বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বহুজন বহু কথা বলেছেন এবং বলছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীরা মোটামুটি সবাই একমত যে, বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্ব রক্তের অক্ষরে লেখা। কিন্তু গত ৮ ফেব্রুয়ারি নয়াদিল্লির বিবেকানন্দ ফাউন্ডেশনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে যা বলেছেন এক অর্থে তা অসাধারণ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এবং বর্তমানকালে তাঁর সুযোগ্য কন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিষয়ে এ ধরনের সাবলীল এবং বস্তুনিষ্ঠ ভাষ্য অতীতে খুব একটা শোনা যায়নি। ড. হাছান মাহমুদ যে একজন জ্ঞানসমৃদ্ধ সুবক্তা এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই। অতীতে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালেও তার বক্তব্য প্রজ্ঞাগত কারণে প্রশংসিত হয়েছে।
৮ ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানের প্রশ্নোত্তর পর্বে যে বিষয়টি বেশি গুরুত্ব লাভ করেছিল, সেটি ছিল বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা সংক্রান্ত। ড. মাহমুদ রাখঢাক না রেখে বলে দিয়েছেন, ইদানীংকালে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মানসিকতা বহু গুণে কমে গেছে। তার ওই মন্তব্যের নিরিখে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী হীনমন্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। এটা বলা অযৌক্তিক হবে না যে, ভারত বিরোধিতার সূত্রপাত খুঁজে পাওয়া যায় দ্বিজাতিতত্ত্ব নামক সেই ঘৃণিত ধারণা থেকে। যাতে বলা হয়েছে, ভারতবর্ষের হিন্দু এবং মুসলমান সম্প্রদায় জাতিগতভাবে আলাদা। সিপাহি বিপ্লবকালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে যুদ্ধে নেমেছিলেন হিন্দু-মুসলমান-শিখ-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সব ধর্মের অনুসারীরা। সেই যুদ্ধে হিন্দু ঝাসির রানি লক্ষ্মীবাঈ মুসলিম মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে। ওই যুদ্ধে জয়লাভের পর ইংরেজরা এই ধারণা নিয়ে নতুন ফন্দি করেছিল যে, ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসন চালাতে হলে হিন্দু এবং মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে হবে। তাদের সেই কুপরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার লোকের অভাব হয়নি। স্যার সৈয়দ আহম্মদ লোভের বশবর্তী হয়ে ইংরেজদের ফাঁদে পা দিয়ে প্রচার করলেন যে, হিন্দু এবং মুসলমান আলাদা সত্তা। বিনিময়ে তাকে ‘নাইট হুড’ (স্যার) উপাধিসহ বহু কিছু প্রদান করা হয়েছিল। সেই ঘৃণ্য মতবাদ, যার ওপর ভরসা করে ভারত বিভক্ত হয়েছিল, কোটি কোটি মানুষের রক্তে উপমহাদেশ রঞ্জিত হয়েছিল, সেই অভিশপ্ত তত্ত্ব এখনো বেশ কিছু লোকের মধ্যে, বিশেষ করে ধর্মান্ধদের মধ্যে বিরাজমান। ১৯৪৮ সালেই বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন যে, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভুয়া আশ্বাস দিয়ে পূর্ববাংলার মুসলমানদের ফাঁদে ফেলেছিল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বের লোকেরা, আর তাই তিনি ১৯৪৮ সাল থেকেই পূর্ববাংলার মানুষের মুক্তির কথা চিন্তা করছিলেন। প্রখ্যাত গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তার সদ্য প্রকাশিত বই, ‘বঙ্গবন্ধুর জীবন ১৯২০-১৯৭১’-এর ২৮৪ পৃষ্ঠায় বামপন্থি এক নেতা খোকা রায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, ১৯৬১ সালে বঙ্গবন্ধু সেই নেতাকে বলেছিলেন, ‘ওদের সঙ্গে (পাকিস্তানের) আমাদের থাকা চলবে না। তাই এখন থেকেই স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে; আন্দোলনের প্রোগ্রামে ওই দাবি রাখতে হবে।’ তার অগ্রযাত্রায় পূর্ববাংলার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সমর্থন থাকলেও এমন অনেক ধর্মান্ধ ছিলেন যারা দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানের ভেঙে যাওয়াকে মেনে নিতে পারেননি। তখন থেকেই যারা বাঙালির মুক্তির কথা বলতেন তাদের ভারতের চর বলে আখ্যায়িত করা হতো। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালেও এদের সংখ্যা নেহায়েত কম ছিল না। শুধু যে ধর্মভিত্তিক মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি দলের অনুসারীরাই মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিলেন তা নয়, ছিলেন কট্টর মাওবাদী কিছু লোকও (সবাই নয়)। ছিলেন যাদু মিয়া, শাহ আজিজের মতো পাকিস্তানি আদর্শে বিশ্বস্তরাও এবং এমনকি খোন্দকার মোশতাক, জহুরুল কাইয়ুমের মতো তথাকথিত আওয়ামী লীগের কিছু নেতাও। ৭১-এর গণজোয়ারের ফলে এরা নির্জীব হয়ে পড়েছিলেন। অনেকে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু এদের গোপন ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান এবং চীনের প্রত্যক্ষ সহায়তা পেয়ে তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের কালপুরুষ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিলেন, তাদের অতি প্রিয়জন খন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমানের অপ-নেতৃত্বে। মোশতাক এবং জিয়া বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখলের পরপরই বাংলাদেশকে পাকিস্তানে রূপান্তরিত করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে সেই পুরনো ভারতবিরোধী তাস খেলা শুরু করেছিলেন। জিয়া, এরশাদ এবং পরবর্তীতে খালেদা জিয়া সেই ভারতবিরোধী তাসকেই উপজীব্য করে ২১ বছর ক্ষমতা দখলে রেখে সে সময় ভারতবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক মতবাদ প্রচার করে গেছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মসজিদে আজান না হয়ে শঙ্খধ্বনি বাজবে বলে খালেদা জিয়া যে সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক কথা বলেছিলেন, সে ধরনের হিন্দুবিরোধী কথা আর কেউ বলেছেন বলে আমাদের জানা নেই। ক্ষমতা দখলের পরই চীন-পাকিস্তানি প্রভুদের নির্দেশে জিয়াউর রহমানের প্রথম পদক্ষেপ ছিল বাংলাদেশে ভারতবিরোধী উন্মাদনা প্রচার করা। তবে ইদানীংকালের ভারত বিদ্বেষ ধর্মগত কারণে নয়, বরং ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অপরিহার্য শক্তি ছিল বলে। ধর্মের কারণে বিরোধিতা করতে হলে তারা বরং চীনেরই বিরোধিতা করত, যেখানে প্রতিনিয়ত বহু মসজিদ চুরমার করা হচ্ছে, উইঘুর এবং অন্যান্য এলাকার মুসলমানদের ওপর সরকারি মদদে নির্যাতনের স্টিমরোলার চালানো হচ্ছে, বিরোধিতা করত সেই সব দেশের যারা গাজা এলাকায় প্যালেস্টাইনবাসীর ওপর নির্যাতন চালানোর জন্য ইসরায়েলকে সাহায্য করছে। কিন্তু বিস্ময়কর হলো তারা গাজায় এবং উইঘুরের গণহত্যার বিরুদ্ধে কিছুই বলছেন না। যা প্রমাণ করে, তাদের ভারত বিরোধিতার একমাত্র কারণ সে দেশটি আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে সাহায্য করেছিল।
![](/assets/archive/images/Print-Edition/2024/02.February%20-2024/16-02-2024/Bd-Pratidin-16-02-24-F-15.jpg)
অতীতে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ভারতের সঙ্গে আমাদের অনেক সমস্যারই সমাধান হয়েছে, এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, যেসব সমস্যা সমাধানের অপেক্ষায়, সেগুলোও আলোচনার মাধ্যমেই শেষ হবে বলে তিনি আশাবাদী। সেই প্রসঙ্গে জোর দিয়ে বলেছেন, ভারতের আগামী নির্বাচনের পরপরই তিস্তা সমস্যার সমাধান হওয়া একান্ত প্রয়োজন। তিনি এ কথাও উল্লেখ করেছেন, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের এ ব্যাপারে আগ্রহে ঘাটতি নেই। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে মারণাস্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার দাবি করে তিনি বলেন, সম্প্রতি সীমান্ত এলাকায় বিজিবির এক সদস্যকে হত্যার ঘটনার ওপর তদন্ত চলছে। মিয়ানমারে চলতি ঘটনাগুলো বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় দেশের জন্যই অশনিসংকেতসম বলে উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, এ সমস্যা প্রতিহত করতে উভয় দেশকে একযোগে কাজ করতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্যগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সবাইকেই মুগ্ধ করেছে। মজ্জাগত ভারতবিরোধী যে তারাই এবং তাদের বংশধররাই- যারা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় মেনে নিতে পারেননি, সে কথা বহুলাংশেই তার আলাপচারিতা এবং প্রশ্নোত্তর থেকে অনুধাবন করা যায়। এই অবাঞ্ছিত এবং ধ্বংসাত্মক মনস্তত্ত্ব যে বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মীরাই মূলত চালিয়ে যাচ্ছে- সে কথা তিনি রাখঢাক না রেখেই প্রকাশ্যে উল্লেখ করেছেন। তিনি ভারতীয় জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মজ্জাগত ভারতবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন নয়।
১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জিয়াউর রহমান যে ভারতবিরোধী কট্টরতার আশ্রয় নিয়েছিলেন, আজ তার উত্তরসূরিরাই সেটি চালিয়ে যাচ্ছেন। জিয়াউর রহমান ভারতের সঙ্গে বৈরিতা চালিয়ে না গেলে গঙ্গার পানি, ছিটমহল, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ প্রভৃতি সমস্যাগুলোর সমাধান বহু আগেই হয়ে যেত। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিভিন্ন দিক সুস্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় প্রশংসা এবং সাধুবাদের দাবিদার। যারা এখনো মজ্জাগত ভারত বিরোধিতায় অবতীর্ণ আশা করা যায় তারা বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারবেন।
লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি