শুক্রবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

গরিবরা আগে জান্নাতে যাবে

আল্লামা মাহ্‌মূদুল হাসান

নবী (সা.) পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নবী ও মানুষ হওয়ার পরও সর্বদা গরিবি হালতে চলতেন ফিরতেন। যখন তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে গেলেন তখন তাঁর ঘরে এতটুকু সম্পদ ছিল না যা ওয়ারিসদের মাঝে বণ্টন করা যাবে। দুনিয়ায় যারা গরিব, নিঃস্ব, অসহায় তারা প্রকৃতপক্ষে গরিব নয়; তাদের জীবন তো নবী (সা.)-এর জীবনের সঙ্গে মিলে যায়। হাদিসে পাকে এসেছে, গরিবরা ধনীদের চেয়ে ৫০০ বছর আগে জান্নাতে চলে যাবে। আল্লাহ পাক বলেছেন, দুনিয়ায় যদি গরিব মানুষ না থাকত তাহলে আমি ধনাঢ্যদের ধ্বংস করে দিতাম। তার কারণ হলো, ধনীরা অর্থসম্পদ অর্জন করতে গিয়ে সীমা অতিক্রম করে হালাল-হারামের পার্থক্য করে না। কিন্তু গরিবের কারণেই আমি তাদের ধ্বংস করি না। সুতরাং বোঝা গেল, দুনিয়ায় গরিব হওয়া কোনো বদনসিবির বিষয় নয়; বরং এটা আখেরাতের বিরাট সম্বল। দরিদ্রতা আল্লাহর মুকাররাব হতে সহায়ক কেন? সর্বদা কোনো ব্যক্তি যখন তার চাহিদামাফিক ধনসম্পদ অর্জনে ব্যর্থ হয়, অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলে, সাধারণ দৃষ্টিতে সেই তো দরিদ্র-নিঃস্ব। জীবনযুদ্ধে বারবার হোঁচট খেয়ে সেই মানুষটি যখন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হয় তখন সংসারের দুঃখকষ্ট তাকে আর খুব বেশি পীড়া দিতে পারে না, ফলে স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুকালে আল্লাহর প্রতি তার বিশ্বাস হয় সুদৃঢ়। পক্ষান্তরে ধনী লোকের সম্পদের লোভ ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলে, যার কারণে সে দুনিয়ার রোজগারের প্রতি হয়ে পড়ে অত্যন্ত মনোযোগী। এমনকি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসেও সম্পদের মায়া ত্যাগ করতে পারে না।

ধনী লোক তো ধনের পাহারাদার মাত্র। ধনসম্পদের প্রকৃত মালিক তো আল্লাহই। তিনি দয়া করে যাকে ইচ্ছা তাকে সম্পদ দান করেন, যাকে ইচ্ছা করেন না। আল্লাহতায়ালা নেহায়েত দয়া করে যাকে ধনসম্পদ দান করেন সে ব্যক্তি যদি আল্লাহতায়ালার প্রতিনিধি হিসেবে ওই ধন গরিবের অভাবের সময় গরিবের হক আদায় না করে শুধু নিজের জন্য ব্যয় করে, তাহলে তাকে আল্লাহতায়ালার নিকট জবাবদিহি করতে হবে। একদা প্রিয়নবী (সা.) সাহাবিদের গরিবের দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে বললেন, কিয়ামতের ময়দানে মানুষ নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত মোট কথা বিভিন্ন ইবাদত নিয়ে হাজির হবে আল্লাহর সামনে। নানান রকমের মানুষ নানান আবদার নিয়ে এসে বলবে, হে আহকামুল হাকিমিন! এ লোক দুনিয়ার জীবনে আমাকে গালি দিয়েছিল, আমার মালসম্পদ আত্মসাৎ করেছিল, আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছিল। হিংসা-বিদ্বেষ, গিবত করেছিল ইত্যাদি। গিবত এবং তার অশুভ পরিণতির ব্যাপকতা, গিবত মানে কী তা আমরা মোটামুটি সবাই জানি। কারও অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে এমন কিছু বলা যা শুনে সে কষ্ট পায়, একেই গিবত বলে। অত্যন্ত মারাত্মক একটি কবিরা গুনাহ গিবত। কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয়, আজ আমরা গিবতকে ঘি-ভাতের মতো আপন করে নিয়েছি। বিশিষ্ট ও সাধারণ কেউই এ সর্বনাশা ব্যাধি থেকে মুক্ত নই। সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে এ ব্যাধি এমন মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এটাকে এখন আর পাপ বলে মনে হয় না। অথচ কোরআন-হাদিসে গিবত সম্পর্কে কঠোর হুঁশিয়ারি এসেছে। আল্লাহ পাক বলেন, ‘হে মানব! তোমাদের কেউ যেন অন্যের গিবতে লিপ্ত না হয়। তোমরা কি আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? অবশ্যই তোমরা তা পছন্দ করবে না।’ হাদিস শরিফে এসেছে, গিবতকারী ও শ্রবণকারী উভয়ে সমান অপরাধী। দুনিয়ায় গিবতের একটি বড় কুফল এই যে, গিবতকারী সবার আস্থা হারায়। কেউ তার ওপর আস্থা রাখতে পারে না। কেননা সবাই মনে করে, আজ যেমন সে আমার কাছে অন্যের দোষ আলোচনা করছে তেমন কাল যে অন্যের কাছে আমার দোষ আলোচনা করবে না তার কী নিশ্চয়তা আছে? দেখা যায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয়ও গিবত ও হিংসার ছড়াছড়ি। এক ওস্তাদ অন্য ওস্তাদের পেছনে, কিংবা ওস্তাদরা মুহতামিমের পেছনে লেগে আছে। অনেক সময় এমন ওস্তাদের কারণেই ছাত্ররা তাদের গিবত করছে। ছাত্রদের পড়াতে গিয়ে ওস্তাদরা সীমাতিক্রম করে শাস্তি দিচ্ছে, শরীর জখম করে রক্তাক্ত করছে। ওস্তাদদের উচিত ছাত্রদের বুঝিয়ে-সুজিয়ে, স্নেহ-মমতা দিয়ে লেখাপড়া করানো। বেত্রাঘাত করলে খারাপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, ফ্যাসাদ সৃষ্টি হয়। যে হাতে ছাত্রদের মারা হয় সে হাত কিয়ামতের আদালতে মামলা দায়ের করে বলবে, হে আল্লাহ! এ হাত দ্বারা তোমার বান্দা মানুষের ওপর আঘাত করেছে। চোখ বলবে, আমার দ্বারা কোরআন শরিফ না পড়ে সিনেমা দেখেছে। পা বলবে, আমার দ্বারা মসজিদে নামাজ পড়তে না গিয়ে রাতের আঁধারে অস্ত্র নিয়ে মানুষের মালসম্পদ ছিনিয়ে এনেছে। মোট কথা বান্দার হক, শরীরের হকসহ সব হকের বিচার কাল কিয়ামতের আদালতে করা হবে। আমাদের মনে রাখা উচিত যে, সবার অলক্ষ্যে যিনি সবকিছু প্রত্যক্ষ করছেন তার কাছে আমি গিবত করে ছোট হয়ে যাচ্ছি, আর যার গিবত করা হচ্ছে সেই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে সম্মানের পাত্র হয়ে যাচ্ছে। হাশরের বিচার শুনে রাখুন! আল্লাহ হলেন ন্যায়বিচারক, তিনি বান্দার প্রতি বিন্দুমাত্র ও অন্যায় অবিচার করবেন না। মানুষ অস্থায়ী জীবনে যা কিছুই করুক তা কিয়ামতের ময়দানে অস্বীকার করতে পারবে না। কারণ মানুষ যা কিছু করছে তা সব আমলনামায় কিরামান-কাতিবিন ফেরেশতারা লিপিবদ্ধ করছেন। সেদিন অপরাধের চিত্রগুলো সামনে সাক্ষীস্বরূপ হাজির হয়ে যাবে। সেদিন বান্দার দায়েরকৃত মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহতায়ালা বাদীকে বলবেন, হে বান্দা! তুমি এখন তার বদলা নিয়ে নাও। দুনিয়ায় টাকাপয়সার মাধ্যমে মামলা-মোকাদ্দমার নিষ্পত্তি করা যায়। কিন্তু আখেরাতের ময়দানে সেদিন কোনো টাকাপয়সা কাজে লাগবে না, একমাত্র নেক আমলই কাজে লাগবে।

 

লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ

সর্বশেষ খবর