মঙ্গলবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

এ কে খন্দকারের ১৯৭১ : ভেতরে বাইরে

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

এ কে খন্দকারের ১৯৭১ : ভেতরে বাইরে

এই তো শবেবরাতের মহিমান্বিত একটি রাত আমরা অতিক্রম করলাম। মুসলিম বিশ্বের সব নর-নারী মনে করেন হাজার রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ শবেবরাতের মহান রাত। আল্লাহ আমাদের মঙ্গলময় জীবন দান করুন। মহান রাতে পরম প্রভুর কাছে এই কামনাই করেছি।

আমার স্ত্রীর সঙ্গে কখনো খুব একটা উচ্চবাচ্য হয় না। বিয়ের পরে পরে স্ত্রীকে নিয়ে খুব কষ্টে ছিলাম। তখনো যেমন তার কোনো দোষ ছিল না, এখনো নেই। ফাঁক ছিল ভাবনার, অনুভূতির। এখন তো তেমন কোনো কিছুরই দূরত্ব নেই। মাঝে মাঝেই আমার স্ত্রী দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আর পারি না। বাজারে লোক পাঠিয়ে মাথা ঠিক রাখা যায় না। বাজারের যে অবস্থা দেশের যে কী হবে কেউ কিছু বলতে পারে না। আগে ব্যবসায়ীদের লোক ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তার জমানার ব্যবসা-বাণিজ্যের বিশৃঙ্খল অবস্থা আমার ভাগনে টিটু সামাল দিতে পারবে কি না বুঝি না। টিটুকে কোন বিবেচনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রিয় বোন মন্ত্রী বানিয়েছেন তা তিনিই জানেন। টিটুর মা মনাকে সেই ছোট্টকাল থেকে চিনি। কারণ ’৬৯-এর গণআন্দোলনের সময় সংগ্রামী ছাত্ররা নাগরপুরের সিও-কে মেরে ফেলেছিল। তখনকার সিও মানে এখনকার ইউএনও। তাই নাগরপুরের সব পুরুষ ছিল গ্রামছাড়া, এলাকাছাড়া। সেই সময় তাদের পাশে দাঁড়াতে নাগরপুর গিয়েছিলাম। টিটুদের নানার বাড়ি গয়হাটা। সেখানে মনাদের বাড়ি ছিলাম ৪-৫ দিন। অন্যদিকে বিক্রমপুরে টিটুর বাবা মকবুল সেও আমার একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ছিল। যখন যা প্রয়োজন হয়েছে সব কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। টিটু বাণিজ্যমন্ত্রী হয়েছে খুবই খুশি হয়েছি। জট ছাড়াতে পারবে কি না জানি না। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক অবস্থার চেয়ে সামাজিক অবস্থা খুবই অশান্ত। খেটে খাওয়া মানুষ কেউ ভালো নেই। সন্তান-সন্ততির লেখাপড়া, মানুষ করা কোনো কিছুতেই মন দিতে পারছে না। বাজার নিয়ন্ত্রণে না এলে, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সংগতি না হলে কখন কী হয় হলফ করে বলা যায় না। প্রিয় ভাগনে টিটু সফল হোক এটাই কায়মনে পরম স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করি।

