শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

কেমন ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ

ইমদাদুল হক মিলন

কেমন ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ

প্রণব ভট্ট নামে একজন লেখক ছিলেন। এই শতাব্দীর শুরুর দিকে নানা রকম প্রেম-ভালোবাসার কাহিনি লিখে তিনি রাতারাতি কিছুটা জনপ্রিয় হয়েছিলেন। বইমেলায় তাঁর পাঁচ-ছয়টি উপন্যাস বেরোত। আমার সঙ্গে তৈরি হয়েছিল খুবই ঘনিষ্ঠতা। অন্যদিকে বইয়ের বিক্রির কারণে তিনি আমাকে কিছুটা ঈর্ষাও করতেন। অত্যন্ত বড় হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। দুহাতে টাকা খরচ করতেন বন্ধুদের জন্য। হুমায়ূন আহমেদের ‘দখিন হাওয়া’র ফ্ল্যাটে, ‘অবসর ও প্রতীক’ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী আলমগীর রহমানের গেন্ডারিয়ার বাড়িতে আমাদের আড্ডার সঙ্গী ছিলেন প্রণব ভট্ট। ‘অন্যপ্রকাশ’-এর মাজহার তো থাকতেনই। হুমায়ূন ভাইয়ের বন্ধু আর্কিট্যাক্ট করিম ভাইও থাকতেন। একবারের বইমেলায় হুমায়ূন ভাইয়ের কাছে আমার ব্যাপারে অদ্ভুত এক প্রস্তাব দিলেন প্রণব ভট্ট। সেই প্রস্তাবের সময় ‘অন্যদিন’-এর মাজহারও কাছে ছিলেন। আলমগীর ভাই ছিলেন কি না আমার মনে নেই। ‘অন্যপ্রকাশ’, ‘অনন্যা’, আরও কোনো কোনো প্রকাশনী থেকে প্রণবের বই তখন বেরোত। এক স্টল থেকে আরেক স্টলে ঘুরে ঘুরে প্রণব বইয়ে অটোগ্রাফ দিতেন। এই দুই প্রকাশনীর কোনোটিতে আমি বসতাম নিয়মিত। হয়তো প্রণব ব্যস্ত হয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। আমি গিয়ে ঢুকলাম। কিছুক্ষণ পর প্রণব বেরিয়ে অন্য স্টলে চলে যেতেন। ব্যাপারটা অত্যন্ত হাস্যকর ও ছেলেমানুষি। এই ছেলেমানুষির চূড়ান্ত পর্বটি ঘটল হুমায়ূন ভাইয়ের ‘দখিন হাওয়া’র ফ্ল্যাটে। সন্ধ্যাবেলা নিয়মিত আমরা সেখানে আড্ডা দিই। সে দিন বইমেলা শেষ করে সরাসরি চলে গেছি ‘দখিন হাওয়া’য়। আড্ডার মাঝখানে হঠাৎ হুমায়ূন ভাইকে প্রণব বললেন, ‘মিলন ভাইকে আপনি বলেন তিনি যদি বইমেলাতে না যান, তাহলে প্রতিদিন আমি তাঁকে বিশ হাজার করে টাকা দেবো।’ হুমায়ূন ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী বলো মিলন? প্রণব তোমাকে বইমেলার এই এক মাস প্রতিদিন বিশ হাজার করে টাকা দেবে, তুমি মেলায় যেতে পারবে না।’ অর্থাৎ আমি মেলায় না গেলে প্রণবের বই বেশি বিক্রি হবে। আমরা সবাই তখন বেশ মুডে। আমার হয়ে মাজহার হুমায়ূন ভাইকে বললেন, ‘আর কিছু বাড়িয়ে দিতে বলেন স্যার, মিলন ভাইকে আমি রাজি করাব।’ আমি পঞ্চাশ হাজার চেয়ে বসে রইলাম।

এই রকম কত ছেলেমানুষি করেছি আমরা। হুমায়ূন ভাই ছিলেন আমাদের নেতা। প্রণব হঠাৎ করেই চলে গেলেন। তাঁর ফ্ল্যাটেও আড্ডা দিতে গেছি আমরা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হুমায়ূন আহমেদ, আমি, আমরা তাঁকে বই উৎসর্গ করেছি। হুমায়ূন ভাই তাকে বলতেন সিংহ হৃদয়ের মানুষ। যতদিন বেঁচে ছিলেন মেলায় তাঁর বই ভালোই বিক্রি হতো। মারা গেলেন, আশ্চর্য ব্যাপার পরের বছর থেকেই মেলায় তাঁর একটি বইও চলে না, তাঁর নামটিও কোনো পাঠক উচ্চারণ করেন না। আরও একজন তরুণ লেখকের ক্ষেত্রে এই ঘটনা আমি দেখেছি। হঠাৎই বেশ ভালো চলতে শুরু করল তাঁর বই। তারপর হঠাৎই নিভে গেল। তিনি বেঁচেও আছেন। কারণটা কী? এ নিয়ে আমি ভেবেছি। নিশ্চয় তাঁরা লেখক হিসেবে অল্প সময়ের মধ্যেই একঘেয়ে হয়ে গিয়েছিলেন। পাঠকের অন্তর স্পর্শ করতে পারেননি। মেলার হুজুগে পাঠক বই কিনেছেন, সেই বই তাদের হৃদয়ে দাগ ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে। সেই লেখকই বড় লেখক বা জনপ্রিয় লেখক, জীবিত অবস্থাতে তো বটেই, মৃত্যুর পরও সেই লেখকের বই বিক্রি হবেই। আমাদের চোখের সামনে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হুমায়ূন আহমেদ। জীবিত অবস্থাতে বই বিক্রির ক্ষেত্রে তিনি ইতিহাস তৈরি করে গেছেন। ইতিহাস সম্প্রসারিত হলো তাঁর মৃত্যুর পর। বইয়ের বিক্রি আরও বেড়ে গেল। যত দিন যাচ্ছে, বিক্রি বেড়েই চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের পাঠকের ব্যাপারে বিশেষ কোনো আগ্রহ কোনো দিনও ছিল না হুমায়ূন ভাইয়ের। তিনি বাংলা ভাষার একমাত্র লেখক, পুজোসংখ্যা ‘দেশ’ পর পর সাতবার তাঁর উপন্যাস ছেপেছে। ‘আনন্দবাজার গ্র“প’-এর পত্রিকাগুলোর পুজো সংখ্যায় যে উপন্যাস প্রকাশিত হয়, সেগুলো সাধারণত ‘আনন্দ পাবলিশার্স’ থেকে বই হয়ে বেরোয়। হুমায়ূন ভাই তাঁর বই ‘আনন্দ পাবলিশার্স’কে দিতেন না। বইগুলো বেরোত ঢাকা থেকে। একেক মেলায় পঞ্চাশ-ষাট হাজার কপি বিক্রি হতো। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গে তাঁর বইয়ের তেমন চাহিদাও ছিল না। এখন তাঁর বইয়ের বিক্রি সমানতালে বেড়ে চলেছে পশ্চিমবঙ্গে। কলকাতার এক তরুণ লেখক হুমায়ূন ভাইয়ের আদলে লিখে বেশ জনপ্রিয় হয়ে গেছেন।

এক সময় নিয়মিত বইমেলাতে যেতেন হুমায়ূন ভাই। আমেরিকা থেকে দেশে ফিরলেন ’৮৪ সালের শুরুর দিকে। তার আগে মাত্র কয়েকটা বই ছিল তাঁর বাজারে। ফিরে আসার পর ধীরে ধীরে তিনি আবার লিখতে লাগলেন। হুমায়ূন আহমেদ বোধহয় বাংলাদেশের একমাত্র লেখক, যিনি তিন-চারটা পাতলা পাতলা বই লিখে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়ে গিয়েছিলেন ১৯৮২ সালে। তখন তিনি আমেরিকার ‘নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটি’তে পিএইচডি করছেন ‘পলিমার কেমিস্ট্রি’তে। পুরস্কার পাওয়ার খবরটি তিনি তাঁর প্রফেসরকে দিলেন। শুনে সেই ভদ্রলোক হতভম্ব! ‘তুমি কেমিস্ট্রির লোক, সাহিত্যের এত বড় প্রাইজ কী করে পেলে?’ হুমায়ূন ভাই আর কী জবাব দেবেন! কিন্তু বিশেষ করে যে বই দুটোর জন্য তাঁকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হলো, সেই বই দুটো ‘নন্দিত নরকে’ ও ‘শঙ্খনীল কারাগার’। এই পাতলা বই দুটো বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি, অমূল্য সম্পদ। পৃথিবীতে বহু পাতলা বই আছে, যেগুলো সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ। যেমন- ‘ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সী’ অথবা ‘আউট সাইডার’। পাতলা বা মোটা দিয়ে ভালো বইয়ের বিচার হয় না।

প্রথম দিকে ফুলের মতো ছোট ছোট তিনটি মেয়েকে নিয়ে মেলায় আসতেন হুমায়ূন ভাই। বড় মেয়েটি পাশে পাশে হাঁটছে। মেজোটির হাত ধরা। আর ছোটটি কোলে। একবার ওই অবস্থায় আমার সঙ্গে দেখা। ছোট মেয়েটিকে আমার কোলে দিয়ে বললেন, ‘ওকে কোলে রাখো, আমার সিগারেট খেতে হবে।’ সেই ছোট ছোট মেয়েগুলো এখন কত বড় হয়ে গেছে। কারও কারও সন্তানও বড় হয়ে গেছে। আমাদের জীবনের আনন্দে ভরা দিনগুলো শুকনো পাতার মতো উড়ে চলে গেছে।

হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল অতি নাটকীয়ভাবে। ’৮৪ সালের কথা। বইমেলায় আমি একটা স্টলে বসে আছি। একজন চশমা পরা, শীর্ণ শরীরের মেধাবী চেহারার মানুষ এসে সামনে দাঁড়ালেন। তাঁর হাতে আমার ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’ বইটি। দেখেই আমি তাঁকে চিনতে পেরেছি। ‘খান ব্রাদার্স’ থেকে বেরিয়েছিল তাঁর প্রথম বই ‘নন্দিত নরকে’। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন তাঁর অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও শামিম শিকদার। সেই বইয়ের ব্যাক কাভারে লেখকের পাসপোর্ট সাইজের একটা ছবি ছাপা হয়েছিল। বইটি দু-তিন বার পড়ে ফেলেছি। ‘শঙ্খনীল কারাগার’ও পড়েছি দুবার। আর লেখকের ছবি দেখে তাঁকে চিনে রেখেছি। আরে, এ তো হুমায়ূন আহমেদ! আমি ব্যস্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়েছি। পরের ঘটনাটি এই জীবনে আমি কখনো লেখার সাহস পেতাম না, যদি হুমায়ূন ভাই নিজে লিখে না যেতেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘জীবনে একজন মাত্র লেখকের অটোগ্রাফই তিনি নিয়েছিলেন। আমেরিকায় বসে শুনেছিলেন বাংলাদেশে একজন অতি তরুণ লেখক জনপ্রিয় হয়েছে...’

পরিচয়ের প্রথম দিনই হুমায়ূন ভাই আমাকে তাঁর ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়েছিলেন। শ্যামলী রোডের পুবদিককার গলির অনেকটা ভিতরে, এখন যেখানে শামসুর রাহমানের বাড়ি, তার পিছনে বিশাল একটা মাঠের ওপারে সদ্য ওঠা একটা বিল্ডিংয়ের দোতলা বা তিনতলায় হুমায়ূন ভাই থাকেন। ফ্ল্যাটে সেদিন বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা ছিল। কারণ একজন বিশিষ্ট মানুষকে তিনি দাওয়াত করেছিলেন। তাঁর নাম নিয়াজ মোর্শেদ, দাবার গ্র্যান্ডমাস্টার। সঙ্গে ছিলেন আমাদের সবার প্রিয় সালেহ চৌধুরী। হুমায়ূন ভাই তাঁকে ‘নানা’ ডাকতেন। মনে আছে, আমাকে দেখে হুমায়ূন ভাইয়ের প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন খান হেসে ফেলেছিলেন। কারণ আমার তখন মাথাটা ন্যাড়া। গলায় সোনার চেইন। নাকের তলায় লম্বা গোঁফ। দেখতে মাস্তান টাইপ। আমাকে লেখকদের মতো দেখায় না। আমার আসলে তখন ভয়াবহ দুর্দিন চলছিল। রুজি রোজগার নেই। অতিকষ্টে দিন চলে। বইমেলায় আসার রিকশা ভাড়াটাও থাকে না কোনো কোনো দিন। অনেক দিন গেন্ডারিয়া থেকে হেঁটে বাংলা একাডেমিতে এসেছি। কিন্তু কাউকে সেই অভাবের কথা বুঝতে দিতাম না। এমন একটা ভাব করে থাকতাম, যেন আমি খুবই সচ্ছল আর বিশাল অবস্থার মধ্যে আছি। দিন সাতেক পর বাসা ভাড়ার দেড় হাজার টাকা দেওয়ার জন্য গলার চেইনটা আমাকে বিক্রি করতে হয়েছিল। শামসুর রাহমানের কথায় মনে পড়ল, এই মহান কবির সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের অদ্ভুত একটা মিল আছে। তাঁদের দুজনারই ডাকনাম ‘বাচ্চু’।

হুমায়ূন ভাইয়ের ব্যাপক জনপ্রিয়তা শুরু হলো তাঁর প্রথম টিভি ধারাবাহিক ‘এইসব দিনরাত্রী’ থেকে। নাটকের জনপ্রিয়তা বইয়ের ক্ষেত্রেও বড় রকমের প্রভাব ফেলল। একদিকে বাংলাদেশের টিভি দর্শক মেতে উঠলেন এই নাটক নিয়ে, অন্যদিকে বইয়ের পাঠক ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁর বইয়ের দিকে। ১৯৮৫ সালের কথা। নাটকটির প্রযোজক ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। তখন প্রায়ই এই নাটকের রিহার্সেলে আর রেকর্ডিংয়ে হুমায়ূন ভাই আমাকে নিয়ে যেতেন। বিটিভিতেই রিহার্সেল হতো, বিটিভির সেটেই রেকর্ডিং হতো বেশির ভাগ। হুমায়ূন ভাই ততদিনে শ্যামলীর বাসা ছেড়ে আজিমপুরে চলে এসেছেন। মোস্তাফিজুর রহমান থাকেন আজিমপুরের সরকারি কলোনিতে। আমাকে নিয়ে তাঁর ফ্ল্যাটেও প্রায়ই যেতেন হুমায়ূন ভাই। নাটক নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আড্ডা হতো। প্রায়ই রাতের খাবার মোস্তাফিজ ভাইয়ের বাসায় আমরা সেরে আসতাম। মোস্তাফিজ ভাইয়ের ফ্ল্যাটটা ছিল তিনতলায়। টিমটিমে একটা আলো জ্বলতো ফ্ল্যাটের সামনে। তাতে অনেক কিছুই পরিষ্কার দেখা যেত না। একদিন সন্ধ্যার পর হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে গেছি, কলিংবেলটা ছিল দরজার মাথার কাছে। সেটা টিপ দিতে গিয়েই ‘উরে বাপ রে’ বলে ভয়ার্ত এক চিৎকার করে সরে এলেন হুমায়ূন ভাই। আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। কী ব্যাপার? তিনি তখন ভয়ে রীতিমতো কাঁপছেন। কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘মাকড়সা’। দেখি কলিংবেলটার পাশে বড় একটা মাকড়সা বসে আছে। সেই প্রথম জানলাম তাঁর মাকড়সার ভীতির কথা। তাঁদের পরিবারের অনেকেরই নাকি মাকড়সা ভীতি প্রবল।

টেলিভিশনে ‘এইসব দিনরাত্রী’ চলছে। ততদিনে হুমায়ূন ভাইকে ঘিরে আমাদের ছোট্ট একটা দল হয়েছে। সালেহ চৌধুরী, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ আর আমি। নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গেও হুমায়ূন ভাইয়ের বেশ ঘনিষ্ঠতা। বাবার নামে তাঁদের কুতুবপুর গ্রামে ছোট একটা পাঠাগার করেছেন হুমায়ূন ভাই। আমাদের নিয়ে গেলেন সেই পাঠাগার উদ্বোধন করতে। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী আর তিনকন্যা। খালাম্মা আগেই চলে গিয়েছিলেন গ্রামে। শেষ বিকেলে পৌঁছে পাঠাগার উদ্বোধন করা হলো। আমরা প্রত্যেকেই মাইকে কিছু কিছু কথা বললাম। হুমায়ূন ভাই এত মুখচোরা তখন, কথাই বললেন না। পিছনে দুহাত, তাঁর সব সময়কার ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে পায়চারি করছেন। আর ফুঁক ফুঁক করে সিগারেট টানছেন। সেই রাতে গ্রামের এক বাউলের বাড়িতে গান শোনাতে নিয়ে গেলেন আমাদের। অতি দরিদ্রজনের বাড়ি। উঠানে একটা ভাঙা বেঞ্চ রাখা আছে, দুয়েকটা নড়বড়ে চেয়ার। আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছি। বাউল তাঁর মতো করে গেয়ে চললেন। হুমায়ূন ভাইকে দেখি সেইসব গান শুনে খুব অন্যমনস্ক হয়ে আছেন। আকাশে চাঁদ ছিল, তিনি তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। সেই প্রথম আমি অনুভব করলাম, এই মহান লেখকের বাউল ধরনের গানের প্রতি আকর্ষণ, আর চাঁদ ও জ্যোৎস্না তাঁকে কতটা প্রভাবিত করে। পরবর্তীকালের পাঠক শ্রোতারা জেনেছেন নিজের সিনেমার জন্য কী অসামান্য সব গান লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ। হাছন রাজা, রাধা রমন, শাহ্ আবদুল করিম, উকিল মুন্সি এই ধরনের বাউল ও মরমী গীতিকারদের হিরকখন্ডের মতো একেকটি গান নিজের নাটকে ব্যবহার করে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। যেমন- ‘আইজ পাশা খেলবো রে শ্যাম’ অথবা ‘ভ্রমর কইয়ো গিয়া’ অথবা ‘আমার শোয়া চান পাখি’ এইসব গান হুমায়ূন আহমেদের কল্যাণে নতুন করে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছে।

কুতুবপুর থেকে আমরা গিয়েছিলাম ময়মনসিংহ শহরে। বিকাল হয়ে গেছে। সবাই ক্ষুধার্ত। এক ভদ্রলোকের খুব শখ হুমায়ূন আহমেদকে তাঁর বাড়িতে খাওয়াবেন। ‘এইসব দিনরাত্রী’ দেখে তারা প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছেন। নাট্যকারকে খাওয়াবেনই। খেতে গিয়ে বসে আছি দলবেঁধে। সেই বাড়ির রান্না আর শেষই হয় না। ক্ষুধায় বাচ্চাদের মুখ শুকিয়ে গেছে। আমাদেরও পেট চো চো করছে। কিন্তু বাড়ির রান্না শেষই হয় না। শেষ হতে হতে বিকাল প্রায় ফুরিয়ে গেল। খাওয়া-দাওয়া করতে করতে আরও আধাঘণ্টা। আমার ধারণা ওদিনই প্রথম জনপ্রিয়তার মাশুল দিতে হয়েছিল হুমায়ূন ভাইকে। পরের দিকে যদি এরকম ঘটনা ঘটতো, তাহলে এক মিনিটও ওই বাড়িতে অপেক্ষা করতেন না তিনি। ‘খেতাপুড়ি’ বলে বেরিয়ে আসতেন। শাওনের ভাইয়ের বিয়েতে গেছেন আমাদের নিয়ে। খেতে দেওয়া হলো। খাবার ঠান্ডা। প্লেট ছুড়ে ফেলে দিলেন হুমায়ূন ভাই। প্রচ- রেগে শাওনকে বললেন, ‘তুমি জানো না আমি ঠান্ডা খাবার খাই না?’

সেই যাত্রায় সন্ধ্যার ট্রেনে ভাবি বাচ্চারা ঢাকায় ফিরে এলো সালেহ ভাইয়ের সঙ্গে। নির্মলেন্দু গুণের একটা ফ্ল্যাট ছিল ময়মনসিংহ শহরে। হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ আর আমি চলে গেলাম তাঁর ফ্ল্যাটে থাকতে। হুমায়ুন আজাদ আর নির্মলেন্দু গুণ ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই রাতে দুই বন্ধু কী যেন কী বিষয় নিয়ে এমন ঝগড়া শুরু করলেন, একটানা চার-পাঁচ ঘণ্টা চলল সেই ঝগড়া। হুমায়ূন ভাই মাথা নিচু করে সিগারেট টানছেন। আমি বসে আছি তাঁর পাশে। আমাদের মুখে কোনো কথা নেই। ফেরার দিন ট্রেনে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আমি তাঁকে বললাম, ‘আপনার চাচা ভালো আপ্যায়ন করেছেন আমাদের। খাওয়া-দাওয়া বেশ ভালো ছিল।’ হুমায়ূন ভাই সিগারেটে টান দিয়ে বললেন, ‘হু, ফেরার সময় আমার হাতে দেড় হাজার টাকার একটা বিল ধরিয়ে দিয়েছেন। ঢাকায় গিয়ে টাকা জোগাড় করে পাঠাতে হবে।’ তখন এমনই অবস্থা ছিল। লেখালেখি করে সেই মানুষটি তারপর সম্রাটের মতো জীবনযাপন করেছেন। ধানমন্ডিতে বাড়ি ও ফ্ল্যাট, শ’খানেক বিঘার ‘নুহাশপল্লী’, সেন্টমার্টিন দ্বীপের রিসোর্ট, বাবার নামে কুতুবপুরে বিশাল স্কুল, কী না করেছেন তিনি? তাঁর আগে কোনো বাঙালি লেখক এরকম ঐশ্বর্য কল্পনাও করেননি।

