রবিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

চারদিকে হতাশার নীরবতা

মেজর জিল্লুর রহমান (অব.)

চারদিকে হতাশার নীরবতা

আমি আর ডামি নির্বাচনের পর চারদিকে অলুক্ষুণে হতাশার স্তব্ধতা আর নীরবতা। রাজনীতিতে সুদিন-দুর্দিন আছে, থাকবে। তবে বেপরোয়া রাজনীতি ভালো নয়। জল-স্থল, আকাশ যেখানে তাকাবেন সেখানেই রাজনীতি আর রাজনীতি। যত নষ্টের মূল সব ক্ষেত্রে অপরাজনীতির প্রবণতা। দেশপ্রেম, ন্যায়-অন্যায়, নৈতিকতা বোঝাতে, নাগরিকদের সচেতন করতে, সুশিক্ষিত করতে যে শিক্ষা দরকার তা অপরাজনীতির গোলকধাঁধায় হারিয়ে গেছে। তা আর কোনো দিন খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।

গত এক যুগে শিক্ষা নিয়ে পাইকারি হারে খেলতামাশা হয়েছে। স্কুলের ছাত্র স্কুল বানান জানে না। কলেজপড়ুয়া ছাত্র কলেজের বাংলা অর্থ জানে না। অথচ সোনার জিপিএ সনদ তাদের হাতে ধরিয়ে  দেওয়া হচ্ছে।  যোগ্যতাপ্রমাণের পরীক্ষা পাশ কাটিয়ে শিক্ষকদের দলীয় সদস্য যোগ্যতায় চাকরি দেওয়া হয়েছে। হাজির হয় না, ক্লাস নেয় না, কেউ কাউকে মানে না; ফল যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। শিক্ষকরা মূর্খ হলে কী শেখাবে? স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিক শিক্ষকরা তাদের অজ্ঞতা ঢাকতে ছাত্রদের শূন্য কলসিতে শিক্ষার নামে সনদ বিলাচ্ছেন।

শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি। আজ আমি শিক্ষা নিয়ে লিখছি না, শুধু মূল লেখার সঙ্গে শিক্ষার গুরুত্ব অধিক তাই ভূমিকায় একটু খোঁচা দিয়ে আলোচনায় এলাম। জন অধিকার, মানবধিকার দেশের মানুষ ভুলে গেছে। গণতন্ত্রের নব অনুশীলনে আদর্শিক গণতন্ত্র উবে যাচ্ছে। নির্বাচন হলো, ক্যাবিনেট গঠন হলো, পাঁচমিশালি পার্লামেন্ট দেশ কোথায় নেবে এসব নিয়ে তেমন শোরগোল, উচ্চবাচ্য নেই। সরকার গৎবাঁধা বুলি আওড়াচ্ছে, যা চর্চা করছে জনগণ সায় দিচ্ছে। সম্মতি না থাকলে রাস্তায় নেমে আসত। কেউ রাস্তায় আসেনি, প্রতিবাদ করেনি। ধরে নেয় জনগণ মেনে নিয়েছে। তা না হলে পথে আন্দোলন করত। জনগণের কোমর ভাঙা, দাঁড়ানোর ক্ষমতা অবশ ইনজেকশন দিয়ে রহিত করা।

রাজনীতিকদের কেউ কেউ কোন মাত্রার লোভী তার একটা পরীক্ষা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবার নির্বাচনের আগে প্রার্থিতার অভিনব কায়দায় দেশবাসীকে দেখালেন। মহাজোটে থেকে জাতীয় পার্টি হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে। এবার আসন নিয়ে অঙ্ক মেলাতে দেরি হলো; শেষমেশ জি এম কাদের সাহেব প্রধানমন্ত্রীর মন গলাতে পেরেছেন ২৬ আসন পকেটে নিয়ে। তিনি অর্থ বণ্টন, আসন বণ্টন সব লেজেগোবরে করে দলের বিদ্রোহের মুখে পড়েছেন। তিনি আদর্শিক কথা বলেন মুখে, কাজে রাজনৈতিক সুবিধা পকেটে ভরতেও পারঙ্গম।

জি এম কাদের সাহেব নিজ স্ত্রীকে কোন যোগ্যতায় দিলেন ঢাকা ১৮ আসন? ভেবেছিলেন নৌকার জনপ্রিয় হেভিওয়েট প্রার্থী প্রাক্তন এমপি হাবিব হাসানকে দেওয়া নমিনেশন পড়ন্ত বেলায় প্রত্যাহার করে বসাতে পেরেছেন। তাহলে এ আসন প্রধানমন্ত্রীর ইশারায় দখল করতে পারবেন। কী যোগ্যতায় উত্তরার মতো জায়গায় তাঁকে ভোট দেবে- যখন ঘোষণা এলো আওয়ামী লীগে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করতে বাধা নেই। গাঁই হারা হারল জাতীয় পার্টি। প্রতিদ্বন্দ্বিতা দুই লীগের মধ্যে হলো।

অনেক শক্তিশালী প্রার্থী ছিল ঢাকা-১৮ আসনে। এমপি হাবিব হাসানের পাশাপাশি প্রবীণ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জেল হোসেন নুহনবীর জমানা থেকে আওয়ামী লীগ করা প্রাচীন নেতা। এবার যুবসমাজের মধ্যমণি জনপ্রিয় নেতা খসরু দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত বাজিমাত করলেন।

হাটহাজারী থেকে এক লাফে কক্সবাজারে দুই কদম রেখেই আওয়াজ দিয়ে জেনারেল ইবরাহিম নামে এক জাতীয় ইমানদার জব্বর খেলতামাশা দেখালেন। তাঁর ‘হাউশ পূরণ হইছে’ সংসদে হাজিরা দেওয়ার। চাপার জোরে দেশপ্রেমের প্লাবন বইয়ে দিয়েছেন এতদিন।

এবার আখেরি প্রাপ্তির ভিক্ষার ঝুড়ি প্রধানমন্ত্রীর দানখয়রাতে ভরে মাথায় নিয়ে সমুদ্রস্নানে গেলেন পুলকিত চেহারায়। কক্সবাজারে তিনি স্থানীয় সব নেতা দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হলেন তার পরও গায়েবি মাজেজায় এমপি! এমন পল্টি মেরে কারও অধিকার হরণ করে এমপি হওয়ার চেয়ে তিনি আগে যা ছিলেন তাতেই তো ভালো ছিলেন। মেজর শাহজাহান ওমর জেল থেকে লাফ দিয়ে নৌকা মাথায় নিয়ে দাঁড়ালেন। কীর্তিমান ডিগবাজি খাওয়া রাজনীতিককে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে তার সহকর্মীরা নাজেহাল করলেন। এক গায়ক গোহারা হেরে চোখের পানি নাকের পানি এক করে প্রলাপ বকছেন। মবিন-তৈমূর রাজপথে হায় কী হলো! হায় কী হলো! করে পেরেশান। এমন তো কথা ছিল না বলে মাতম করে চোখের জলে বুক ভেজাচ্ছেন। নির্বাচনের আগে উদ্বেগ ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে। নির্বাচনের পর সব দিকে অনিশ্চয়তার নীরবতা। সরকারি দল সংসদ সদস্যদের শপথ, মন্ত্রিপরিষদ এসব উৎসব নিয়ে বেজায় খুশি। নীরবতা ভেঙে রুহুল কবির রিজভী খোঁড়াতে খোঁড়াতে বিএনপি অফিসের তালা ভেঙে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। এ যেন আন্দোলনের প্রতিবাদের বিপ্লবের হাতুড়ি তিনি হাতে নিয়েছেন। তাতে তাঁর দলের মনোবল আগের তাপমাত্রায় ফিরে না এলেও অন্ধকারে চেরাগ জ্বালিয়ে আন্দোলনের পথ দেখিয়েছেন।

এক মুঠ গুড়, এক চিমটি নুন, এক মগ পানি এ সংমিশ্রণ সংসদের চিত্র। সচেতন নাগরিকদের ক্ষোভ সংসদে বিরোধী দল নেই। যারা বিরোধী দল দাবি করছে, তারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার করুণার প্রোডাক্ট। তারা নিজের অস্তিত্ব টেকাতে প্রধানমন্ত্রীকে মহাখুশি করতে বাস্ত থাকবেন। তা না হলে সাজঘরে সাবেক ফার্স্ট লেডি রওশন এক পায়ে খাড়া আছেন জি এম কাদেরকে হটাতে। শুধু প্রধানমন্ত্রী বাঁশি বাজালে খেলা শুরু হবে। জাতীয় পার্টি ত্রিশঙ্কু অবস্থায় চলছে, চলবে। ভারসাম্যের রাজনীতি দেশান্তরিত এখন।

সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধীদের ভূমিকা এবং সক্রিয় বিরোধিতা শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, শাসককে সঠিক পথ দেখাতে ও কল্যাণের কাজ করতে উৎসাহিত করে সাহায্য করে। আমাদের সরকারের কাছে বিরোধীরা প্রতিপক্ষ নিন্দুক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘তোতাকাহিনী’-তে নিন্দকের ভূমিকা যে কতখানি, তা পাঠকের গোচরে এনেছেন। গত পৌনে দুই দশকে বাটি চালান রাজনীতির ফেরে উপর্যুপরি একটার পর একটা নির্বাচনে পর্যদুস্ত বিএনপি। বিএনপি ২০০৭ সালে শাসনক্ষমতা হারানোর পর থেকে সরকারের বিরুদ্ধে কয়েকটি বিভাগীয় সমাবেশ ও ঢাকায় মহাসমাবেশ ছাড়া বড় কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। বিএনপি এখন আদালতে হাজিরা ও টিভি চ্যানেলে যাচ্ছে জানান দিয়ে। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত অবধি টকশো বিতর্ক টেবিলে কিছু আদমের সামনে মুখ দেখান আর গলাবাজি করতে।

এ দলটির কই মাছের মতো শক্ত প্রাণ। এত লোভলালসার টাটকা প্রলোভন কোনো কিছুতেই আজও ভাঙা গেল না। দলের সব নেতা-কর্মী নফসের সঙ্গে জিহাদ করছেন এজন্য সাধুবাদ। তবে বৃহত্তর জনগণের স্বার্থবাহী কোনো উল্লেখযোগ্য আন্দোলন এযাবৎকাল গড়ে তুলতে পারেননি তাঁরা।

বিগত একপক্ষীয় নির্বাচনগুলোয় বয়কট বলুন আর আসনসংখ্যা বলুন ও ভোট প্রাপ্তির নিরিখে বিএনপিকে রাজনীতিতে আপাতত গুরুত্বহীন মনে হলেও, সরকারের ভুল কান্ডকীর্তি তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা উজ্জ্বল করতে পারে। দুর্নীতি, অর্থ পাচার রোধের ব্যর্থতায় সরকারের ওপর থেকে দেশের একাংশের আস্থা কমছে। 

কর্মহীনতা আজ প্রধান সমস্যা। সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে ও হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের পরিকাঠামো ভেঙে পড়েছে। এখন গণতন্ত্রের আড়ালে বইছে শাসক দলের গোঁয়ার্তুমি, ভয়ের চোরাস্রোত। দরকার এখন মহাডাক রুটি-রুজি-কর্মসংস্থান ও ভেঙে পড়া শিক্ষা-স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য। অনাগত দিনের জন্য সরকারের কাছে প্রশ্ন রেখে গেলাম, বানের পানির মতো দলে ঢোকা লোকের সমর্থন কি ভোটবাক্সে প্রতিফলিত হবে? ভেবে দেখুন এরা আসছে পয়সা কামাতে। দুই দলের কদর্য রাজনীতির অথই সাগরে আমজনতা। বিরোধী দলের ২৮ অক্টোবরের সমাবেশ মানুষের কাছে একটা বিকল্প পথের দিশা উঁকি দিয়েছিল মাত্র।  নানা বাধাবিপত্তি, সমস্যাবিধ্বস্ত মানুষ যেভাবে শীতের রাত খোলা আকাশের নিচে কাটিয়ে ওই সমাবেশ ঐতিহাসিক-স্মরণীয় করে তুলেছিল, তা যথেষ্ট সুদূরপ্রসারী অর্থবহ-ইঙ্গিতবহ। রাজনীতিতে আরেক জ্বালা মানুষের যুক্তি দিয়ে ভালোমন্দ বিচার করার আগেই তার ওপর নিজের মতামত চাপিয়ে দিতে চায় সব দল,  যাতে মানুষ নিজে ভাবতে না পারে। মনে হচ্ছে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রাতঃস্মরণে রাখেন অশোক বা আকবর কত মহান রাজা ছিলেন, তার চেয়ে বড় ব্যাপার তাঁরা দক্ষ প্রশাসন চালাতে পেরেছিলেন। বিভাজনের রাজনীতি যত জুতসই মনে হোক, আখেরে মানতে হবে ঐক্যবদ্ধ জাতি ছাড়া কোনো উন্নয়ন টেকসই হয় না।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক

zillu65 @hotmail.com

সর্বশেষ খবর