বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

নীলফামারীর ভাষা আন্দোলন

জেড এ এম খায়রুজ্জামান

নীলফামারীর ভাষা আন্দোলন

নীলফামারী সরকারি উচ্চবিদ্যালয় ও ভাষাসৈনিক প্রধান শিক্ষক আছীর উদ্দীন আহমেদ

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীরাও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। উত্তরবঙ্গে অবস্থিত তৎকালীন রংপুর জেলার অন্তর্গত নীলফামারী মহকুমা শহরেও স্কুল ছাত্রীরা স্কুল ছাত্রদের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনে অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠেছিল। তাঁদের অনেকের নাম আজো অজানা রয়ে গেছে। এই লেখকের উদ্যোগে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন সাহসী স্কুলছাত্রীর নাম উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন-ছোমেলা বেগম, ফওজিয়া বেগম, জাকিয়া সুলতানা, ফিরোজা, হালিমা, রাবেয়া, সালেহা, সুফিয়া ও বুলু। লেখক মনে করেন আরও অনেকের নাম অজানা রয়ে গেছে।

ওপরে উল্লিখিত ছাত্রীরা সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ ছাড়াও পথনাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সেখানে তাঁরা দেশাত্মবোধক সংগীত পরিবেশন ও কবিতা আবৃত্তি করে স্থানীয় জনগণকে মাতৃভাষার বিরুদ্ধে চক্রান্ত রুখে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করতেন। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি নীলফামারী শহরে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত করেন শতবর্ষী নীলফামারী সরকারি উচ্চবিদ্যালয় (সাবেক নীলফামারী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়) এর প্রথম মুসলিম প্রধান শিক্ষক আছীর উদ্দিন আহমেদ। তিনি তাঁর ছাত্রদের স্কুল মাঠে জড়ো হওয়ার নির্দেশ দেন। তদানুযায়ী ছাত্ররা সেখানে সমবেত হন। তিনি যেসব ছাত্র ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদানে ইচ্ছুক তাঁদের হাত তুলে সম্মতি জানাতে বললেন। প্রত্যুত্তরে বেশির ভাগ ছাত্র হাত তোলেন। কিন্তু বিহারি ও মুসলিম লীগ অনুসারী ছাত্ররা হস্ত উত্তোলন থেকে বিরত থাকে।

পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষকের উৎসাহে নীলফামারীর পরিবেশে ব্যাপক পরিবর্তন আসে এবং স্কুলের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্ররা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নীলফামারী শহরটি মিছিলের শহরে পরিণত হয় এবং স্কুলে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। উর্দুভাষী ও মুসলিমলিগপন্থি ছাত্ররা প্রশাসনের ছত্রছায়ায় হামলা চালিয়ে আন্দোলন বানচালের চেষ্টা চালায়; কিন্তু তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। স্কুলের ছাত্রনেতা শফিয়ার রহমান, শামসুল ইসলাম, মাহবুবুর রহমান দুলু, শওকত আলী ও হেমন্ত রায় বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন। চলমান উত্তাল বিক্ষোভ উর্দুভাষী পাকিস্তানি মহকুমা প্রশাসক মনোয়ার হোসেন চৌধুরীকে হিংস্র করে তোলে। সে সর্বসম্মুখে প্রধান শিক্ষক আছীর উদ্দিন আহমেদ সাহেবের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। সে সম্ভবত ধারণা করেছিল যে, প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে ছাত্ররা ভীত হয়ে বিক্ষোভ থেকে সরে আসবে। কিন্তু এতদসংক্রান্ত যাবতীয় ধারণা ও হিসাব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ছাত্রদের বিক্ষোভ তাঁদের প্রাণপ্রিয় হেডস্যারকে নিয়ে এসডিওর কটূক্তির বিরুদ্ধে চরম ক্ষোভে পরিণত হয়। ছাত্ররা ক্রমাগত তিন দিন ফেব্রুয়ারি ৮, ৯, ১০ তারিখের স্কুলে ধর্মঘট বলবৎ করে। তাঁরা এসডিওর অপসারণ দাবি করে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে অনড় থাকেন। চলমান ছাত্র আন্দোলনের মাঝে একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে জানা যায়, ওইদিন ঢাকায় পুলিশের গুলিতে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, শফিকসহ আরও অনেকে মৃত্যুবরণ করেন। এমতাবস্থায় স্কুলের মুসলিম হোস্টেলে এক বৃহৎ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেখানে ফাওজিয়া বেগম ও ফিরোজা বেগম যোগ দিয়ে জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন। ২২ ফেব্রুয়ারি শত শত জনগণ নীলফামারীর রাস্তায় নেমে আসেন।

ইতোমধ্যে আন্দোলন বেগবান হয় যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক গণপরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা ও নীলফামারীর স্বনামধন্য রাজনীতিবিদ খয়রাত হোসেন ২২ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদ বর্জন করেন। ২৪, ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি শত শত জনগণ ভাষা আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করে মহকুমা শহরের রাস্তায় নেমে আসেন ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে স্লোগানে ফেটে পড়েন। সারা দেশব্যাপী দুর্বার গণআন্দোলনের মুখে অবশেষে পাকিস্তানি শাসকবৃন্দ নতি স্বীকার করে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি মেনে নেয়।

প্রসঙ্গত, উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কিংবদন্তি প্রধান শিক্ষক আছীর উদ্দিন আহমেদের দ্বিতীয় সন্তান ক্যাপ্টেন আর এ এম খায়রুল বাশার এএসসি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। যিনি ওই বছরের ২৯ মে শাহাদাতবরণ করেন। ১৯৮৯ সালের ২২ জুলাই কিংবদন্তি প্রধান শিক্ষক আছীর উদ্দিন আহমেদ শত শত ছাত্রকে কাঁদিয়ে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরপারে চলে যান। যথাযোগ্য মর্যাদায় তাঁর কর্মস্থল নীলফামারীতে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তাঁর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাঙালি জাতি তাঁর অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আজ তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে।

লেখক : দ্য ডেইলি সানের সিনিয়র সাব এডিটর ও ভাষাসৈনিক আছীর উদ্দিন আহমেদের সন্তান

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর