মঙ্গলবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

প্রবাসে পূজা-অর্চনা

বনানী রায় চৌধুরী

প্রবাসে পূজা-অর্চনা

আমার দুই সন্তানই প্রবাসী। ছেলে থাকে কানাডায়। মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে। সেই সুবাদে আমি দুবার যুক্তরাষ্ট্রে এবং একবার কানাডা ভ্রমণ করেছি। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবার যাই ২০২০ সালের ডিসেম্বরে, করোনাকালে। কর্তব্যের তাগিদে। ৩১ ডিসেম্বর আমি দিদিমা হই।  নাতনি নীহারিকার বয়স এখন তিন বছর। দ্বিতীয়বার গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে। উদ্দেশ্য, মেয়ে-জামাতা-নাতনির সঙ্গে সময় কাটানো। গেল বছরের জুন মাসে আমি আমেরিকা থেকে কানাডা যাই। এবারও কর্তব্যের তাগিদে। কানাডায় আমার অবস্থানকাল ছিল তিন মাসের মতো। আমার মেয়ে সুপ্রীতি মিসিসিপিতে থাকে। জামাতা তন্ময় মিসিসিপি স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক শহর স্টার্কভিল। বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার হাতে গোনা কয়েকটি বাঙালি পরিবার থাকে ওই শহরে। শহরে কোনো মন্দির নেই। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরস্বতী পূজার সময় আমি মেয়ের বাসায়। মেয়ে জানাল, বড় বড় শহরে কিছু বাঙালি সংগঠন কনভেনশন সেন্টার ভাড়া করে সরস্বতী পূজার আয়োজন করে থাকে। আমাদের দেশের মতো তিথি মেনে পঞ্চমীতে সরস্বতী পূজা করা সম্ভব হয় না। কাজ থেকে ছুটি মেলে না। তাই ছুটির দিন বেছে নেওয়া হয়। প্রবাসে নিয়ম নাস্তি। মেয়ে আরও জানাল, কেউ কেউ পারিবারিকভাবে বাড়িতে সরস্বতী পূজার আয়োজন করে থাকেন। মূর্তি নয়, ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। পূজার উপাচার ইন্ডিয়ান স্টোরে কিনতে পাওয়া যায়। পারিবারিক পূজা হলেও আয়োজনের কোনো কমতি থাকে না। ষোলআনা বাঙালিয়ানা খাবার পরিবেশন করা হয়। লুচি, পায়েস থেকে শুরু করে খিচুড়ি, বেগুন ভাজা, লাবড়া, নানা পদের নিরামিষ, চাটনি এবং শেষপাতে ছানার মিষ্টি। কিছুই বাদ যায় না। সবই ঘরে তৈরি। পোশাকেও থাকে বাঙালিয়ানা।

দুর্গাপূজা আয়োজন প্রসঙ্গে সুপ্রীতি জানাল, প্রায় ৩০০ মাইল দূরে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের রাজধানী আটলান্টায় ফি-বছর দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়। আশপাশের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে বাঙালিরা সপরিবারে আটলান্টায় যান পূজা দেখতে। আগে থেকেই অনলাইনে হোটেল কক্ষ বুক করে রাখা হয়। স্টার্কভিলের কাছাকাছি শহর জ্যাকসনে দুর্গাপূজা হয়। তবে আড়ম্বর কম। আমেরিকার বিভিন্ন শহরে অবাঙালিরা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাঙালিদের পরিচালিত মন্দিরের সংখ্যা নগণ্য। তবে দেশজুড়ে গির্জার ছড়াছড়ি। টেনেসির বড় শহর মেমফিসে অবাঙালিদের একটি মন্দির দর্শনে যাই। মন্দিরে মা দুর্গা বা মা কালীর কোনো মূর্তি নেই। যেসব মূর্তি বা বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তার অধিকাংশই আমার অচেনা। গেল বছরের জুন মাসে কানাডা যাই। ছেলে স্বাগত থাকে নোভা স্কোশিয়া প্রদেশের রাজধানী হ্যালিফ্যাক্সে। জুলাই মাসে আমি ঠাকুরমা হই। নাতি সায়ন্তনের বয়স এখন সাত মাস। সায়ন্তন নামটা বউমা অদিতির খুব পছন্দ। ওদেশে হাসপাতালে শিশু জন্মানোর পরপরই নাম রেকর্ডভুক্ত করতে হয়। আমাদের দেশের মতো অনুষ্ঠান করে নাম রাখার সুযোগ নেই। নাতির বয়স ২১ দিন হলে বাড়িতে একটা পূজার আয়োজন করি। একজন বাঙালি ব্রাহ্মণের খোঁজ করা হলো। কিন্তু পাওয়া গেল না। প্রতিবেশী একজন গুজরাটি ব্রাহ্মণ ঋষি পাঠককে অনুরোধ করা হলে তিনি সম্মত হন। সন্ধ্যায় সস্ত্রীক এলেন ঋষি। প্রফেশনাল পুরোহিত নন তিনি। তাঁর ল্যাপটপে আপলোড করা পূজার মন্ত্র এবং নিয়মাচার অনুসরণ করে নিষ্ঠার সঙ্গে পূজা করলেন ঋষি। এক ছুটির দিন নাতিকে নিয়ে আমরা মন্দিরে যাই। মন্দিরের সামনে লেখা বেদান্ত আশ্রম হিন্দু টেম্পল। অবাঙালিদের পরিচালিত মন্দির। ছুটির দিনে ভক্তদের খুব ভিড়। পূজা শেষে দুপুরে অন্নপ্রসাদ বিতরণ করা হলো। কানাডার আলবার্টা প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর ক্যালগেরি। ওখানে আমার দেবর বরুণ স্থায়ীভাবে থাকে। দেবর এবং দেবরপত্নী সোমা নাছোড়বান্দা। ওদের পীড়াপীড়িতে সাত দিনের জন্য ক্যালগেরিতে যাই। ওখানে অনেক বাঙালি আছেন। এক বিকালে আমরা একটা মন্দিরে যাই। এটাও অবাঙালিদের। মন্দিরে তখন পূজা চলছে। সোমা জানাল, অধিকাংশ মন্দির শুধু ছুটির দিনগুলোতে খোলা থাকে।

ওদেশে সবাই যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ক্যালগেরিতে আমার দেবরের বন্ধু প্রাণতোষ সাহা তার বাসায় আমন্ত্রণ জানান। সাপ্তাহিক ছুটির দিন আমরা শহর থেকে দূরে কোথাও বেড়াতে যাব। অতিথিপরায়ণ প্রাণতোষদাকে কোনোভাবেই এড়ানো গেল না। এক কর্মদিবসে সন্ধ্যায় প্রাণতোষদার বাড়িতে যাই। আলাপচারিতায় জানলাম, কয়েকদিন ধরেই প্রস্তুতি চলছে। সারা রাত জেগে রান্না করে পরদিন সকালে অফিসে গেছেন আল্পনা বউদি। প্রবাসে এত আন্তরিকতা। কল্পনাও করা যায় না। দেবরের আরেক ঘনিষ্ঠজন অজিত মুহুরী। তিনি অনেক আগে থেকেই বলে রেখেছেন। কোনো অজুহাত শুনবেন না। অজিতদার নিমন্ত্রণও রক্ষা করতে হয়েছে। অজিতদা এবং শিল্পী বউদির আন্তরিক আতিথেয়তার কথা অনেক দিন মনে থাকবে। যেমন ভুলতে পারি না মিসিসিপির কলম্বাসে বসবাসরত রীতা রায় মিঠুর আতিথেয়তার কথা। এরা সবাই আমাকে ঋণী করেছেন। লক্ষ্য করেছি, সবার বাড়িতেই প্রার্থনার জন্য হয় আলাদা ঠাকুর ঘর, নয় তো ঠাকুরের সিংহাসন পাতা আছে।  প্রবাসে এত ব্যস্ততার মাঝেও বাঙালিরা পূজা-অর্চনার কৃষ্টি ধরে রেখেছেন দেখে খুব ভালো লাগল। ১৪ ফেব্রুয়ারি সরস্বতী পূজা। জোর কদমে চলছে প্রস্তুতি। এবার সরস্বতী পূজা, পয়লা ফাল্গুন ও ভালোবাসা দিবস একই দিনে উদযাপিত হবে।

 

লেখক : গল্পকার

সর্বশেষ খবর