আমার তখন খুবই দুর্দিন চলছে। বড়মেয়েটি হলো সেই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে। হুমায়ূন ভাইকে খবরটি দিতেই তিনি বললেন, ‘মেয়ে হয়েছে, এবার তোমার দিন ফিরবে।’ সত্যিই তারপর থেকে আমার দিন ফিরতে শুরু করেছিল। বইমেলায় তখন প্রতিদিনই আসতেন তিনি। ‘অন্যপ্রকাশ’ তাঁদের জয়যাত্রা শুরু করেছে। আমরা দুজন ‘অন্যপ্রকাশ’-এর স্টলে বসে পাঠকদের চাহিদা মেটাই। হুমায়ূন আহমেদ চেয়ারে বসতেন দু’পা তুলে। হাতের কাছে চায়ের কাপ। ভক্ত পাঠক অটোগ্রাফের জন্য লাইন দিয়ে আছে। বাঁ হাতে সিগারেট ধরে একটান সিগারেট আর এক চুমুক চা খাচ্ছেন। একটার পর একটা বই এগিয়ে দিচ্ছেন লাইন ধরা পাঠক। তিনি মাথা নিচু করে অটোগ্রাফ দিয়েই যাচ্ছেন। এমন ভিড় হলো ‘অন্যপ্রকাশ’ এর সামনে, পুরো মেলা যেন ওই একটি জায়গায়। তখন বাংলা একাডেমির ডিজি ডক্টর সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। তিনি এসে বোধহয় হুমায়ূন ভাইকে কিছু বলেছিলেন। হুমায়ূন ভাই রাগ করে বাড়ি চলে গেলেন। এই নিয়ে প্রকাশকরা ক্ষুব্ধ। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন মেলা চালাবেনই না। তখন মেলা হতো বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের ভিতর। পরে আনোয়ার হোসেন স্যার গেলেন তাঁকে ফিরিয়ে আনতে। তিনি এলেন। তাঁকে বসতে দেওয়া হলো বাংলা একাডেমির মূল ভবনের বারান্দায় চেয়ার টেবিল পেতে। বিশাল লাইন হলো পাঠকের। সেখানে বসে অটোগ্রাফ দিয়ে চললেন হুমায়ূন আহমেদ। এখনো সেই দৃশ্য আমার অন্তরের ফ্রেমে বাঁধানো আছে।

শুরুর দিনগুলোতে প্রায়ই বাংলা বাজারের প্রকাশকদের কাছে গিয়ে আমরা বসে থাকতাম, দু-চারশো টাকা রয়্যালটি পাওয়ার আশায়। বেশির ভাগ দিনই শূন্য হাতে, মন খারাপ করে ফিরতে হতো। তবে সেইসব দিনেও আমাদের আনন্দের কমতি ছিল না। ওই সময়ে ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি ক্লাব’-এ প্রায় বিকালেই আড্ডা দিতাম আমরা। সালেহ চৌধুরী, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমি। সালেহ ভাই গল্প শুরু করলে সহজে থামতেন না। তিনি গল্প শুরু করতে গেলেই হুমায়ুন আজাদ বলতেন, ‘লম্বা করবেন না সালেহ সাহেব।’ ভারতীয় দূতাবাসের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে শামসুর রাহমানের খুব ভাব ছিল। ভদ্রলোক থাকতেন ধানমন্ডির একটি ফ্ল্যাটে। সেখানেও আড্ডা দিতে যেতাম আমরা। শামসুর রাহমানকে ঘিরে ওরকম একটা আড্ডার ছবি আছে। সামনের সারিতে শামসুর রাহমানের পাশে সালেহ চৌধুরী আর হুমায়ুন আজাদ, পেছনের সারিতে হুমায়ূন আহমেদ আর আমি। হুমায়ূন ভাইয়ের চোখে চশমা, আমার নাকের তলায় লম্বা গোঁফ। এ ছবির বহু বছর পর তাঁর ‘দখিন হাওয়া’র ফ্ল্যাটে একদিন সৈয়দ শামসুল হক এলেন। আমরা দুজন তাঁর দুপাশে বসে গভীর ভালোবাসায় তাঁর হাত জড়িয়ে রাখলাম। এ ছবিটিও আমার খুব প্রিয়। বোধহয় মাজহার তুলেছিলেন। একবার হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে আগরতলায় গিয়েছিলাম। যাওয়াটা আগরতলা বইমেলা উপলক্ষে। আসল উদ্দেশ্য জায়গাটা ঘুরে দেখা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আগরতলা মেলাঘর খুব বড় জায়গা দখল করে আছে। আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই ওখানটায় ট্রেনিং নিয়েছিলেন। সেসব জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখলাম আমরা। একটা প্রাচীন মন্দির দেখতে গিয়েছি। কী যেন কী কারণে আনন্দে ফেটে পড়ছিলাম সবাই। হুমায়ূন ভাই দুহাত তুলে শিশুর মতো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিলেন। আমি পেছন থেকে তাঁকে জড়িয়ে ধরেছি। মাজহার ছবি তুললেন। এ আমার জীবনের এক স্মরণীয় ছবি। জনপ্রিয়তার আকাশ স্পর্শ করতে চলেছেন হুমায়ূন ভাই, তখন টেলিভিশন নাটকের সুন্দরী কোনো কোনো নায়িকা তাঁকে প্রেমপত্র লিখতে শুরু করলেন। বাড়িতে বসে তো আর সেসব চিঠি পড়া যায় না! চিঠিগুলো পকেটে নিয়ে তিনি চলে আসতেন আমার গেন্ডারিয়ার ফ্ল্যাটে। বসার ঘরে এক কোণায় আমার ছোট্ট লেখার টেবিল। ফ্ল্যাটে ঢুকেই তিনি বলতেন, ‘তোমার বউকে চা দিতে বলো।’ চেয়ারে পা তুলে বসে চা খাচ্ছেন, আর একটার পর একটা চিঠি পড়ছেন। আমার বড়মেয়েটির বয়স বছর তিনেক। সে গিয়ে একদিন বলল, ‘তুমি আমার বাবার চেয়ারে বসেছ কেন?’ হুমায়ূন ভাই চিঠি থেকে চোখ তুললেন, চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘আমি তোমার বাবার চেয়ে অনেক বড় লেখক। এই চেয়ারে আমিই বসব।’

এই বড় লেখককে নিয়ে আমি একটি বই লিখেছি। বইটির নাম ‘কেমন ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ’। এবারের মেলায় ‘অন্যপ্রকাশ’ থেকে বইটি বেরিয়েছে। বইজুড়ে আমাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের কথা আর বহু বহু স্মৃতির উল্লেখ আছে। কত আনন্দ বেদনার দিন কাটিয়েছি আমরা, কত মোহময় দিনরাত্রী, কত ফাগুন দিনের স্মৃতি, কত জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া রাত্রীর কথা, আমি আমার মতো করে লিখেছি এই বইতে। ‘কেমন ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ’ বইটি আসলে বাংলা সাহিত্যের এক মহান লেখকের প্রতি অতি নগণ্য এক লেখকের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা নিবেদন। ‘অন্যপ্রকাশ’-এর মাজহারুল ইসলাম আমাদের বহু দিনকার প্রিয়বন্ধু ও সহযাত্রী। হুমায়ূন ভাইয়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসা সীমাহীন। তিনি মাজহারকে পুত্রের মতো ভালোবাসতেন। ‘কেমন ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ’ মাজহারই তাঁর ‘অন্যপ্রকাশ’ থেকে অতিযত্নে প্রকাশ করেছে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

সর্বশেষ খবর