমিটারের রাখাইন ছিল আমাদেরই সঙ্গে। দু-একবার রাখাইন বার্মার দখলে গেছে। এখন যেমনটা আছে। পাকিস্তানের নেতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উদাসীনতায় এ অঞ্চল আমাদের হাতছাড়া হয়েছে। আসাম, মেঘালয়, পশ্চিমবঙ্গের সবটুকু নিয়ে হওয়ার কথা ছিল পূর্ব পাকিস্তান। কিন্তু পশ্চিমা নেতারা কার গোয়ালে কে ধোঁয়া দেন, এমনকি সিলেট, তার পাশে শিলচর সবই ভারতে যাওয়ার কথা ছিল। কিছু নেতা রুখে না দাঁড়ালে সিলেট আমাদের থাকত না। ভোটের মাধ্যমে সিলেট আমাদের দিকে এসেছে। তাই আমাদের প্রবীণ নেতাদের এ অঞ্চল সম্পর্কে যতটা ভাবার কথা ছিল, কখনো তেমন গুরুত্ব দিয়ে ভাবেননি। এক্ষেত্রে হুজুর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর তীক্ষè দৃষ্টি ছিল অভাবনীয়। সেখানে যুবনেতা শেখ মুজিব তাঁকে ছায়ার মতো অনুসরণ করেছেন। এটা অবধারিত সত্য, আজ যে যত হাত-পা ছোড়াছুড়ি করুন, যে যত বাহাদুরি করুন, সেই সময় যুব শেখ মুজিব ৩০০-৪০০ ভলান্টিয়ার নিয়ে সিলেট কাঁপিয়ে না তুললে আমাদের হতো না। ইসলামী দল সবই ছিল সিলেট যাতে ভারতের দিকে যায় তার পক্ষে। সময় সময় মত ও পথের অদলবদল হয়। আমাদেরও অনেক ক্ষেত্রে হয়েছে। আমাদের যদি আসাম থাকত, মেঘালয় থাকত, পশ্চিমবঙ্গের পুরোটা থাকত, মিয়ানমার আরাকান আমাদের থাকত তাহলে আমাদের ভূখন্ড যেমন তিন-চার লাখ কিলোমিটার হতো তেমনি লোকসংখ্যাও হতো ৩৫-৪০ কোটি। প্রাকৃতিক সম্পদে আমরা থাকতাম ভরপুর। আশপাশে কারও কাছে হাত পাততে হতো না। বরং দুনিয়ার অনেকেই আমাদের কাছে হাত পাততেন। কিন্তু যা হয়নি, তা হয়নি। তা নিয়ে আফসোস করার কোনো কারণ দেখি না। তবে যা হয়েছে তা নিয়ে তো দক্ষতা যোগ্যতার সঙ্গে অগ্রসর হওয়া উচিত। তাও যখন বাধাগ্রস্ত হয় তখন স্বাভাবিক কারণে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করি।

