শুক্রবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

অতি প্রত্যাশার স্বতন্ত্র এমপি এবং বাস্তবতা

আলম রায়হান

 অতি প্রত্যাশার স্বতন্ত্র এমপি এবং বাস্তবতা

এবারের সংসদ নির্বাচনে ‘সেই রকম’ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে একটানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতাসীন হয়েছে আওয়ামী লীগ। এটি ইতিহাসে একটি রেকর্ড সৃষ্টিকারী ঘটনা। কিন্তু এই রেকর্ডকে ছাপিয়ে প্রধান আলোচ্য, সংসদে ৬২ স্বতন্ত্র এমপি বসার অভূতপূর্ব রেকর্ড। আবার এ বিষয়টিকেও ছাপিয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে স্বতন্ত্র এমপিদের প্রতি অতি প্রত্যাশার পুষ্পবৃষ্টি দশা। উল্লেখ্য, সংসদীয় নির্বাচনের ইতিহাসে এবারের সংসদে সর্বোচ্চসংখ্যক স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য এসেছেন। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে চলে গেছে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের ’৭৯-এর রাবার স্ট্যাম্প সংসদ।  সেই সংসদে স্বতন্ত্র ছিলেন ১৬ জন। এ সংখ্যা বেড়ে দ্বাদশ সংসদে চার গুণের চেয়ে মাত্র দুজন কম। আহারে, আর মাত্র দুজন হলেই এক অর্থে ষোলকলা পূর্ণ হতো। অই একটা গান আছে না, ‘এতো দিনে আশা হলো পূর্ণ...।’ এদিকে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে নামার বেলায় দ্বিতীয় জাতীয় নির্বাচনে ছিল এবারের নির্বাচনের কাছাকাছি। এ মিলের নেপথ্যে রয়েছে আরও একটি কৌশলগত বিষয়ের প্রভাব।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের প্রধান কুশীলব, নিদেনপক্ষে বেনিফিশিয়ারি জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনের কৌশলগত লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা। কিন্তু এই ফাঁদে পা দেয়নি নির্বাচনি রাজনীতির ‘ঘুঘু’ আওয়ামী লীগ। তবে এ নিয়ে অনেক টানাপোড়েন ও অনিশ্চয়তা ছিল। এ অবস্থায় বিপুলসংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে নামানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কেউ কেউ নেমেছেন নিজের তাড়নায়, কাউকে নামানো হয় সরকারি ব্যবস্থাপনায়। কেউ কেউ আবার আগাম নেমে পড়েন নির্বাচনি মাঠে। এদের কারও উদ্দেশ্য ছিল সংসদে যাওয়া, কারও লক্ষ্য ছিল নির্বাচনি খরচ হিসাবে সরকারে কাছ থেকে টাকা নেওয়া। কিন্তু ’৭৯ সালে সামরিক সরকারের চালের উল্টো চাল চেলে নির্বাচনে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ। এরপরও অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়েছেন এবং চূড়ান্ত ‘বণ্টননামায়’ শেষতক স্বতন্ত্র হিসেবে সংসদে প্রবেশ করার সুযোগ পেয়েছেন ১৬ জন। সেই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিএনপি পায় ২০৭ আসন এবং মাত্র ৩৯ আসন পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী আওয়ামী লীগ। প্রায় সবারই জানা কথা, নির্বাচনে প্রধানত দুই রকম বাণিজ্য চলে। এক. মনোনয়ন ক্রয়। দুই. নির্বাচনে জমজমাট লেবেল সাঁটার জন্য অধিকসংখ্যক প্রার্থী মাঠে নামাতে সরকারের তরফ থেকে অর্থ প্রদান। নির্বাচনি মাঠে প্রার্থী নামানোর বিষয়টি খুবই জমজমাট বাণিজ্যের আওতায় ছিল দুই সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদের আমলে। এ ধারা মৃদুলয়ে বাঁক নেয় বেগম খালেদা জিয়া ও তার নেপথ্য শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে। এদিকে টাকা নিয়ে মনোনয়ন দেওয়ার পাইওনিয়ার হচ্ছে খালেদা জিয়ার বিএনপি। ’৯১ সালে পার্টি ফান্ড জোগানোর নামে মনোনয়ন বিক্রি শুরু করেন বেগম খালেদা জিয়া। তবে বিষয়টিতে যথেষ্ট রাখঢাক ছিল। কিন্তু মনোনয়ন বিক্রির এই মৃদুধারা পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে ভয়ংকর স্রোতে পরিণত হয়েছে। থানা পুলিশের কাছে গেলে যেমন কিছু খরচাপাতি অনিবার্য, তেমনই দলীয় মনোনয়নে টঙ্কা অবধারিত। কেবল পার্থক্য পরিমাণের। থানায় লাগবে পকেট অথবা প্যাকে টাকা, আর দলীয় মনোনয়নের জন্য লাগবে ব্রিফকেস বা স্যুটকেস ভর্তি টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাজারের তুচ্ছ ব্যাগও নাকি ব্যবহৃত হয় টাকা প্রদানের জন্য। এ বাণিজ্যে ঊর্ধ্বগগনে বিরাজমান অবস্থায় আওয়ামী লীগ সরকার স্থানীয় নির্বাচনেও প্রতীক বরাদ্দের তান্ডব প্রবর্তন করে বসল। ব্যস, মনোনয়ন বাণিজ্যের ভয়ংকর স্রোত পৌঁছে যায় গ্রাসরুটে, উপজেলা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা হয়ে একবারে ইউনিয়ন পর্যন্ত। ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মার্কা পাওয়ার জন্য দুই-চার কোটি টাকা খরচ করারও উদাহরণ নাকি আছে। আর এক্ষেত্রে বিশ-পঞ্চাশ লাখ টাকা তো নস্যি, টিস্যু পেপারসম। আবার কেউ কেউ ফাঁকতালে হাওয়ার ওপর ব্যবসা করে ফেলেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি আসবে না জেনেও কেউ কেউ পুরনো ধারায় মনোনয়নবাণিজ্য করে ফেলেছেন বলে জনশ্রুত আছে। কিন্তু এই বাণিজ্য ক্লাইমেক্সে পৌঁছানোর আগেই নানান বাস্তবতার আলোকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে প্রকারান্তরে ইঙ্গিতে বলা হয়, আওয়ামী লীগ নেতারা চাইলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবেন। দলীয় মনোনয়নের বাইরে নির্বাচনে দাঁড়ানোর বিষয়টিকে খোলাসা করে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আখ্যায়িত করেছেন, ‘গণতান্ত্রিক অধিকার ুহিসেবে।’ কিন্তু কে কাকে প্রশ্ন করবে, যেখানে ইউনিয়ন পরিষদে নৌকার বিরুদ্ধে প্রার্থী হলে বিদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত করে দল থেকে সোজা বহিষ্কার, সেখানে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নের বাইরে প্রার্র্থী হলে তা ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’ হয় কীভাবে? অবশ্য রাজনীতিতে সব সময় সবকিছু প্রশ্নের আওতায় থাকে না। এ ছাড়া কার প্রশ্নে তোয়াক্কা কে করে। অবশ্য দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অন্যরকম বাস্তবতা ছিল। বিএনপি অংশ না নেওয়ায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামরিক সরকারের আমলের ‘হ্যাঁ-না’ ভোটের পর্যায়ে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। এজন্য প্রথমে হেন দল তেন দলের সাইনবোর্ড নিয়ে কিছু লোক মাঠে নামানো হয়। কিন্তু তারা হালে পানি পাচ্ছিলেন না। ফলে এদের ব্যয় বহন থেকে সরকার দ্রুত সরে যায়। রাজনীতির আগাছাকে বৃক্ষে পরিণত করার প্রকল্প ত্যাগ করে নির্বাচনে ট্রাম্পকার্ড খেলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলীয় মনোনয়নের বাইরে নির্বাচন উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এ ধারায় দলের অভ্যন্তরে মহিরুহ ভাবের কিছু আগাছা পরিষ্কার হওয়ার পাশাপাশি প্রধানত চারটি ফল পাওয়া গেছে। এক. ক্লাইমেক্সে ওঠার আগেই মনোনয়নবাণিজ্য ভূপাতিত হওয়া। দুই. ভোটের আলোচনা সারা দেশে পৌঁছে যাওয়া। তিন. কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া। তবে তা ৪১ শতাংশ কি না তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় আছে। চার. একবার এমপি হলেই পগারপার- এই প্রবণতার নেতাদের উচিত শিক্ষা হওয়া। ফলে জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়ার পথ সংকোচিত হয়েছে এবং অনেক এমপি নির্বাচনি এলাকাকে মামার জমিদারি বিবেচনা করার প্রবণতা থেকে উঠে আসার চাপ অনুভব করছেন। এটিই হচ্ছে এবারের নির্বাচনের মূল বিউটি। প্রসঙ্গত, ১৯৭৫ সালে যে পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে নির্বাচনি ব্যবস্থায় নির্বাচনে প্রার্থিতা কেবল উন্মুক্তই ছিল না, নির্বাচনি ব্যয় বহনের দায়িত্বও ছিল রাষ্ট্রের। অনেকেই মনে করেন, সেই ধারণা থেকেই কিঞ্চিৎ কপিপেস্ট করা হয়েছে এবারের নির্বাচনে। ফলশ্রুতিতে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ৬২ জন। এরা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগেরই। সেটি বড় কথা নয়। এ প্রসঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে, স্বতন্ত্র হিসেবে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তা কেবল তাদের গ্রহণযোগ্যতার মানদন্ড নয়। নৌকার প্রার্থীদের প্রতি অনাস্থার সুফল পেয়েছেন নির্বাচিত স্বতন্ত্ররা। এরপরও মূল সমস্যা থেকে গেছে ভিতরেই। তা হচ্ছে প্রাপ্তির অসীম বাসনা! প্রাপ্তির এই বাসনার ক্ষেত্রে দলীয় এমপিদের চেয়ে স্বতন্ত্র এমপিরা পিছিয়ে আছেন অথবা লাজুকলতা-এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। অনেকেই জানেন,  এক মহাহেভিওয়েটকে কুপোকাত করে নির্বাচিত হয়েছেন এমন একজন স্বতন্ত্র এমপি যিনি এক প্রকল্পের পুরো ৬ হাজার কোটি টাকা হজম করে ফেলেছেন। আরও অনেক হজমের রটনা আছে তার বিরুদ্ধে।

আর সেই টাকার জোরেই তিনি সাবেক শ্রদ্ধেয় বসকে কুপোকাত করেছেন। স্বতন্ত্র এমপিদের মধ্যে এমন আরও কেউ আছেন কি না তা পরিষ্কার নয়। তবে এটি পরিষ্কার, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের মধ্যে ব্যারিস্টার সুমনসহ দু-চারজন ছাড়া বাকি সবাই প্রচলিত রাজনীতির চলতি হাওয়ার পন্থি।  আর কে না জানে, প্রচলিত ধারার রাজনীতিতে প্রাপ্তিযোগই হচ্ছে মূল কথা। ফলে স্বতন্ত্র এমপিরা সংসদে জোরালো ভূমিকা রাখবেন, নিদেনপক্ষে চেষ্টা করবেন- এ আশা করলে সেটা কাঁঠালের আমসত্ত্বের মতো হয়ে যেতে পারে। ফলে বাস্তবতা হচ্ছে, ক্ষমতার কেন্দ্র যেভাবে চাইবেন সেভাবেই করবেন মাননীয় স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা। যেমন, কোটা অনুসারে ৬২ স্বতন্ত্র এমপির সঙ্গে ‘মতৈক্য’ হওয়ায় ভাগের ১০ আসনে মহিলা এমপি মনোনয়নের দায়িত্ব আওয়ামী লীগপ্রধানের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন আসমানি বাণীর মতো গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘সবচেয়ে বড় বিষয়টি হচ্ছে, এখানে গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করার জন্য এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে, সংসদকে সুন্দর ও কার্যকর করার জন্য, প্রাণবন্ত করার জন্য স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’ এর আগে ৬২ স্বতন্ত্র এমপির প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘তোমরা কেউ আমার ডান হাত, কেউ আমার বাম হাত। সবাই তো আমার। বাংলাদেশই আমার। আমি বঙ্গবন্ধুর মেয়ে, জাতির পিতার মেয়ে, বাংলাদেশই আমার, আমি বাংলাদেশকে ধারণ করি।’ সরকারপ্রধানের এই ‘আমার বলয়’ থেকে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা সংসদীয় কার্যক্রমে কি বেরিয়ে আসতে পারবেন? এ অবশ্য দেখার বিষয়, অপেক্ষা করতে হবে। তবে সূচনাই বলে দেয়, বাকি সময় কেমন যাবে। এরপরও কী কারণে যে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের কাছে অতি প্রত্যাশা করা হয়, তা অনুধাবন করা কঠিন।

তবে এরশাদ সরকারের সময় সংসদে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে বিরোধী দলকে বলা হতো গৃহপালিত বিরোধী দল। কেউ কেউ আবার সে সময় সংসদ নিয়ে মার্কসের উক্তি কোড করতেন। কেবল জেনারেল এরশাদ বলে কথা নয়, শেখ হাসিনা সরকারের সময়ও সংসদে জাতীয় পার্টিও গৃহপালিত বিরোধী দলের তকমা পেয়েছে। দেখা যাক, দ্বাদশ সংসদে সংখ্যায় রেকর্ড সৃষ্টিকারী স্বতন্ত্ররা কী রেকর্ড সৃষ্টি করেন অথবা কোন তকমা পান। তবে আগের চেয়ে খুব একটা হেরফের হবে বলে মনে হয় না। বেশি প্রত্যাশা করাটা আসলে বাস্তবতার সঙ্গে যায় না। অথচ স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের সূচনাতেই আওয়ামী লীগ ব্রাকেটে বন্দি না করে উন্মুক্ত রাখলে অন্য রকমও হতে পারত। সে ক্ষেত্রে এই গ্রুপ থেকে হয়তো কয়েকজন দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান তৈরি হতে পারতেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সেই পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে।  যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে রুদ্ধ করা হয়েছে জাতীয় নেতা সৃষ্টির বহতা ধারা। হয়তো একসময় দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান সৃষ্টির পথও রুদ্ধ হয়ে যাবে, আলিবাবা চল্লিশ চোরের গুহা দ্বারের মতো।

লেখক :  জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর