শিরোনাম
বুধবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

বিদ্যা দেবী সরস্বতী

অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী

বিদ্যা দেবী সরস্বতী

ওঁ যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।/ নমস্তস্যৈ,, নমস্তস্যৈ,, নমস্তস্যৈ,, নমো নমঃ। / যা দেব

ী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা। / নমস্তস্যৈ,,, নমস্তস্যৈ,, নমস্তস্যৈ,, নমো নমঃ। / যা দেবী সর্বভূতেষু বিদ্যারূপেণ সংস্থিতা। / নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতে, দেবী সরস্বতী সত্য, ন্যায় ও জ্ঞানালোকের প্রতীক। বিদ্যা, বাণী ও সুরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতী। অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করতে কল্যাণময়ী দেবীর চরণে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবেন অগণিত ভক্ত। ‘সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে, বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যংদেহী নমোহস্তুতে’ সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এই মন্ত্র উচ্চারণ করে বিদ্যা ও জ্ঞান অর্জনের জন্য দেবী সরস্বতীর অর্চনা করবেন।

যা দেবী সর্বভূতেষু বিদ্যারূপেণ সংস্থিতা : বাঙালির ঘরে ঘরে যে পূজা আবহমান কাল ধরে হয়ে আসছে তা হচ্ছে স্বরস্বতী পূজা। দেবী সরস্বতী মা বিদ্যার দেবী। তাই শিক্ষার্থী ছাত্রছাত্রীদের জন্য আসেন বিদ্যার স্বরূপ হয়ে। বিদ্যা, বুদ্ধিতে সন্তানরা সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে মায়ের আশীর্বাদে এই দিন তাই সকালে পূজার আয়োজন চলে ঘরে ঘরে। অঞ্জলি আর প্রসাদ বিতরণের মধ্যে পূজামন্ডপ হয়ে ওঠে আনন্দ উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। সংসার সমরাঙ্গনে বাঁচতে মানুষের লাগে বুদ্ধি, ঋদ্ধি, সিদ্ধি ও ক্ষাত্রশক্তি। তাই তো আদ্যশক্তির মহিমায়ায় আছেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ ও কার্তিক। এই জীবনে ধনের দেবী লক্ষ্মী, বিদ্যার দেবী সরস্বতী, দেব সেনাপতি কার্তিক গণদেবতা ও সিদ্ধিদাতা গণেশও হচ্ছেন পূজিত। অন্যদিকে, সরস্বতীর বাহন রাজহংস, লক্ষ্মীদেবীর বাহন প্যাঁচা, গণেশ ঠাকুরের ইঁদুর ও কার্তিকের বাহন ময়ূর। প্রত্যেকটি প্রতীক তত্ত্বই আধ্যাত্মিক তত্ত্বে ভাবমন্ডিত।

সরস্বতী রানীরূপিণী বাগদেবী; তিনি জ্ঞানশক্তির প্রতীক। দেবীর হাতে পুস্তক ও বাণী।

সরস্বতী শুদ্ধ জ্ঞানময়ী প্রকাশস্বরূপ। জ্ঞানের সাধক হইতে সাধককে হইতে হইবে দেহে মনে প্রাণে শুভ্র-শুচি। সরস্বতীর বাহন হংস। হংস একটি পবিত্র প্রতীক। যুদ্ধে শৌর্য-বীর্য প্রদর্শন একান্ত প্রয়োজনীয়। তাই সাধক জীবনে এবং ব্যবহারিক জীবনে কার্তিকেয়কে প্রসন্ন করতে পারলে শৌর্য-বীর্য আমাদের করতলগত হয়।

সব দেশের, সর্বকালের, সব মানুষের পক্ষে যা কল্যাণকর সেটিই হচ্ছে হিন্দু ধর্মের নির্দেশনা। হিন্দু ধর্মে বহু মত। হরিচাঁদ ঠাকুর বলেছেন, “সকল ধর্মের উদার থাকবে, জাতিভেদ করবে না।”

ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেছেন, “তোমরা যে সম্প্রদায়েরই হও না কেন, মনে রেখ, ঈশ্বর এক, ধর্মও এক।”

স্বামী বিবেকান্দ বলেছেন, “প্রত্যেককে আমি কেন ভালোবাসব? কারণ তারা সকলে এবং আমি এক”। তিনি আরও বলেছেন, “জগতে যত প্রাণী আছে সবাই তোমরা আত্মার বহুরূপ মাত্র।”

চাণক্য বলেছেন, “অত্মবৎ সর্বভূতেষু যঃ পশ্যতিঃ স পন্ডিতঃ” - সকল জীবকে যিনি নিজের মতো করে দেখেন, তিনি পন্ডিত (অর্থাৎ সমদর্শী)।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, “মানুষ সবজি বাগান করেন, মানুষ ফুলবাগান করেন, উভয়ই মানুষকে আনন্দ দেয় কিন্তু যে সবজি বাগান করেন তার একটা উদ্দেশ্য থাকে সবজি ভোজপাত্রে ব্যাঞ্জন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর যে ফুলবাগান করে তার উদ্দেশ্য থাকে না। সুতরাং যে সবজি বাগান করে সে করে খেলা। আর যে ফুলবাগান করে সে করে লীলা।”

মা দেবী সরস্বতী আমাদের বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান আর সুরের মূর্ছনায় ভরিয়ে দিতে আসেন প্রতি মাঘে। শীতের এই কুয়াশা ঢাকা সকালে স্নান করে বই, খাতা, কলম নিয়ে মা দেবী সরস্বতীর কাছে আমরা হাজির হই পুষ্পাঞ্জলি দিতে। কারণ, মাকে আমার ভক্তি নিবেদন করতে হবে। কেননা বিদ্যা, বুদ্ধি আমার চাই। কথায় বলে শিক্ষার শেষ নেই। আমার যতই ডিগ্রি থাকুক আর পদবি থাকুক, জানার যেমন শেষ নেই তেমনি, আমার বিদ্যাকে আরও আমি বাড়াতে চাই। তাই বলে বিদ্যার জাহাজ হওয়ার জন্য নয়। বিদ্যার একটি ছোট ডিঙি নৌকা তো হতে পারি!

সরস্বতী পূজা দুর্গাপূজার মতোই সার্বজনীন পূজা। দল-মত-নির্বিশেষে আবালবৃদ্ধবনিতা বিশেষত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ছেলেমেয়েরা সরস্বতী পূজায় শরিক হয়।  মায়ের কাছে বিদ্যা চাইতে সবাই জোড় হাত তুলে প্রণাম করে।

মা তো বিদ্যার দেবী তাই তার কাছেই চাইবে সবাই। বিদ্যা যদি না পাই, তবে তো পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারব না।

একজন পরিপূর্ণ মানুষ হতে হলে বিদ্যার বিকল্প নেই। আচার-আচরণ স্বভাব-প্রকৃতি সবকিছুই পরিপূর্ণতা পায় বিদ্যার গুণে। তাই বিদ্যার দেবীকে অঞ্জলির মাধ্যমে নিবেদন করে ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষার্থীরাই। তাদের প্রার্থনা যেন দেবী সরস্বতী পূরণ করেন এই প্রার্থনাই পূজার মূলমন্ত্র।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা (একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দসৈনিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র), প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস)

সর্বশেষ খবর