শিরোনাম
শনিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

পদ্মশ্রী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা

ইমদাদুল হক মিলন

পদ্মশ্রী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা

মুশকিলটা হলো, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে নিয়ে বলতে গেলে নিজের কথাও অনেকখানি বলতে হয়। পাঠক ভাবতে পারেন, বন্যার মতো প্রায় কিংবদন্তি হয়ে ওঠা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীর সঙ্গে নিজের ঘনিষ্ঠতার কথা জড়িয়ে আমারও কিছুটা মহত্তর হওয়ার চেষ্টা। সবিনয়ে বলি, তেমন কোনো উদ্দেশ্যে এই লেখা লিখছি না। প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক আমীরুল ইসলাম ও আমার বন্ধু ফরিদুর রেজা সাগরের কল্যাণে বন্যার সঙ্গে আমারও ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব হয়েছে। আমীরুল বন্যাকে ‘বন্যাদি’ বলেন। তার দেখাদেখি বলে সাগর। তার দেখাদেখি আফজাল আরেফীন আমি, সবাই তাই বলি। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, আমাদের সবার ‘বন্যাদি’।

সাগর আমার জীবনে দুতিনটি নতুন বিষয় যুক্ত করে দিয়েছে। পঁচিশ বছর আগে বেইলি রোডে, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের উল্টোদিকের একটি পুরনো বাড়ির দোতলা বা তিনতলায় যাত্রা শুরু করেছিল আজকের বিখ্যাত টিভি চ্যানেল ‘চ্যানেল আই’। আমি তখন থাকি গেন্ডারিয়াতে। মেয়েরা ভিকারুননিসায় পড়ে। আমার পেশা গল্প উপন্যাস আর টিভি নাটক লেখা। গেন্ডারিয়া থেকে মেয়েদের নিয়ে আসি ভিকারুননিসায়। ওদের স্কুলে দিয়ে সাগরের চ্যানেল আইতে বসে আড্ডা দিই। লেখক জীবনের শুরু থেকেই সাগর ছিল আমার একটি বড় ভরসার জায়গা। তখন সে আর আমার আরেক প্রিয়বন্ধু শাইখ সিরাজ ‘খাবার দাবার’ রেস্টুরেন্টটি চালাত। স্টেডিয়ামের উল্টোদিকে সেই রেস্টুরেন্ট এখনো আছে। কিন্তু মান্না দে’র ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’র মতো ‘খাবার দাবারে’ আমাদের সেই আড্ডা আর আনন্দের দিনগুলো আর নেই। তবে একটা সময়ে প্রায় প্রতিদিনই ‘খাবার দাবারে’ আমাদের আড্ডা জমত। ’৭৩-এর শেষদিক বা ’৭৪ সাল থেকে আশির দশকের শেষদিক পর্যন্ত আমাদের প্রধান আড্ডার জায়গা ছিল ‘খাবার দাবার’। তখনো বন্যা আমাদের সঙ্গে যুক্ত হননি। আমরা একটা সংগঠন করতাম ‘চাঁদের হাট’। সেই সংগঠনের নেতৃস্থানীয় প্রায় সবারই একত্র হওয়ার জায়গা ছিল ‘খাবার দাবার’। সাগর আর শাইখ একজন বিটিভিতে যাচ্ছে প্রোগ্রাম করতে, আরেকজন ‘খাবার দাবার’ চালাচ্ছে। এরকম পালা করে চলছিল রেস্টুরেন্টটি। ‘পিঠাঘর’ ছিল ‘খাবার দাবারের’ আরেক নাম। পিঠাও বিক্রি করা হতো রেস্টুরেন্টটিতে। খিচুড়ি হাঁসের মাংস ছিল ব্যাপক জনপ্রিয়। রোজার সময় জনপ্রিয় ছিল মোটা মোটা জিলিপি। দিনে দিনে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ‘খাবার দাবার’। ‘চাঁদের হাটের’ বন্ধুদের মধ্যে আবদুর রহমান, সাইফুল আলম, আলীমুজ্জামান হারু, শাহানা বেগম, সেলিনা সিদ্দিকী শুশু, নাঈমা ইসলাম রলি, মুনা মালতি, হাসান হাফিজ, এমনকি রফিকুল হক দাদুভাইও কখনো কখনো আড্ডা দিতে আসতেন। পাভেল রহমান তখন ক্যামেরা হাতে দৌড়াচ্ছে। ’৭২-’৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর ছবি তুলে তখনই সে বিখ্যাত হয়ে গেছে। আফজাল-সুবর্ণা টেলিভিশনের জনপ্রিয় জুটি। তারা আসে আড্ডা দিতে। আমার বন্ধু লেখক ইফতেখারুল ইসলাম আসে। একটু পরে আসতে শুরু করেছিল হুমায়ুন ফরীদি। তারও পরে জুয়েল আইচ। লেখক কবি শিল্পীরা, সিনিয়র জুনিয়র অনেকেই ধীরে ধীরে আসতে শুরু করেছিলেন আমাদের আড্ডায়। ‘খাবার দাবারের’ ভিতরে বসার জায়গা নেই। প্রতিটি টেবিল ভরে গেছে। বসার জায়গা না পেয়ে আমরা দোকানের সামনের ফুটপাতে বসে আড্ডা দিচ্ছি। আহা, কী আনন্দের দিন!

আমার পকেটে তখন ১০টা টাকাও থাকে না। গেন্ডারিয়া থেকে হেঁটে হেঁটে ‘খাবার দাবার’-এ গিয়েছি আড্ডা দিতে। দুপুরে খাওয়ার সমস্যা নেই। সাগর নিজেও তখন স্ট্রাগল করছে। শাইখদের বাড়ির অবস্থা ভালো। তবে দুজনেই প্রাণখুলে আমাদের খাওয়াতো। ঘণ্টায় ঘণ্টায় চা শিঙ্গাড়া। দুপুরে খিচুড়ি হাঁসের মাংস। ‘খাবার দাবারের’ লাভের অংশ আমরাই খেয়ে শেষ করে ফেলতাম। ওখানে জড়ো হতেন শিল্প-সাহিত্যের মানুষেরাই। লেখালেখির ভালোমন্দ নিয়ে কথা হতো, অভিনয়ের ভালোমন্দ নিয়ে কথা হতো। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জায়গা থেকে নিজের কাজটা করে যাচ্ছে। সাগর টেলিভিশনের জন্য নানা রকমের লেখা লিখছে। শাইখ কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে গেছে তখনই। আফজাল-সুবর্ণা অভিনয় করছে। টেলিভিশনের দুজন সুন্দরী উপস্থাপিকাও আমাদের আড্ডায় যুক্ত হয়েছিল। তাঁদের নাম আমার এখন আর মনে নেই। কারও সঙ্গে কারও একটু প্রেম প্রেম ভাবও হয়েছে। একটু কান্নাকাটি, একটু মান অভিমান চোখের সামনেই দেখেছি। এ তো হতেই পারে।

এই ‘খাবার দাবার’, বিশেষ করে সাগর আমার লেখক জীবনের শুরুটায় অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিয়েছিল। শিল্প সাহিত্যের অনেক কিছু বন্ধুদের কাছ থেকে আমি শিখেছি। তারপর সাগর আর শাইখরা শুরু করল ‘চ্যানেল আই’। প্রথম রাতের নাটকটা লিখতে হলো আমাকে। সাগরের তো ক্রিয়েটিভিটির তুলনা নেই। সে হচ্ছে নতুন নতুন আইডিয়ার মাস্টার। আমাকে বলল, ‘শুধু নাটক লিখলেই হবে না, নাটকটি পরিচালনাও করতে হবে তোমাকে।’ আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। আমি ডিরেকশনের কী বুঝি? তবু বিভিন্নজনের সাহায্য নিয়ে তৈরি করলাম নাটক। তারপর ‘যুবরাজ’ নামের ১৩ পর্বের একটি সিরিজ নাটকের ডিরেকশন দিয়েছিলাম। কাজটিতে তেমন সুবিধা করতে পারিনি বলে সেখান থেকে এক সময় সরে এলাম। সাগর আমাকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে একদিন দুপুরের দিকে বলল, ‘শোনো, এখন একটা বইয়ের আলোচনার রেকর্ডিং আছে। মূল আলোচক দুজন আছেন। তুমিও বইটা নিয়ে একটু কথা বলো তো।’ শুনে আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল। আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, টিভি ক্যামেরা দেখলে গলা শুকিয়ে যায়। মুখটা যায় আমচুরের মতো হয়ে। সাগরকে বললাম, সাগর পাত্তাই দিল না। আরেক ওস্তাদ আমার অতিপ্রিয় আমীরুল ইসলাম যুক্ত হয়েছে ‘চ্যানেল আই’য়ের সঙ্গে। সে আমাকে নানা রকম বুঝ দিয়ে সেটে নিয়ে বসিয়ে দিল। টেলিভিশন পর্দায় আমি একটু একটু কথা বলতে শুরু করলাম। এই করে নানা রকম অনুষ্ঠানে আমাকে ঢুকিয়ে দিতে লাগল সাগর। আমার জড়তা কাটতে লাগল। তারপর কত অনুষ্ঠান চ্যানেল আইতে। বেইলি রোডে থাকা অবস্থাতেই চ্যানেল আইয়ের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘তৃতীয় মাত্রা’ শুরু হয়ে গিয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে একবার অতিথি হুমায়ুন আজাদ আর আমি। এক পর্যায়ে তুমুল ঝগড়া লেগে গেল দুজনার। অনুষ্ঠান শেষে যথারীতি আবার মিল হয়ে গেল। সাগর আমাকে নিয়মিত একটা অনুষ্ঠান করার কাজে লাগিয়ে দিল। অনুষ্ঠানের নাম ‘মিলন কথা’। বিখ্যাত মানুষদের সাক্ষাৎকার নিতে লাগলাম। যতদূর জানি ‘মিলন কথা’ই সম্ভবত বাংলাদেশের প্রথম ‘টক শো’ আমাকে দিয়ে সাগর শুরু করিয়েছিল। ‘মিলন কথা’র অনেকগুলো পর্ব করেছিলাম ‘চ্যানেল আই’তে। সেই ইতিহাস কেউ মনে রেখেছে কি না জানি না। তারপর ‘এনটিভি’তে করেছিলাম ‘কী কথা তাহার সাথে’। ওই অনুষ্ঠানের জন্য উপস্থাপক হিসেবে ‘বাচসাস’ পুরস্কারও পেয়েছিলাম। পুরস্কার আনতে যাওয়ার দিন আমার অতিপ্রিয় একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কী জন্য পুরস্কার পাচ্ছ?’

‘উপস্থাপক হিসেবে।’

‘তোমার তো আসলে ‘নৃত্যশিল্পী’ হিসেবে পুরস্কারটা পাওয়া উচিত ছিল।’

আমি হতবাক! ‘কেন?’

‘অনুষ্ঠান করার সময় তুমি যেভাবে হাত নাড়ো, তাতে তোমাকে উপস্থাপক মনে হয় না। মনে হয় ‘নৃত্যশিল্পী’। হা হা হা।’

আমার অনুমামা নিয়মিত অনুষ্ঠানটা দেখতেন। আমি তো একজোড়া স্যান্ডেল, জিন্সের প্যান্ট আর হাওয়াই শার্ট পরে, বা ফুলহাতা শার্টের হাতা গুটিয়ে অনুষ্ঠান করি। মামা ফোন করে ধমক দিলেন, ‘এই ব্যাটা, তোর কি জুতাটুতা নেই? না থাকলে বল, কিনে পাঠাই? স্যান্ডেল পরে অনুষ্ঠান করছিস, লজ্জা করে না?’

অনুমামা আমাকে সত্যি সত্যি দুই জোড়া দামি জুতা কিনে পাঠিয়ে দিলেন।

‘চ্যানেল আই’য়ের বেইলি রোডের ছোট স্টুডিওতেই প্রথম রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার একটি রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠানে সঞ্চালকের ভূমিকায় সাগর আমাকে বসিয়ে দিয়েছিল। বন্যাদি তাঁর অসামান্য কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের একটা গান করেন। তাঁর গানের ফাঁকে ফাঁকে আমি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কিছু কথা বলি। অনুষ্ঠান শেষে সাগর আমীরুলরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলো। আর বন্যাদিরও কিছুটা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলাম আমি।

বন্যাদির সঙ্গে এভাবেই শুরু হয়েছিল বন্ধুত্ব।

বেইলি রোডে থাকার সময় থেকেই বন্যাদি নিয়মিত অনুষ্ঠান করতে লাগলেন ‘চ্যানেল আই’তে। বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রতিটি অনুষ্ঠানই দুর্দান্ত। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে, বিজ্ঞাপন প্রচারের পর থেকেই দর্শকরা অপেক্ষা করতে থাকেন। কোনো কোনো অনুষ্ঠানে দর্শক শ্রোতার সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা রাখে সাগর। দেশ বিদেশ থেকে একটার পর একটা ফোন আসতে থাকে। বন্যাদি তাঁর ভুবন ভুলানো হাসিমুখে দর্শক শ্রোতার সঙ্গে কথা বলেন। বেশির ভাগ অনুষ্ঠানেরই উপস্থাপক আমি। বন্যাদি যখন কথা বলেন, আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। একই মানুষ এত গুণের অধিকারী হন কী করে? গানের ক্ষেত্রে তিনি তুলনাহীন, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে জানার পরিধি অপরিসীম, আর কথা বলেন এত চমৎকার ভঙ্গিতে, মানুষ তাঁর গান যেমন মুগ্ধ হয়ে শোনে, কথাও শোনে সমান মুগ্ধতায়। বহু আগে থেকেই আমি বন্যাদির ভক্ত। অনুষ্ঠান করতে গিয়ে দিনে দিনে তাঁর প্রতি মুগ্ধতা বেড়েই চলল। কিছুদিন পর বিটিভি থেকে জানানো হলো রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করবে তাঁরা। অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক হিসেবে বন্যাদি আমার নাম বলেছেন। সেই অনুষ্ঠান করে এলাম। বন্যাদির প্রশংসা দর্শক শ্রোতারা তো করবেনই, তাঁর সঙ্গে সঙ্গে সঞ্চালক হিসেবে আমিও অল্প বিস্তর প্রশংসা পেতে লাগলাম।

এ সময় বন্যাদি আমেরিকায় চলে গেলেন। নিউইয়র্কে সুধীজনরা তাঁর গানের একটি একক সন্ধ্যার আয়োজন করলেন। সাগর হঠাৎ আমাকে বলল, ‘ওই অনুষ্ঠানেরও তুমি উপস্থাপক। পুরো অনুষ্ঠানটাই আমরা রেকর্ড করব। চলো আমেরিকায় যাই। পাঁচ দিনের জন্য যেতে হবে। লুৎফর রহমান রিটন থাকে কানাডাতে। সে-ও আসবে।’ যাওয়ার দিন সন্ধ্যাবেলা আমি ব্যাগ সুটকেস নিয়ে ‘চ্যানেল আই’তে এসেছি। সাগর দেখি নড়েই না। ফ্লাইটের সময় হয়ে যাচ্ছে। এক সময় সে উঠল। বলল, ‘চলো।’ আমি অবাক! তোমার ব্যাগ সুটকেস? সাগর হাসল, ‘ছোট একটা ব্যাগে সব নিয়েছি, চলো।’ সাগরের অবস্থা দেখে আমার মনে হলো সে আমেরিকায় যাচ্ছে না, যাচ্ছে নরসিংদী বা মুন্সীগঞ্জে। এরকম প্রস্তুতিহীনভাবে একজন মানুষ আমেরিকায় রওনা দিতে পারে, এ আমি কল্পনাও করতে পারি না। নিউইয়র্কে গিয়ে পৌঁছালাম। রিটনও চলে এসেছে। বন্যাদি নিউইয়র্কেই ছিলেন। আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলো নিউইয়র্কে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করা আমার অতিপ্রিয় বন্ধু সৌরভ। যে পাঁচ দিন নিউইয়র্কে থাকলাম, সৌরভ তার গাড়ি নিয়ে সারাক্ষণই আমাদের সঙ্গে। সেই ফাঁকেই যে কত কত জায়গায় বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল! তারও বেশ অনেকগুলো বছর পর নিউইয়র্ক থেকে ডালাসে শিফট্ করার কথা ভাবছিল সৌরভ। স্ত্রী আর একমাত্র পুত্রকে নিয়ে ড্রাইভ করছিল ডালাসের ওদিকটায়। ভয়াবহ দুর্ঘটনায় সৌরভ আর তার স্ত্রী স্পটেই মারা গেল। বছর দেড়েক কোমায় থাকল ছেলেটি। তারপর ধীরে ধীরে জীবনের পথে ফিরে এলো। এখন ছেলে পুরোপুরি সুস্থ।

রবীন্দ্র সন্ধ্যাটি অসামান্য কণ্ঠ মাধুর্যে মাতিয়ে দিলেন বন্যাদি। বাছাই করা কিছু শ্রোতা। ছোট সুন্দর একটি হলে আয়োজন। সেই সন্ধ্যাটি আমার জীবনের মধুরতম সন্ধ্যার একটি। নিউইয়র্কে সেবার অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনার কথা বিখ্যাত ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন চমৎকার করে লিখেছিল। যদি সে না লিখত তাহলে ঘটনাটি আমি কখনো লিখতাম না। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য। এক বিকালে ‘কুইন্স মলে’ ঢুকতে যাচ্ছি আমরা। সাগর, বন্যাদি, রিটন, সৌরভ আর আমি। এ সময় রাস্তা পেরিয়ে বেশ আকর্ষণীয়া একটি মেয়ে এগিয়ে এলো আমাদের দিকে। তার হাতে একটা শপিংব্যাগ। বুঝলাম বাঙালি মেয়ে। নিশ্চয় বন্যাদির ভক্ত, তাঁকে দেখেই এগিয়ে আসছে। আমরা দাঁড়িয়েছি। কিন্তু মেয়েটি এসে দাঁড়াল আমার মুখোমুখি। হাসিমুখে বলল, ‘আপনাকে এখানে দেখব ভাবতেই পারিনি। আমি আপনার ফ্যান। আপনার লেখা খুব পছন্দ করি।’ তার পরের ঘটনাটি প্রায় অলৌকিক। ঘটনাটি ঘটাল সাগর। সে হঠাৎ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার ব্যাগটাতে মিলনের একটা বই আছে।’ আমাদের মতো মেয়েটিও বিস্মিত। ‘আপনি কী করে জানলেন?’ সাগর গম্ভীর গলায় বলল, ‘আছে কী না বলুন?’ সত্যি সত্যি মেয়েটি আমার ‘পর’ উপন্যাসটি বের করল। এ ধরনের ঘটনা বোধহয় জীবনে একবারের বেশি ঘটে না।

আমার ছোটভাই খোকন সেই সময় আমেরিকায়। অ্যারিজোনায় থাকত। ওর শরীরটা খারাপ ছিল। ওই নিয়ে আমার উদ্বিগ্নতা রিটন খুব লক্ষ্য করেছিল। বড় বোনটি থাকে লংআইল্যান্ডে। তার সঙ্গে সেবার দেখাই হলো না। মাত্র পাঁচ দিনের আমেরিকা সফর আর কখনো করিনি আমি।

‘চ্যানেল আই’য়ের বিশাল ভবন হলো তেজগাঁওয়ে। সেখানে এসেও একের পর এক অনুষ্ঠান বন্যাদির সঙ্গে করলাম। ‘চ্যানেল আই’য়ের ‘ছাতিমতলা’য় ভোরবেলা বন্যাদির গানের আয়োজন করল সাগর আর আমীরুল। বাছাই করা কিছু শ্রোতা। ইফতেখার আর তার স্ত্রী রানি, মুকতাদির আর তার স্ত্রী কচি, শাইখ, মামুন, বাবু, পারভেজ অর্থাৎ ‘চ্যানেল আই’য়ের সব পরিচালকই থাকবেন। বন্যাদির গানের সঙ্গে সঙ্গে সূর্য উঠছে। ভোরবেলাকার পবিত্র আলোয় ভরে যাচ্ছে ‘চ্যানেল আই’য়ের আঙিনা। ছাতিমের পাতায় পাতায় অবুঝ শিশুর মতো খেলা করছে হাওয়া। ‘তৃতীয় মাত্রা’র কোনো কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানেরও উপস্থাপক সাগর নিজে। অতিথি হয়তো বন্যাদি, আফজাল আর আমি। বলতে গেলে চার বন্ধুর অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান শেষ হতো বন্যাদির গাওয়া কয়েক লাইন রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে। বন্যাদি ‘সুরের ধারা’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর গুরু কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করে দিয়েছেন। আমার দুই মেয়ে কিছুদিন বন্যাদির ছাত্রী ছিল। ধীরে ধীরে ‘সুরের ধারা’ বড় হয়ে উঠতে লাগল। ‘চ্যানেল আই’ যুক্ত হলো ‘সুরের ধারা’র সঙ্গে। গত কয়েক বছর ধরে চৈত্র সংক্রান্তির বিকেল থেকে পহেলা বৈশাখের সারাটা দিন ‘সুরের ধারা’ ও ‘চ্যানেল আই’ যৌথভাবে আয়োজন করে বাংলা ‘বর্ষবিদায়’ ও ‘নববর্ষ’ উদ্যাপন অনুষ্ঠান। সারা দেশ থেকে এক হাজার শিল্পী অংশগ্রহণ করেন এই অনুষ্ঠানে। আমাদের শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই আয়োজন নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। সাগর আর বন্যাদির কৃতিত্ব তো এক্ষেত্রে আছেই, আর আছে আমীরুলের প্রাণপাত করা পরিশ্রম। এক সকালে বন্যাদির গানের অনুষ্ঠান হচ্ছে ‘চানেল আই’তে। সেই অনুষ্ঠানে সরাসরি ফোন করলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সঙ্গে আছেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠকন্যা শেখ রেহানা। তাঁরা দুজনেই বন্যাদির গান পছন্দ করেন, ভালোবাসেন। একজন শিল্পীর জন্য এ এক বিশাল গৌরবের ঘটনা যে, দেশের প্রধানমন্ত্রী সরাসরি তাঁর গানের অনুষ্ঠানে ফোন করেছেন! প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন তাঁর প্রিয় শিল্পীকে।

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা অর্থনীতি পড়েছেন। ‘ছায়ানট’ ও ‘বুলবুল একাডেমি’তে গান শিখেছেন। তারপর চলে গিয়েছিলেন শান্তি নিকেতনের ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে’। সংগীত ভুবনের তিন মহিরুহের সান্নিধ্যে ছিলেন। শান্তিদেব ঘোষ, কণিকা বন্দ্যোপাধায় ও নীলিমা সেন। পরে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে সংগীতে পিএইচডি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই যোগদান করেন। নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও নৃত্যকলা বিভাগের চেয়ারপারসন হিসেবে কর্মরত। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। বহু বহু পুরস্কারে সম্মানিত এই মহান শিল্পী। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ পেয়েছেন ২০১৬ সালে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘বঙ্গভূষণ পদক’। সম্প্রতি পেয়েছেন ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী পদক’। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কয়েকটি বই লিখেছেন। ছোটদের জন্য লিখেছেন ‘নির্বাচিত রবীন্দ্রসংগীতের স্বরলিপি’। বন্যাদির কথা ভাবলে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। এক জীবনে কত কত কাজ করতে পারেন একজন মানুষ, তিনি হচ্ছেন তাঁর প্রমাণ। বন্ধুরা আমার ‘পঞ্চাশতম জন্মদিন’-এর আয়োজন করেছিল শেরাটনের বলরুমে। অতিথি ছিলেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, আলী ইমাম প্রমুখ। বিশেষ আয়োজন ছিল বন্যাদির গান। রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলো গান সেই সন্ধ্যায় গেয়েছিলেন বন্যাদি। এ আমার এক পরম সৌভাগ্য যে, আমার মতো একজন সামান্য লেখকের জন্মদিনে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা গান করেছিলেন। আমার ‘নায়কের নাম কবি’ বইটি আমি তাঁকে উৎসর্গ করেছি। উৎসর্গপত্রে লিখেছি, ‘রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে আমাদের সময় আলোকিত করেছেন’। আমার প্রতিটি সকাল শুরু হয় বন্যাদির গান দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ এসে ভর করেন তাঁর কণ্ঠে আর আমার প্রতিটি সকাল নতুন থেকে নতুনতর হয়ে ওঠে। বন্যাদি, আমার প্রতিটি সকাল মোহময় করে তোলার জন্য আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

সর্বশেষ খবর