রবিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

সহজ ও সহজাত ধর্ম ইসলাম

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

সহজ ও সহজাত ধর্ম ইসলাম

কয়েক বছর আগের ঘটনা। রোজার ঈদের আগে এক আত্মীয়বাড়ি বেড়াতে গিয়েছি। তারাবি শেষে সবাই মিলে খেতে বসেছি। কথাও হচ্ছিল একটু-আধটু। হঠাৎ ঘরের বড় ছেলে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মা! এবার থেকে আমরা টাকা দিয়ে ফিতরা দেব না, খাদ্য দিয়ে দেব। নবীজি (সা.) কখনো টাকা দিয়ে সদকায়ে ফিতরা দিতেন না। তাই টাকা দিয়ে সদকায়ে ফিতরা দেওয়া বিদাত।’ ২০ বছরের তরুণের মুখে এমন ফতোয়া শুনে অন্যরা মোটামুটি অবাকই হলেন। আমি কিন্তু অবাক হইনি। শুধু ফিতরা কেন, হেন কোনো আমল নেই যেটা নিয়ে আজ সাধারণ মানুষকে দিশাহারার মধ্যে ফেলা দেওয়া হয়নি। তবে আশার কথা হলো, সাধারণ মানুষ এখনো আলেমদের ওপর আস্থা রেখেছে। হুট করে কিছু করার আগে আলেমদের জিজ্ঞেস করে নেয়।

‘ভাই! টাকা দিয়ে ফিতরা দেওয়া যাবে না?’ ছেলেটির বাবার কৌতূহলের ধনুক থেকে প্রশ্নের তির এবার এলো আমার দিকে। আমি বললাম, আমাদের মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে তো যাবে। সঙ্গে সঙ্গে কর্কশ কণ্ঠে ভাতিজা বলে উঠল, ‘মাজহাব মানা তো শিরক! আপনারা সবাই শিরক করছেন।’ এবার আর কথা বাড়ানো সংগত মনে করলাম না। এটা আমার চিরদিনের অভ্যাস। আমি মনে করি, কেবল নিজের মতটা বলার জন্য তর্ক জুড়ে দেওয়া নফসের গোলামি ছাড়া কিছুই নয়। যাকে বলছি সে গ্রহণ করার মেজাজে আছে কি না বিবেচনা করাই প্রজ্ঞার পরিচয়।

মাসখানেক আগে ভাতিজার সঙ্গে  দেখা। সে আমাকে বলল, ‘চাচা! খুব পেরেশানিতে আছি। একেক হুজুর একেক রকম ফতোয়া দিচ্ছেন। আমরা সাধারণ মানুষ কোথায় যাব?’ হ্যাঁ, এবার সময় এসেছে কথা বলার। আসলে ভাতিজার মতো আজ আমরা সবাই দিশাহারা। আর এজন্য দায়ী আমরাই। বেশ কিছু হাদিসে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘বিশৃঙ্খলা ছড়ানো আলেমরাই সবার আগে জাহান্নামে যাবে।’ এ কারণে সাহাবি ও তাবেয়িদের মধ্যে অনেক বড় বড় আলেম তাকওয়ার কারণে সচরাচর কথাই বলতেন না। ফতোয়া দেওয়া দূরের কথা। তাবেয়িদের যখন ফতোয়া জিজ্ঞেস করা হতো তারা ভুল হওয়ার ভয়ে কিংবা শ্রোতা ভুল বুঝে ভুল আমল করবে এ ভয়ে ফতোয়া দিতেন না। এমন অনেক হয়েছে, একজন তাবেয়িকে ফতোয়া জিজ্ঞেস করা হয়েছে, তিনি বলেছেন আমি জানি না অমুকের কাছে জিজ্ঞেস করো। অমুকের কাছে গেলে তিনিও বলতেন আমি জানি না ওই আলেমের কাছে প্রশ্ন করো। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে দেখা যেত প্রশ্নকারী প্রথম ব্যক্তির কাছে এসে হাজির হয়েছে। এটি একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা। তবে এ মুহূর্তে আমার সামনে রেফারেন্স নেই। ভাতিজাকে বললাম, ‘আসলে আমরা সবাই দিশাহারা। কারণ আমরা সালাফদের নীতি ছেড়ে দিয়েছি। আমাদের পূর্বসূরি আলেমরা দীনের ব্যাপারে মুখলিস ছিলেন। আমরা নিজের দল ভারী করা, ভিউ বাড়ানো, ভাইরাল হওয়ার রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের পড়াশোনা এখন একতরফা হয়ে গেছে। তাই আমাদের ফতোয়াও একতরফা। আমাদের উদাহরণ অনেকটা অন্ধের হাতি দেখার মতো। কেউ হাতির কানে হাত দিয়ে বলছে এটা তো কুলা। আরেকজন হাতির পেটে হাত বোলাচ্ছে আর বলছে, ও মিথ্যাবাদী! এটা কুলা নয় মস্ত এক দেয়াল। তেমনি আমরাও এখন একটি-দুটি কিতাব পড়েই নিজেদের মস্ত বড় বিদ্বান ভাবছি আর মুখে যা আসছে তা-ই বলে বেড়াচ্ছি।’

কিছুক্ষণ থেমে ভাতিজার চোখের দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করলাম, ইলমি আলোচনার সাধারণ নিয়ম হলো কোনো মাসালায় যতগুলো সহি মত আছে সব উল্লেখ করা। প্রতিটি মতের সপক্ষে দলিল উপস্থাপন করা। মাজহাবের ইমামরা কে কোন মত প্রাধান্য দিয়েছেন এবং কেন দিয়েছেন তা ব্যাখ্যা করা। তারপর মুফতি তার নিজের মাজহাবের মত তুলে ধরবেন এবং কেন এ মত উত্তম তা প্রমাণ করবেন। প্রয়োজনবোধে এবং ইজতিহাদি যোগ্যতা থাকলে মুফতি নিজের মাজহাবের বাইরেও ফতোয়া দিতে পারবেন। ভাতিজা খেয়াল করো! আমি এখানে উত্তম শব্দ বলেছি এবং সচেতনভাবেই কথিত ‘সহি’ শব্দটি এড়িয়ে গেছি। কেননা চার মাজহাব ও গ্রহণযোগ্য আলেমদের প্রতিটি মতই সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা রাখে, অন্তত পরিস্থিতি বিবেচনায় সঠিক হতে পারে, সঠিক না হলেও ইজতিহাদ করার কারণে তারা সওয়াব পাবেন, তাই আমারটা বাদে বাকি সবারটা বাতিল বলব কোন যুক্তিতে?

এবার ভাতিজা বলল, ‘উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলে সহজ হতো।’

‘তাহলে শোনো! রসুল (সা.)-এর হজের ওপর একটি চমৎকার গ্রন্থ লিখেছেন উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম হাদিসবিশারদ শায়খুল হাদিস আল্লামা জাকারিয়া (রহ.)। ভূমিকায় তিনি বলেন, রসুল (সা.)-এর হজের গ্রন্থ লিখতে গিয়ে হাফেজ ইবনে কায়্যিমের জাদুল মাআদের চেয়ে বিস্তারিত কোনো গ্রন্থ আমার চোখে পড়েনি। তাই এ গ্রন্থটিই আমি ব্যাখ্যা করব এবং যেহেতু ইবনে কায়্যিম হানাফি মাজহাবের ছিলেন না, তাই বিভিন্ন মাসালায় আমি আহনাফের দলিলগুলো তুলে ধরব। দেখ, জাকারিয়া (রহ.) দেওবন্দি ধারার আলেম। আর ইবনে কায়্যিম হলেন ইবনে তাইমিয়ার শিষ্য, আহলে হাদিস ধারার আলেম। তবু কী অবলীলায় ইবনে কায়্যিমের গ্রন্থকে সেরা গ্রন্থ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন মাওলানা জাকারিয়া!

 

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি পীর, আউলিয়ানগর

সর্বশেষ খবর