শনিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

বইমেলা : প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

তপন কুমার ঘোষ

বইমেলা : প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং সোহরাওয়ার্দী        উদ্যানের বিস্তীর্ণ প্রান্তরজুড়ে বসেছে অমর একুশে বইমেলা। ছুটির দিনে মেলা সরগরম হয়ে ওঠে।  কেবল বইপাগল মানুষেরা মেলায় ভিড় করছেন, ব্যাপারটা সেরকম নয়। সবাই ক্রেতা নন। অনেকে আসেন ঘুরে বেড়াতে। আছে সেলফি তোলার হিড়িক। খাবারের স্টলগুলোর সামনে নাকি দীর্ঘ লাইন। ছুটির দিন বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত শিশুপ্রহর। বাবা-মায়ের হাত ধরে শিশুরা আসে মেলায়। শিশুপ্রহরে সিসিমপুর জমে ওঠে কচিকাঁচাদের কলকাকলিতে।

বইমেলায় এবার ছয় শতাধিক প্রতিষ্ঠান বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেছে। কিন্তু প্রকাশক ও বিক্রেতারা বলছেন, শুক্র ও শনিবার ছাড়া তেমন বেচাবিক্রি হয় না। অধুনা ছাপা বই পড়ার আগ্রহে ভাটা পড়েছে, এটা সত্য। এর প্রধান কারণ সমাজমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক, ইউটিউবে আসক্তি। দ্বিতীয় কারণ মানহীন বই। তৃতীয় কারণ বইয়ের উচ্চমূল্য। ইদানীং লেখকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। প্রতি বছর বইমেলাকে কেন্দ্র করে তিন সহস্রাধিক নতুন বই প্রকাশিত হয়। এটা স্বীকার করতেই হবে, আমাদের দেশে অনেক ভালো লেখক ও পাঠক আছেন। নতুন লেখকদের মধ্যেও অনেকে ভালো লিখছেন। নতুনদের অনেকেই প্রকাশকের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজ খরচে বই ছাপানোর ব্যবস্থা করেন।  বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অগ্রিম অর্থ পরিশোধ করতে হয়। প্রকাশকের কাছ থেকে নিজের লেখা বই নগদে কিনে নেন লেখক।  কী বেদনাদায়ক! বিপণনের দায়িত্ব লেখকের। এসব বইয়ের প্রচ্ছদ ঝকমকে। সুন্দর ছাপা। কিন্তু লেখার মান প্রশ্নবিদ্ধ। মূল কারণ সম্পাদনার অনুপস্থিতি। পা-ুলিপি দেখার কেউ নেই। তবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনা সংস্থা সম্পাদনার কাজটি পেশাদারদের দিয়ে করিয়ে থাকে বলে জানা যায়।  এখন বই প্রকাশ করা অনেক সহজ হয়ে যাওয়ায় অনেকেই লেখক হতে চান। আশির দশকের প্রথম ভাগের ঘটনা। ‘খোলা কবিতা’ শিরোনামে একটা কবিতা লিখে কবি মোহাম্মদ রফিক তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকারের বিষনজরে পড়েছিলেন। তখন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কবিতা অনেক গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হতো। এসব কবিতার রচয়িতা কে, তা নিয়ে গুঞ্জন ছিল। খোলা কবিতার দুটি লাইন নিয়ে খুব তোলপাড় হয়েছিল- ‘সব শালা কবি হবে; পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে, উড়বেই; বন থেকে দাঁতাল শুয়োর রাজাসনে বসবেই।’ কবি মোহাম্মদ রফিক প্রয়াত। বেঁচে থাকলে এখন কী লিখতেন, জানি না। তিন-চার দশক আগেও বিয়েতে বই উপহার দেওয়ার চল ছিল। লঞ্চঘাটে-রেলস্টেশনের বুক স্টলে গল্পের বই ও সাময়িকী বিক্রি হতো। দূরপাল্লার বাস-ট্রেন-লঞ্চে বইয়ে ডুবে থাকতেন অনেক যাত্রী। বই পড়া ছিল অনেকের নেশা ও বিনোদন। কিন্তু এখন মনোযোগ দিয়ে বই পড়ার সময় নেই। বই যদি কেনাও হয় পুরোটা পড়া হয়ে ওঠে না। নিজেকে দিয়েই বুঝতে পারি। এখন ইন্টারনেটের নেশা পেয়ে বসেছে আমাদের। অনলাইনে পাঠের অভ্যাস ক্রমে ক্রমে বাড়ছে। ‘ই-বুক’ এর প্রচলন হয়েছে। চালু হয়েছে ‘অডিও বুক’। অন্য একজন পাঠ করে শোনাবে। কোনো বিষয় সম্পর্কে জানতে আগে আমরা বইয়ের পাতা উল্টাতাম। এখন ইন্টারনেটে সার্চ দিই। এতে সময় বাঁচে। খরচেরও সাশ্রয় হয়। অনেকটা নিখরচায় বিশাল তথ্যভান্ডার উন্মুক্ত হয়ে যায়। তাই পাঠাগারগুলোতে পাঠকের দেখা নেই। বাড়িতে দৈনিক পত্রিকা রাখা বন্ধ করে দিয়েছেন অনেকে। ইন্টারনেটে পড়েন। ছাপা বইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকে উদ্বিগ্ন। এ উদ্বেগ অমূলক নয়। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের মুখের ভাষা। বাংলায় পঠনপাঠনের গুরুত্ব নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের দাপটে বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলোর বেহাল দশা। মূলত নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলোতে পড়ে। বিত্তবানদের সন্তানেরা যায় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। বিশ্বায়নের যুগে বাংলার পাশাপাশি আমাদের ইংরেজি শিখতে হবে। বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ভালো করে ইংরেজি শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। একটি বিষয় স্পষ্ট করা দরকার। ইংরেজি ভাষা এবং ইংরেজি সাহিত্য- এ দুটির মধ্যে ইংরেজি ভাষা জানা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্য আপাতত দূরে থাক। সোজা কথায়, ইংরেজি বলা ও লেখার ওপর জোর দিতে হবে। নইলে বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব আমরা। প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ব। আমরা ইংরেজি শিখব। তবে শর্ত একটাই। মাতৃভাষার প্রতি কোনো অবহেলা বা অশ্রদ্ধা নয়। অনেকে বড়াই করে বলেন, আমার নাতি-নাতনিরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। ভালো করে বাংলা বলতে পারে না। তবে ইংরেজিতে খুব চোস্ত। ঠিক সাহেবদের মতো! এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি প্রয়াত কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের লেখা বহুল আলোচিত সেই কবিতাটি মনে পড়ে যায়। কবিতার শিরোনাম ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’। ‘জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না।’ ইংরেজি শেখার নামে বাংলা ভাষাকে অশ্রদ্ধা করার মানসিকতাসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা সমাজে নেহাত কম নয়। ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম’ গোছের সেøাগান তাদের প্রভাবিত করে না।  তাদের সাফ কথা, আবেগসর্বস্ব সেøাগান দিয়ে আখেরে কোনো লাভ হবে না। আরেকটি বিষয়।  বছর আসে, বছর যায়; কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের বিষয়টি কথার কথা হয়ে থেকে যায়। এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি, এমন কথা কেউ ভুলেও উচ্চারণ করেন না। অর্জন অনেক। কিন্তু উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ও উচ্চ আদালতে বাংলার প্রচলন এখনো দূরঅস্ত। এখন সময় আত্মসমীক্ষার।

লেখক : সাবেক পরিচালক পরিচালনা পর্ষদ, বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন

সর্বশেষ খবর