মনে হয় বছর পেরিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের একটি ভাষান্তর পড়েছিলাম। অসাধারণ লেগেছিল ‘পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু’। মূল লেখার চেয়ে ভাষান্তর আমার কাছে ভালো লেগেছিল। ১১২ পৃষ্ঠার বই। হাত থেকে রাখতে পারিনি। শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তি ছিল না। তাই একেবারে শেষ করে ছেড়েছিলাম। বহুদিন পর অমন একটি হৃদয়গ্রাহী লেখা পড়ে খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম। তাই লেখাটি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। লেখাটি পড়ে বহু মানুষ সাধুবাদ জানিয়ে ছিলেন। কিন্তু কয়েক বছর আগে একসময় বিমান বাহিনীর প্রধান এ কে খন্দকারের ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ বইটি পড়ে ততোধিক বিরক্ত ও বিস্মিত হয়েছি। একটা মানুষ নিজেকে কত বড় ভাবতে বা মনে করতে পারেন এ কে খন্দকারের ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ না পড়লে কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব না। অনেকেই নিজেকে বড় ভাবে। কিন্তু খন্দকারের মতো এত বড় কেউ কাউকে ভাবে কি না জানি না। তাই ভাবলাম খন্দকারের এই বইটির পরতে পরতে পাতায় পাতায় আলোচনা করি। কারণ ভদ্রলোক নিজেকে ছাড়া কাউকে কিছুই মনে করেননি। কোনো রাজনৈতিক নেতাকে মানুষের পর্যায়ে বিবেচনায় আনেননি। সবকিছুতে পরিকল্পনার অভাব এবং শুধু ভুল আর ভুল। অবাক হয়েছি ভদ্রলোক অসহযোগ আন্দোলন নিয়ে এমন গর্হিত কথা বলেছেন, যা ফৌজদারি অপরাধযোগ্য। এই দুনিয়ায় বলতে গেলে ভারত উপমহাদেশে দুটি অসহযোগ আন্দোলন হয়েছে। একটি মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ, অন্যটি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ পুরোপুরি সফল না হলেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমাদের অসহযোগ পৃথিবীর ইতিহাসে সব থেকে সফল অসহযোগ। আর সেই অসহযোগ নিয়ে তিনি বলেছেন, লুটতরাজ হয়েছে। পুরনো এয়ারপোর্টের পাশে তার বাড়ি থেকে তিনি রাস্তায় লুটপাট হতে দেখেছেন। অন্যত্র তো হয়েছেই। এমন ডাহা মিথ্যা কোনো দিন শুনিনি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ভুল ধরেছেন, তাঁর গ্রেফতার হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, সব যন্ত্রপাতি ছাড়া তাঁর লোকজন অটার প্লেন চালিয়েছে, হেলিকপ্টার চালিয়েছে। এমনকি বুড়িগঙ্গায় ৩৩ হাজার ভোল্ট বিদ্যুৎ লাইনের নিচ দিয়ে পানির ওপর দিয়ে হেলিকপ্টার চালিয়েছে। এমন হাজারো অসংগতি। তার লেখা না পড়লে পাঠক বুঝতে পারবেন না। তাই তার লেখা দিয়েই শুরু করি। ভূমিকাও বাদ দিলাম না। মনে হয় প্রিয় পাঠকদের ভালোই লাগবে।

‘ভূমিকা’ : ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে স্পষ্ট হতে থাকে যে আমরা স্বাধীন হতে যাচ্ছি। আমরা পাকিস্তানি শাসনের নাগপাশে থাকতে আর রাজি নই। আমরা আমাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়েছি, স্বাধীনতার কমে আমরা আর সন্তুষ্ট নই। পাকিস্তানিরা অত্যাচার ও পীড়নের মাধ্যমে যতই আমাদের দমনের চেষ্টা করতে থাকে, আমরা ততই আন্দোলনমুখী হতে থাকি। আমি উপলব্ধি করি, সহসাই ইতিহাস সৃষ্টি হতে যাচ্ছে আর আমিও এই ইতিহাসের অংশ হতে যাচ্ছি।

আমি রাজনীতিবিদ ছিলাম না, বরং কুড়ি বছর পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে নিষ্ঠার সঙ্গে চাকরি করেছি। তারপরও দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে আমি সিদ্ধান্ত নিতে একটুও ভুল করিনি। যথাসময়ে আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিই এবং যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে আসি। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া কর্মরত সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে আমিই ছিলাম সর্বজ্যেষ্ঠ। তাই মুক্তিযুদ্ধে আমাকে অনেক গুরুদায়িত্ব পালন করতে হয়েছে, পাশাপাশি অনেক নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তও আমাকে নিতে হয়েছে। আমি মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছি। এসব কারণে মুক্তিযুদ্ধের অনেক ইতিহাসই আমার জানা আছে, যা অনেকেই জানেন না বা তাঁদের জানার সুযোগ ছিল না।

মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার পর থেকেই আমি প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার নোট রাখতে শুরু করি, যাতে পরবর্তী সময়ে একটি পূর্ণাঙ্গ স্মৃতিকথা লিখতে পারি। লেখার উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এই নোটগুলো আমি সযত্নে আগলে রাখি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ১৯৭৫ সালের পর রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে আমাকে দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকতে হয়। দেশ ত্যাগের আগে সব মূল্যবান কাগজপত্রের সঙ্গে আমার মুক্তিযুদ্ধকালে লেখা আমার নোটগুলো এক আত্মীয়ের বাসায় রেখে যাই। প্রায় ১২ বছর পর দেশে ফিরে আমি সেই নোটগুলো আর ফেরত পাইনি। সঠিক সংরক্ষণের অভাব ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আমার মূল্যবান কাগজপত্রের সঙ্গে সঙ্গে নোটগুলোও নষ্ট হয়ে যায়। মাঝে মধ্যে স্মৃতির ওপর নির্ভর করে আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়ের স্মৃতিকথা লেখার চিন্তা করলেও তা আর হয়ে ওঠেনি। সম্প্রতি আমি বুঝতে পারছিলাম যে, স্মৃতিকথা লেখার জন্য আমার হাতে আর খুব বেশি সময় নেই। এ ছাড়া স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই আমি অনেক কিছু বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছি। এ উপলব্ধি থেকে গত বছর আমি আমার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা লেখার উদ্যোগ নিই। আমার বয়স, একাগ্রতা, ধৈর্য ইত্যাদি সবই মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটি মাত্র গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আমার স্মৃতি থেকে লিখে ফেলতে সক্ষম হই। এজন্য আমি অবশ্যই ধন্যবাদ জানাই তরুণ গবেষক গাজী মিজানুর রহমানকে। তাঁর সাহায্য না পেলে এ বয়সে এসে এই বই শেষ করা খুবই দুরূহ হয়ে পড়ত। আমি স্মৃতিকথার জন্য যে বিষয়গুলো বেছে নিয়েছি, তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ অথচ তথ্যের অভাবে কম প্রচারিত বা আলোচিত, অথবা ভুলভাবে প্রচারিত। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে এ ধরনের বেশকিছু বিশ্বাস আমাদের মধ্যে প্রচলিত আছে, যা প্রকৃত ঘটনার সঠিক চিত্র নয়। এ ধরনের বিশ্বাস সাধারণত জন্ম নেয় তথ্যের অপর্যাপ্ততা বা অভাব থেকে, আবার অনেক সময় কোনো ব্যক্তি বা সমষ্টি ইচ্ছা করেই তাঁদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এ ধরনের ভুল তথ্য প্রচার করে থাকেন। আমি মূলত আমার স্মৃতিকথা ১৯৭১ সালের মধ্যে সীমিত রেখেছি। শুধু বীরত্বসূচক খেতাবের বিষয়টি ১৯৭১-এ শুরু হলেও শেষ হয়েছিল ১৯৭৩ সালে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৪২ বছর পর আমি বইটি লিখছি। তাই বইটিতে তথ্য উপস্থাপনার ক্ষেত্রে আমাকে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়েছে। আমার তথ্যগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য আমাকে বেশকিছু বই পড়তে হয়েছে, এর মধ্যে নিচের বইগুলো উল্লেখযোগ্য : ১. বাংলাদেশ সরকার প্রকাশিত স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ২. বাংলাদেশ সরকার প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস ৩. জে এফ আর জেকবের সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা : বার্থ অব এ নেশন ৪. মঈদুল হাসানের মূলধারা ৭১ ৫. মঈদুল হাসান, এস আর মীর্জা ও আমার কথোপকথনের ভিত্তিতে রচিত মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর : কথোপকথন ও ৬. আহমেদ রেজার লেখা একাত্তরের স্মৃতিচারণ ৭. এ কাইউম খানের বিটার সুইট ভিক্টরি ৮. পিভিএস জাগান মোহন ও সমির চোপড়ার ইগল ওভার বাংলাদেশ ৯. এস এস উবানের ফ্যান্টমস অব চিটাগাং, কমান্ডো মো. খলিলুর রহমানের মুক্তিযুদ্ধে নৌ কমান্ডো অভিযান ইত্যাদি। আমার বক্তব্যের পক্ষে আমি বিভিন্ন বই থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিয়েছি। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ ও আমার বইয়ে উল্লিখিত তথ্য ও মতামতকে বোঝার সুবিধার্থে বেশকিছু দলিলও যুক্ত করেছি। বইটি তথ্যনির্ভর, বস্তুনিষ্ঠ ও সমৃদ্ধ করতে অনেকেই আমাকে বিভিন্ন তথ্য, উপাত্ত ও দলিল এবং মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছেন; বিশেষ করে মঈদুল হাসান, মুহাম্মদ লুৎফর হক, রাশেদুর রহমান, হাফিজুর রহমানের নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁদের সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আমার স্মৃতিকথা প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়ায় আমি প্রথমা প্রকাশনকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

সত্য কথা লিখতে হলে নির্মোহ হতে হয় এবং আবেগের ঊর্ধ্বে উঠতে হয়। আবেগতাড়িত হলে বা কারও প্রতি আনুকূল্য দেখাতে গেলে অতি অবশ্যই আমাকে হয় সত্য এড়িয়ে যেতে হবে, নতুবা মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে। আমি এর কোনোটাতেই বিশ্বাসী নই। তাই কখনো কখনো রূঢ় সত্য প্রকাশে ব্যক্তিবিশেষ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার বাইরে আমি কিছু মন্তব্য করেছি বা প্রমাণ তুলে ধরেছি। আমি মনে করি, সত্যের স্বার্থে এটির প্রয়োজন ছিল। তবে আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উল্লেখ করতে চাই, আমি যা কিছুই এই বইয়ে উপস্থিত করেছি, তা কাউকে খাটো করা বা কারও ওপর মিথ্যা অপবাদ দেওয়া বা কারও ছিদ্র অনুসন্ধান করার জন্য নয়, নেহাতই সত্য প্রকাশের জন্য এটি করেছি।  আমি এই বই লেখার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়েছি মূলত তরুণ প্রজন্মের ইতিহাস জানার আগ্রহ থেকে। তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে চায়, অথচ সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাবে তারা বিভ্রান্তিতে পড়ে যাচ্ছে। সত্য ও মিথ্যাকে তারা আলাদা করতে পারছে না। আমার এই বই তাদের জন্য। তারা সত্যটি জেনে উপকৃত হলে আমি সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হব। এ ছাড়া আমার বিশ্বাস, আমার বইয়ে দেওয়া তথ্য হয়তো আগামী দিনের ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের সামান্য হলেও সাহায্য করবে। তবে আমি মনে করিয়ে দিতে চাই, আমার কথাগুলোই শেষ কথা নয়। আগামী দিনের ইতিহাসবিদ ও গবেষকেরা আরও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পূর্ণাঙ্গতা দেবেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি রাজনীতিবিদ ছিলাম না। বরং কুড়ি বছর পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে নিষ্ঠার সঙ্গে চাকরি করেছি। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে আমি ছিলাম সর্বজ্যেষ্ঠ।’ হতে পারে তিনি সর্বজ্যেষ্ঠ। যুদ্ধে কে বড় কে ছোট এর চেয়ে অনেক বেশি বিবেচনার বিষয় কে কতটা ভূমিকা রেখেছেন। তিনি বলেছেন, প্রতিদিনই নোট লিখে রাখতেন। বন্ধুরাষ্ট্রে নিরাপদ অবস্থানে থেকে নিশ্চয়ই নোট লেখা যায়। তিনি তা বেশ আনন্দের সঙ্গেই করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই বই যখন লেখেন তখন তার হাতে সেসব কিছুই ছিল না। জরুরি কাগজপত্রের সঙ্গে এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের কাছে তিনি সব রেখে গিয়েছিলেন। ১২ বছর পর ফিরে এলে সেসব কোনো কিছুই সেই নিকট আত্মীয়ের কাছ থেকে পাননি। অথচ তার এসব জিনিস রাখায় কোনো ঝুঁকি ছিল না। রাষ্ট্রীয়ভাবে কখনো তিনি চরম শত্রুতার শিকার হননি। যেমনটা আমরা হয়েছি। শুধু আমি নই, পুরো পরিবার। আমার মা-বাবা, ভাই-বোন সে যে কী নিদারুণ কষ্ট ভোগ করেছে যা বলার মতো নয়। আমার আত্মীয়স্বজন যাকে যেখানে পেয়েছে আমি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি এই অজুহাতে তাদের জেলে নিয়েছে, কতজনকে কতভাবে হয়রানি করেছে তা লেখাজোখা নেই। প্রায় এক যুগ পর আমার ছোট ভাইয়েরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মাইক্রোবাসে করে চা-নাশতা এটা ওটা বিক্রি করে দিন চালাত তখনো তাদের নানাভাবে বাধা দেওয়া হয়েছে। ছোট আজাদ, মুরাদ যখন একটু বড় হয় দেশে ফিরে তারা যে কাজে হাত দিয়েছে সেই কাজেই সরকারি বাধা এসেছে। নানাভাবে তাদের নাজেহাল করা হয়েছে। এত কিছুর মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুসংবাদ শুনে আমি যখন বাড়ি ছেড়েছিলাম বাবর রোডের পাশের বাড়ি জেলা জজ হাজী আবদুল হালিম সাহেবের বাড়িতে বেশকিছু জিনিসপত্র রাখা হয়েছিল। সঙ্গে ৮-১০ ভরি সোনা, রুপাও ছিল। আমি ধানমন্ডির ১৯ নম্বর সড়কে আর এ গণির বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশের পথে পাড়ি জমিয়ে ছিলাম। যাওয়ার পথে অসংখ্য ছবি, কাগজপত্র এবং ১২-১৩ ভরি সোনার অলংকার সেখানে রেখে গিয়েছিলাম। অন্যদিকে আমার ভাবি লায়লা সিদ্দিকী তার বিয়ের সময় পাওয়া সব গয়না প্রায় ৭০-৮০ ভরি সোনা, শত ভরি রুপা, অনেক কাপড়চোপড় আকুরটাকুরপাড়ার মান্নাফ মিয়ার বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন। আমাদের ওপর রাষ্ট্রের এমন শ্যেন দৃষ্টি থাকার পরও আমাদের কোনো কিছু খোয়া যায়নি। আমি যেমন পাশের বাড়ির জিনিস পেয়েছিলাম, তেমনি ১৬ বছর পর দেশে ফিরলে এলি খালা তার কাছে গচ্ছিত সবকিছু ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। লতিফ ভাইয়ের স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকীর রেখে যাওয়া কোনো জিনিস পেতে কোনোরকমের অসুবিধা হয়নি। আমাদের অনাত্মীয়রা ১৬-১৭ বছর বৈরী পরিবেশে সবকিছু রক্ষণাবেক্ষণ করতে পেরেছেন। আর জনাব খন্দকারের কাছের আত্মীয়রা তার রেখে যাওয়া জিনিসের হেফাজত করতে পারেনি। এ আবার কেমন আত্মীয়? দেখা যাক আস্তে আস্তে এগোতে থাকি কতটা কী হয়।

লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর