রবিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও কিছু প্রস্তাব

ডা. মজুমদার গোলাম রাব্বী

বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন ডাক্তারবান্ধব বিধায় আমি একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁর কাছে আমার দীর্ঘদিনের চিন্তা উপস্থাপন করতে চাই-১. ডাটাবেজ : বর্তমানে দেশে কতজন ডাক্তার জীবিত, কতজন প্র্যাকটিসিং এবং কতজন বিশেষজ্ঞ আছেন তা আমরা জানি না।  তাই এ মুহূর্তে জরুরি হলো সরকার (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়) থেকে একটি অনলাইন রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করা। তাতে থাকবে সবার বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন নম্বর, পাসের সন, বর্তমান ঠিকানা, ডিগ্রি ও ট্রেনিং। সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠান সেখান থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী ডাক্তার নিতে পারবে। বয়স বিবেচনা না করে, শারীরিক ফিটনেস ও উদ্যম বিবেচনা করা উচিত। ২. জিপি প্র্যাকটিস চালু করা উচিত : অনলাইন রেজিস্ট্রেশন হালনাগাদ হওয়ার পর সরকার সব এমবিবিএস/বিশেষজ্ঞ সরকারি-বেসরকারি ডাক্তারের বর্তমান ঠিকানা ও জনসংখ্যার ঘনত্ব অনুযায়ী এলাকাভিত্তিক ভাগ করে দেবে। প্রত্যেক নাগরিক নিকটস্থ ডাক্তারের দ্বারস্থ হবেন। সংশ্লিষ্ট তার চিকিৎসার দায়িত্ব নেবেন এবং প্রয়োজনে রেফার করবেন। ৩. রেফারেল সিস্টেম চালু করা : একটি নিয়ম হবে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রেফার্ড ছাড়া নতুন রোগী দেখবেন না। প্রয়োজনে প্রাইভেট হাসপাতালে চার-পাঁচ জন মেডিকেল অফিসার নিয়োগ দেবেন। তাঁরা রোগীর ইতিহাস নিয়ে তারপর রেফার্ড করবেন। ফলে রোগীর ফার্মেসির দ্বারস্থ হওয়া কমে যাবে। ৪. স্পেশালিস্ট সাবজেক্ট : আমরা জানি না কোন বিষয়ে কতজন বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন। এজন্য মেডিকল কলেজ ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক এবং সিভিল সার্জনরা তালিকা দেবেন। সিভিল সার্জনরা জেলা শহর, উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড ও অঞ্চলভিত্তিক রোগের প্রাদুর্ভাব বিবেচনা করে কত বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন বিষয়ভিত্তিক তালিকা দেবেন। তারপর সবাই বসে ঠিক করবেন এমডি, এমএস ও ডিপ্লোমা ভর্তি পরীক্ষায় বিষয়ভিত্তিক কতজন করে নেওয়া উচিত। ৫. জনবল নিয়োগ : ইনস্টিটিউট, মেডিকেল কলেজ, জেলা হাসপাতাল, উপজেলা, ইউনিয়ন সাব-সেন্টারে সকাল-বিকাল-রাত হিসাব করে ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া উচিত। সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা ও দিনে একটি ডিউটি নিয়ম করা গেলে ডাক্তারদের কর্মস্থলে রাখা সম্ভব। বর্তমানে লাখের ওপর চিকিৎসক বিদ্যমান আছেন। সে বাস্তবতায় মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট (ম্যাটস) ট্রেনিং স্কুল প্রয়োজন আছে কি না ভাবতে হবে। ৬. সরকারি কর্মস্থলে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরকার সরবরাহ করবে। যেমন চক্ষু ডাক্তারের চেম্বারে স্লিট ল্যাম্প ও অটো রিফ্রাকটোমিটার প্রয়োজন। ৭. অ্যান্টিবায়োটিক ও স্টেরয়েড প্রেসক্রিপশন : বর্তমানে একটি আইন আছে রেজিস্টার্ড ডাক্তার ছাড়া কেউ অ্যান্টিবায়োটিক লিখতে পারবেন না। প্রসঙ্গক্রমে ডিএমএফ, নার্স, ফিজিওথেরাপিস্টরাও বিএমডিসি রেজিস্টার্ড। তাই আইনটি পরিবর্তন করা উচিত। এমবিবিএস ও বিডিএস ডাক্তার ছাড়া অন্য কেউ অ্যান্টিবায়োটিক ও স্টেরয়েড প্রেসক্রিপশন করতে পারবেন না, এ রকম আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। পাশাপাশি অ্যান্টিবায়োটিক লাল মোড়কে ও স্টেরয়েড হলুদ মোড়কে সরবরাহ করা উচিত। ৮. বাংলাদেশের রোগীরা পাশের দেশে চলে যাওয়ার কারণ : রোগীর সমস্যা মন দিয়ে না শোনা। পরীক্ষানিরীক্ষার ফল রোগীকে ব্যাখ্যা না করা। রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা না করা। রোগ সম্পর্কে রোগীকে তার ভাষায় ধারণা না দেওয়া। তাড়াহুড়া করে অপারেশনে যাওয়া। রেফার্ড না করে রোগী ধরে রাখা। সর্বোপরি রোগীকে নিজের বাবা-মা, ভাই-বোনের মতো ভাবতে না পারা। তাই কাউন্সেলিংয়ে জোর দিতে হবে। ৯. ল্যাব টেস্ট : সারা দেশের সব ক্লিনিকের পরীক্ষানিরীক্ষা একই মানদন্ড আনার চিন্তা করা। একবার একটি পরীক্ষা করলে তার রেজাল্ট এনআইডি সার্ভারে যুক্ত করা যায় কি না ভেবে দেখা উচিত। ১০. ভিজিট : অধ্যাপক, কনসালট্যান্ট, সাধারণ চিকিৎসক সবার ভিজিট নির্দিষ্ট করা উচিত। বিবেচনায় নিতে হবে ডিগ্রি, ট্রেনিং, জনপ্রিয়তা ও অভিজ্ঞতা। একজন ডাক্তার রোগীকে কত সময় দেবেন, সারা দিন তিনি কতজন রোগী দেখবেন তা-ও ভাবতে হবে। ১১. প্রমোশন : প্রমোশনের ক্ষেত্রে ডিগ্রি, ট্রেনিং, চাকরির বয়স ও কতজনকে তিনি প্রশিক্ষিত করতে পেরেছেন তা বিবেচনায় নিতে হবে। ১২. শিক্ষকতা ও ট্রেনিং দুই ক্ষেত্রেই কোয়ালিটি মনিটরিং চালু করা উচিত। ১৩. এফসিপিএস ও এমডি, এমএস ও ডিপ্লোমা পরীক্ষায় পরীক্ষকদের জবাবদিহি থাকবে কেন ফেল হলো এবং তারা সুপারিশ দেবেন। ওই পরীক্ষায় সিলেবাসে যে সার্জারির দক্ষতা বর্ণিত আছে, তা না জেনে যেন পাস না হয়, তা-ও দেখতে হবে। ১৪. একই সমমানের ডিগ্রি বারবার না নেওয়া চালু করা। যেমন শিশুতে এমডি করার পর এফসিপিএস না করা। তিনি শিশু কার্ডিওলোজিতে ডিগ্রি নিতে পারেন। ১৫. সরকারি ডাক্তারদের প্যাডে বিসিএস (স্বাস্থ্য) লেখার যৌক্তিকতা কী? এটা তো কর্মসংস্থান। ১৬. বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন হালনাগাদ করার ক্ষেত্রে শুধু টাকা দিয়ে ঠিক কি না চিন্তা করা। ১৭. অনারারি চিকিৎসকদের ভাতার ব্যবস্থা করা উচিত ৩০ হাজার টাকা কমপক্ষে। কোর্সে অধ্যয়নরত ডাক্তারের ভাতা কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা করা উচিত। অনারারি নাম বদলে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক করা যায়। ১৮. সব নাগরিকের জন্য উন্নত দেশের আদলে হেলথ ইনস্যুরেন্স চালু করা। ১৯. স্বাস্থ্যনীতি হালনাগাদ করা। ২০. সরকারি ডাক্তাররা সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত অফিস করবেন। সকল পর্যায়ে তা বাস্তবায়ন করা। ২১. সংসদ সদস্য, মন্ত্রী দেশে চিকিৎসা নিলে জনগণের দেশে চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি আস্থা বাড়ে। ২২. হেলথ সেক্টরে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা যায় কি না  ভেবে দেখা জরুরি। ২৩. পত্রিকায় ‘ভুল চিকিৎসা’ না লিখে ‘চিকিৎসা অবহেলা’ লেখার বিধান করা। ২৪. ডাক্তারদের সাপ্তাহিক ছুটি অন্য পেশার মতো দুই দিন হওয়া উচিত। শুক্র-শনি, ঈদ ও অন্য ছুটিতে অতিরিক্ত বেতনের ব্যবস্থা করা।

লেখক : কনসালট্যান্ট, বসুন্ধরা আই হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বসুন্ধরা, ঢাকা

সর্বশেষ খবর