মিয়ানমারকে নিয়ে আমাদের সমস্যা দীর্ঘদিনের। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে কিছু কিছু যুদ্ধবন্দি এবং পাকিস্তানি হানাদার ঢাকা থেকে পালিয়ে প্রথমে মিয়ানমার, সেখান থেকে পাকিস্তানে যায়। ব্যাপারটা একটা ট্রানজিটের মতো ছিল। সেই কবে রোহিঙ্গা উত্তেজনায় কক্সবাজারে লাখো মুসলিম রোহিঙ্গা আশ্রয় গ্রহণ করে। যে কয় লাখ তখন এসেছিল তার কয়েক হাজার-ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করতে পারেনি। তারা ক্যাম্পে ক্যাম্পে কষ্টকর অমানবিক জীবনযাপন করতে করতে আবার আমার বোন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নেত্রী শেখ হাসিনার আমলে সাত-আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশের অত ভূখন্ড নেই যে কাউকে জায়গা দিতে পারে। বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে প্রধান ঘনবসতির দেশ। কোনো কোনো দেশে কিলোমিটারে ১০-২০ জন জনসংখ্যা, আমাদের কিলোমিটারে দুই-তিন হাজার। এমন মারাত্মক পরিস্থিতিতে অন্য দেশের লোকদের বা নাগরিকদের আমাদের জায়গা দেওয়া খুব একটা সহজ নয়। কিন্তু তারপরও ২০১৭ সালের দিকে যখন বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন বাংলাদেশ সব কপাট খুলে দেয়। যাতে বাংলাদেশের মানবিকতা বঙ্গবন্ধুকন্যা নেত্রী শেখ হাসিনার উদারতা সারা বিশ্বকে স্পর্শ করে, অনেকে তাকে তখন মানবতার মা বলে সম্বোধন করতে থাকে। রোহিঙ্গাদের মানবিক সহযোগিতার সুযোগ ভালোভাবে কাজে লাগানো হয়নি। একটা জাতীয় ঐক্য সৃষ্টিতে কোনোরকম ভূমিকা নেওয়া হয়নি। সেই উত্তেজনাকর সময় বোন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটা জাতীয় ঐক্যের যদি চেষ্টা নেওয়া হতো আর সেটা যদি অর্ধেকও সফল হতো তাহলে রোহিঙ্গা সমস্যা অনেক আগেই সমাধান হয়ে যেত এবং সেখান থেকে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত নয়, অনেক বেশি লাভবান হতাম। তখন সঙ্গে সঙ্গেই একটি জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করা যেত। জামায়াত ছাড়া সব রাজনৈতিক দলকে এক মোহনায় আনতে আপ্রাণ চেষ্টা করা যেত। তখন যে জাতীয় অনুভূতি ছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বা তাঁর ডাকে সাড়া না দিয়ে অনেকের তেমন উপায় ছিল না। কারণ জাতীয়ভাবে রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের বুকভরা দয়ামায়া ভালোবাসা ছিল। দেশে যে রাজনৈতিক অবস্থা তাতে সত্যিই আওয়ামী লীগ-বিএনপির কোনো ক্ষেত্রেই কোনো কাজেই পাশাপাশি চলার খুব একটা সুযোগ নেই। এখন যেমন আজ থেকে আট-দশ বছর আগে এতটা বিভাজন ছিল না, তখন নেত্রী শেখ হাসিনার ডাকে বিএনপি সরাসরি সাড়া না দিলে তারা এবং তাদের নেতৃত্ব কর্তৃত্ব অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতো। তাই অতটা সুবিধা ছিল না যে ইচ্ছা করলেই তারা মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারতেন। দেশের জন্য দেশের কথা চিন্তা করে মানুষের আস্থা অনাস্থার কথা চিন্তা করে তাদের অনেক কিছু ভাবতে হতো। যদিও এখন তেমন জাতীয় ঐক্যের অনুকূল পরিবেশ নেই। কিন্তু তখন ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন শেখ হাসিনা সবাইকে ডেকে যদি যার যার দায়িত্ব দিয়ে সারা পৃথিবীতে প্রতিনিধি প্রেরণ করতে পারতেন তাহলে অনেকটাই আমাদের পক্ষে সুফল আসত। আমাদের যে কজন ফরেন সেক্রেটারি ছিলেন, মন্ত্রী ছিলেন, যারা সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়ান, রাজনৈতিক-সামাজিক-ব্যবসায়ী সবাইকে কাজে লাগাতে পারতেন। বেগম খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে ড. কামাল হোসেন, বদরুদ্দোজা চৌধুরী, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, আ স ম আবদুর রব, আবুল হাসান কায়সার চৌধুরী। এককথায় যাকে যেখানে লাগালে কাজ হতো তাকে সেখানেই দায়িত্ব দেওয়া উচিত ছিল। আমাদের দেশে কত চৈনিকপন্থি আছেন। তাদের চীনের দায়িত্ব দেওয়া যেত। রাশিয়া, আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ভারত যেখানে যার যোগাযোগ সেখানেই তাকে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সমাজবাদী নেতা কট্টর নেহরুবিরোধী রাম মনোহর লহিয়ার একনিষ্ঠ ভক্ত শিষ্য সে সময়ের দ্বিতীয় গান্ধী বলে সারা ভারতে পরিচিত সর্বোদয় নেতা শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণকে তাঁর ব্যক্তিগত বিশেষ দূত হিসেবে সারা পৃথিবীব্যাপী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরতে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এই সমাজবাদী নেতা বিশ্বের বারোআনা রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানুষকে ভারতের পক্ষে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থনের যুক্তিকতা তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং যার ফলশ্রুতিতে একসময় সারা বিশ্বের প্রায় সব মুক্তিকামী মানুষ আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, সমর্থন দিয়েছেন, সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। পৃথিবীর প্রায় সবকটি সরকার ছিল আমাদের বিরুদ্ধে। অথচ দুনিয়ার সব মানুষ ছিল আমাদের পক্ষে, স্বাধীনতার পক্ষে।

মনে হয় বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা প্রশ্নে তার চেয়েও অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন। অনেক ভালো করতে পারতেন। যাক যা হয়নি তা হয়নি। তা নিয়ে আফসোস করে খুব একটা লাভ নেই। কিন্তু সামনে যা হচ্ছে বা হবে তা তো আমাদের সফলভাবে করা উচিত। চোখ মুদিলেই প্রলয় বন্ধ হয় না। আমরা শান্তিপ্রিয় দেশ। বলে চলেছি, কারও সঙ্গে যুদ্ধ নয়, শান্তিই আমাদের কাম্য। সত্যিই আমরা কার সঙ্গে যুদ্ধ করব? যে কোনো সশস্ত্র বাহিনী যখন তার দেশ বা সীমানা রক্ষায় সামান্যতম কাজও করে তখন তার মধ্যে একটা গৌরব, দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকারের একটা মহিমা দেহ-মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রতিটি সৈনিকের মধ্যে দেশপ্রেমের পবিত্রতা ছড়িয়ে পড়ে। মাতৃভূমি একটা মস্তবড় জিনিস। মায়ের চাইতে খুব একটা কম আদরণীয় নয়, কম সম্মানের নয়। যুদ্ধ আমরা অনেকেই চাই না। তবু মাঝেসাজে হয়। সারা পৃথিবীতে ছোটখাটো যুদ্ধ-বিবাদ লেগেই আছে। একেবারে নির্বিবাদী নিরহংকারী দেশ চলে না। অহংকারীকেও নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। কাউকে অবাধ ছেড়ে দিলে পরিণাম ভয়াবহ হয়। সব শক্তির প্রধান নিয়ামক হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ। যে কোনো নিয়ন্ত্রিত শক্তি কল্যাণকর, কল্যাণময়ী, সমাজের জন্য শুভকর। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত কোনো কিছুই কারও জন্য ভালো নয়। মিয়ানমারে যা ঘটছে তা শুধু মিয়ানমারের জন্য কেন, সারা মানব জাহানের জন্য ক্ষতিকর। আরাকানের প্রায় ১৪-১৫ লাখ রোহিঙ্গা যুগ যুগ ধরে আমাদের দেশে বসবাস করবে এটা কোনোমতেই সুস্থ মস্তিষ্কে ভাবা যায় না। আমাদের বিশাল ভূখন্ড থাকলেও সম্ভব ছিল না। একটা মানব গোষ্ঠীর যত রকম চাহিদা থাকে, শিক্ষা-সংস্কৃতি-অর্থ-বাসস্থান সবকিছুই তাদের প্রয়োজন। সেটা তারা পরদেশে কী করে পূরণ করবে? একটা মস্তবড় জনগোষ্ঠী স্বাভাবিকভাবে যদি কেউ বেড়ে উঠতে না পারে তাহলে আজ হোক বা কাল হোক বিশ্বের জন্য তারা এক ব্যাপক অশান্তির কারণ হতে পারে। আর স্বাভাবিক জীবন পেলে ওই আরাকানের উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে হয়তো বিশ্বজয় করা কোনো উদ্ভাবনী শক্তির জন্ম দিতে পারে বা পারত। কিন্তু দীর্ঘ সময় এ অসুস্থ পরিবেশে কোনো কিছুই ভালোর দিকে এগোচ্ছে না। যা এগোচ্ছে সবই খারাপের দিকে।

আমাদের ভূখন্ডে মিয়ানমারের ছোড়া গোলা এসে পড়ছে। রকেট শেল, মর্টার শেল এসে পড়ছে। কতটা পড়ছে সেটা বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য একটা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের মাটিতে অন্য দেশের কোনো আগ্নেয়াস্ত্র আঘাত হানতে পারে কি না সেটা একটা হোক আর কোটি কোটি হোক, সে অস্ত্র ছোট হোক আর বড় হোক? আঘাত করলে সেটা কতটা অপরাধ এবং তার জবাব কীভাবে দেওয়া উচিত। আমাদের নেতৃবৃন্দ বলে চলেছেন আমরা যুদ্ধ চাই না। তাদের সাধুবাদ জানাই। কিন্তু যুদ্ধ আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে আমরা পালিয়ে যাব, না শিনা টান করে রুখে দাঁড়াব? আমাদের সামনে যদি রুখে দাঁড়ানোর পথ না থাকে তাহলে এত রক্ত ঢেলে স্বাধীনতা কেন? আমরা গোলাম থাকলেই তো ভালো করতাম। এটা জানি, আমাদের মত, আমাদের চিন্তা-চৈতন্য, আমাদের কথাবার্তা অনেকের পছন্দ হয় না, তারা ভেবেও দেখেন না। কিন্তু যে কথা মিথ্যা নয়, যে কথার বাস্তবতা আছে, যুক্তিপূর্ণ কোনো কথা কার কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, কে বলল সেটা বড় কথা নয়, কথাটা সত্য কি না। পরম শত্রু দেশের কল্যাণে কোনো কথা বললে তাকে অবশ্য অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।

২০১৭ সালে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে প্রায় এক মাস বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম। সেই সময় বলেছিলাম, এত রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে গিয়ে বাংলাদেশ হিমশিম খাবে। বরং জাতিসংঘের সঙ্গে কথা বলে বাংলাদেশের পাশে রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য আরাকানে একটা নির্দিষ্ট এলাকা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে চিহ্নিত করে সেখানে তাদের নিরাপদে বসবাসের ব্যবস্থা করা যেতে পারত। এমনিতেই পৃথিবীর বহু দেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী হিসেবে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। কক্সবাজারের পাশে আরাকান রাজ্যের কিছু অংশ অথবা পুরো আরাকান জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী শান্তিরক্ষী বাহিনীর দায়িত্ব পালন করতে পারে। বাড়ির কাছেই তারা শান্তিরক্ষী বাহিনীর দায়িত্ব পালন করল। এতদিন মিয়ানমার সরকারের নিপীড়নে সাধারণ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে জীবন বাঁচাতে আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছে। এবার কী হচ্ছে? সরকার বলছে কোনো রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেব না। তাহলে এতকাল যারা জুলুম করেছে, জান্তা বাহিনীর হয়ে তারা যখন বিপ্লবীদের হাতে অথবা মুক্তিকামী যোদ্ধাদের হাতে মার খেয়ে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে এলো তাদের কেন আশ্রয় দেওয়া হলো? এটাই আল্লাহর বিধান। একসময় যারা নিরীহ মানুষকে হত্যা করে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেশান্তরী করেছে, এখন তাদের নিজের দেশে জীবন বাঁচাবার সুযোগ নেই। কী মজার ব্যাপার! নমুনা হিসেবে যারা এসেছে, সেখানে সেনা আছে, সীমান্তরক্ষী আছে, পুলিশ আছে, জান্তা সরকারের কর্মচারী আছে, মিলিটারি জান্তার পক্ষের দালাল আছে। সরকার বলছে, এদের দেশে পাঠাবে। কার কাছে পাঠাবেন? এখন তো তাদের ঠিকানাই নেই, সরকারই নেই, কী দিয়ে পাঠাবেন? জাহাজ করে? জাহাজ ঘাট কি সরকারি নিয়ন্ত্রণে আছে?

জাহাজ পথ কি নিয়ন্ত্রণে? অনেক প্রশ্নের উত্তরও তো অনেকই দিতে হবে। যারা জীবন বাঁচাতে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, কয়েকজন তো আবার পরিবার-পরিজন নিয়েই এসেছে, তারা যেতে না চাইলে তাদের কী করে পাঠাবেন? সরকারি আনুগত্য ভঙ্গ করে তারা ভিনদেশে এসেছে। দেশে ফেরত পাঠালে তাদের জীবন নিরাপদ কি না সেটা ভেবে দেখতে হবে না? বাংলাদেশ ফেরত পাঠাতে চাইলে আর মিয়ানমার জান্তা সরকার ফেরত নিলেই শেষ কথা না। এখানে তো বিশ্বজনমত আছে, বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থা আছে। যারা স্বেচ্ছায় যাবেন সেটা ভিন্ন কথা। যাদের জীবনের ঝুঁকি আছে, হুমকি আছে, জীবন নিরাপদ নয় এমনটা যারা ভাববে তাদের ইচ্ছা করলেই কি ফেরত পাঠানো যাবে? কত বছর হলো আমরা স্বাধীন হয়েছি। মিয়ানমার থেকে এই সৈন্যসামন্তের বাংলাদেশে আগমন এবং তাদের আমরা ফেরত পাঠাতে চাচ্ছি ঠিক এরকমই কি ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আমাদের সামরিক লোকজন যখন ভারতে গিয়েছিল, তাদের ভারত যদি মাজায় দড়ি বেঁধে পাকিস্তান সরকারের কাছে পাঠিয়ে দিত তখন কেমন হতো? ইদানীং অনেক সামরিক নেতা এবং অন্যান্য বিরোধীরা কতভাবে বলার চেষ্টা করে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আমাদের নেতারা কিছুই করেননি। যদি কিছু না করতেন তাহলে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে জামাই আদর পেতেন না। মিয়ানমার থেকে যারা এসেছে তাদের বুকের ভিতর প্রতি মুহূর্তে কেমন তোলপাড় করছে, সম্ভব হলে একবার কান পেতে শুনুন।

 

লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর