বুধবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

জঘন্য অপরাধ মানব পাচার

যুবায়ের আহমাদ

জঘন্য অপরাধ মানব পাচার

মানুষ আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। সৃষ্টিকুলের মধ্যে মানুষকেই আল্লাহতায়ালা সবচেয়ে সুন্দর অবয়বে সৃষ্টি করেছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অবশ্যই আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে।’ সুরা ত্বীন, আয়াত : ৪। শুধু সুন্দর অবয়বই নয়, আল্লাহতায়ালা সব সৃষ্টির ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কথা পবিত্র কোরআনুল কারিমে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি মানুষকে মর্যাদা দান করেছি, জলে ও স্থলে তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি আর তাদের উত্তম রিজিক দিয়েছি। অনেক সৃষ্টির ওপরই মানুষকেই দিয়েছি বিশেষ মর্যাদা। সুরা বনি ইসরাইল : ৭০। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর সব আয়োজনও কেবল মানুষের জন্য। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘তিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের (মানুষের) জন্য সৃষ্টি করেছেন...।’ সুরা বাকারা : ২৯।

শ্রেষ্ঠত্বের পাশাপাশি মানুষকে আল্লাহতায়ালা স্বাধীনতার নিয়ামত দিয়ে সৃষ্টি করছেন। ইসলাম এসে দাসপ্রথার প্রতি নিরুৎসাহিত করেছে এবং বিভিন্ন গুনাহের কাফফারা হিসেবে ক্রীতদাসদের মুক্তির বিধান দিয়ে মানুষকে স্বাধীন করতে চেয়েছে। মানুষকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করতে গোলাম আজাদ করাকে অনেক বড় সওয়াবের কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছে। মু’আয ইবন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে কোনো মুসলিম পুরুষ কোনো মুসলিম পুরুষ (গোলাম)-কে আজাদ করবে, আল্লাহতায়ালা তার প্রত্যেকটি অস্থির বিনিময়ে তার এক একটি অস্থিকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করবেন। আর যে কোনো মুসলিম নারী কোনো মুসলিম দাসীকে আজাদ করবে, আল্লাহতায়ালা কিয়ামতের দিন তার প্রত্যেকটি অস্থির বিনিময়ে তার এক একটি অস্থিকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করবেন।’ আবু দাউদ। একজন ক্রীতদাস নিজের মুক্তির জন্য চেষ্টা করবে এ ব্যাপারেও উৎসাহ দিয়েছে ইসলাম। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তিন ব্যক্তি এমন যাদের সাহায্য করা আল্লাহ নিজের কর্তব্য বলে নির্ধারণ করে নিয়েছেন, আল্লাহর পথে মুজাহিদ, যে মুকাতাব (চুক্তিবদ্ধ গোলাম) মুক্তিপণ আদায়ের ইচ্ছা রাখে, বিবাহ ইচ্ছুক ব্যক্তি যে পবিত্রতা রক্ষা করতে চায়। তিরমিজি। এমনকি মুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত ক্রীতদাসের সঙ্গে সুন্দর আচরণের নির্দেশ দিয়েছে। মানবতার জন্য এটি লজ্জার যে, যেখানে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দিয়েছেন, জগতের সবকিছু মানুষের জন্য সৃষ্টি বলে উল্লেখ করেছেন, বিশ্বমানবতার পরম বন্ধু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্রীতদাসকে স্বাধীন করার উৎসাহ দিয়েছেন, স্বাধীন হওয়ার জন্য চেষ্টায় রত চুক্তিবদ্ধ গোলামকে আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত বলে উল্লেখ করেছেন সেখানে মানুষরূপী কিছু অমানুষ সৃষ্টির সেরা স্বাধীন মানুষকে পরাধীন করে বিক্রির জন্য পাচার করে। গণমাধ্যমের পাতা উল্টাতেই সে খবর আমাদের চোখে পড়ে। গত আট বছরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়েছে সাড়ে ২০ লাখ পাচার হওয়া মানুষ। এ সময় ভূমধ্যসাগরে নৌযান ডুবে ১৯ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। দৈনিক ইত্তেফাক : ১ এপ্রিল, ২০২২। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া এবং সাগরে ডুবে যাওয়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে বাংলাদেশি মানুষের সংখ্যাও কম নয়। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে বছরে হাজার হাজার মানুষ পাচার হচ্ছে। ইউরোপীয় কমিশন বলছে, গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে কেবল ইউরোপেই পাচার হয়েছে ৬৫ হাজারেরও বেশি মানুষ। বিবিসি বাংলা : ৩০ জুলাই, ২০২২। শুধু ইউরোপেই যদি ৬৫ হাজার মানুষ পাচার হয়, তাহলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কত মানুষ বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়।

যারা নিজেদের বিত্তশালী বানাতে সৃষ্টির সেরা মানুষের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে তাদের করুণ পরিণতি বরণ করতে হবে। দুনিয়ার বিচার, আদালতকে কৌশল কিংবা প্রভাবে ফাঁকি দিতে পারলেও পরকালে তাদের শাস্তি অবধারিত। সর্বশক্তিমান আল্লাহ নিজেই তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াবেন হাশরের ময়দানে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণির মানুষের প্রতিপক্ষ। আর আমি যার প্রতিপক্ষ তাকে পরাজিত করবই। তাদের একশ্রেণি হলো, যে ব্যক্তি স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করবে।’ বুখারি। দ্রুত সম্পদ উপার্জনের নেশায় যারা অন্যকে জিম্মি করবে, আল্লাহ তাদের দুনিয়াকে অশান্তিময় করে দেবেন। জায়েদ ইবনে সাবিত (রা.) বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তির উদ্দেশ্য হবে কেবল দুনিয়া অর্জন, আল্লাহ তার কাজকে এলোমেলো বিক্ষিপ্ত করে দেবেন। পেরেশানি সৃষ্টি করে দেবেন। সম্পদের পাহাড় থাকলেও তার দুই চোখের সামনে দারিদ্র্য এনে দেবেন (‘আরও চাই আরও চাই’ প্রবণতা তাকে পাগল করে তুলবে)। অথচ পার্থিব সম্পদ সে ততটাই লাভ করতে পারবে, যতটা আল্লাহ তার জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন...।” ইবনে মাজা : ৪১০৫।

লেখক : খতিব, বাইতুশ শফীক মসজিদ ও পরিচালক, বাইতুল হিকমাহ একাডেমি, গাজীপুর

সর্বশেষ খবর