মঙ্গলবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

পথের দিশা দাওগো মুর্শিদ

মহিউদ্দিন খান মোহন

পথের দিশা দাওগো মুর্শিদ

‘পথের দিশা দাওগো মুর্শিদ, পথের দিশা দাও/ আমি পথ হারাইয়া কাইন্দা মরি, আমায় তুইলা নাও...’। মরমি শিল্পী আবদুল আলিমের গাওয়া শ্রোতাপ্রিয় এ গানটি কয়েকদিন ধরে কানে বাজছিল। এর অবশ্য কারণ রয়েছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পরে আন্দোলনে ব্যর্থ বিএনপির অবস্থা অনেকটাই পথহারা পথিকের মতো হয়ে উঠেছে। নেতাদের কথাবার্তায় আস্ফালন থাকলেও আগের মতো জোর নেই। নেই পরবর্তী রাজনৈতিক দিকনির্দেশনাও। কী করে এই ত্রিশঙ্কু অবস্থা থেকে তারা দলটিকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনবেন তাও অস্পষ্ট। এরই মধ্যে জয়পুরহাট থেকে ফোন করে বিএনপি নেতা বন্ধু মতিয়ার রহমান বলল, ‘দোস্ত, এবার একটা লেখা লেখো বিএনপির এখন কী করা উচিত তা নিয়ে।’ তাকে বললাম, আমার কথা কি তোমাদের ভালো লাগবে? তোমাদের দলের নেতারা সমালোচনাকে বিরুদ্ধবাদিতা মনে করে আমাকে শত্রুপক্ষ ঠাওরে বসে আছেন। তাই তোমাদের দল নিয়ে কথা বলতে রীতিমতো ভয় পাই। মতি বলল, ‘যে যা বলুক কিছু এসে যায় না। তুমি এ দলের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ছিলে। নিশ্চয়ই তুমি দলের ভালো চাও। সুতরাং সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে কলম ধরো। দলটাকে বাঁচাতে হবে। অন্তত বিবেকের কাছে দায়মুক্ত হতে পারবে সঠিক কথাটি তুলে ধরে।’

বন্ধু মতিয়ার রহমানকে দেওয়া কথা রাখতেই আজকের রচনা। প্রথম বিচার্য বিষয়, বিএনপির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করা কতটুকু সঠিক ছিল। এ কথা বিশিষ্টজনরা বহুবার বলেছেন, নির্বাচন প্রতিহত করা  না গেলে তা বর্জন কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। কেননা, সরকার যে কোনো উপায়ে নির্বাচন সম্পন্ন করবেই। আর বিএনপির সাংগঠনিক শক্তির যে অবস্থা তাতে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে নিজেদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য আর্জন ছিল আকাশকুসুম কল্পনা। কিন্তু বিএনপি নেতারা সেটা বুঝতে চাননি। তারা সভা-সমাবেশে বিপুল উপস্থিতি দেখে ধারণা করেছিলেন, সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে জনগণ বুঝি বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো রাজপথ প্লাবিত করে ফেলবে। বাস্তবে তা হয়নি। এটা ঠিক, জনগণের একটি বড় অংশ বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল এবং সরকারের ওপর বিরক্ত। তারা সুযোগ পেলে ব্যালটে সিল মেরে তাদের সে মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে। তবে বিএনপির ডাকে রাজপথে নেমে সরকার পতনের আন্দোলনকে ‘সফল’ করতে জানবাজ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবে তেমনটি নয়। অনেকেই বিএনপিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, বিগত দুই বছরের আন্দোলন-কর্মসূচিতে তারা যেভাবে মাঠ গরম করেছিলেন, তা থিতিয়ে আসার আগেই যে কোনো কৌশলে নির্বাচনে অবতীর্ণ হতে। আন্দোলনে চাঙা বিএনপি নেতা-কর্মীদের মাঠ থেকে উঠিয়ে দেওয়া সরকারি দলের পক্ষে সহজ হতো না। অবশ্য বিএনপি নেতারা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অর্থ সরকারের গায়ে বৈধতার সিল মেরে দেওয়া। আর সেজন্যই তারা সে পথে যাননি।

অনেকে মনে করেন, এখানে হিসাব মেলাতে বিএনপি নেতৃত্ব ভুল করেছেন। তাদের বক্তব্যে এটা প্রতীয়মান হয়, নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় আসে তাহলে সে নির্বাচনে অংশ নেওয়া অর্থহীন। তাদের দিক থেকে দেখলে কথাটা অসত্য নয়। কেননা, একটি দল নির্বাচনে অংশ নেয় জয়ী হওয়ার জন্য। সেখানে যদি পূর্বাহ্ণেই এ ধারণা শক্ত ভিত্তি পায় যে, ভোটের ফলাফল ক্ষমতাসীনদের অনুকূলে যাবে, তাহলে কেবল নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখানোর জন্য অংশ নেওয়া অর্থহীন। আবার এটাও ঠিক, গণতান্ত্রিক রাজনীতির অনুশীলনে অভ্যস্ত একটি দলের পক্ষে বারবার ভোট থেকে দূরে থাকাও সমীচীন নয়। এ প্রসঙ্গে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম ১৪ জানুয়ারি রাতে একটি টিভি টকশোয় বলছিলেন, ‘নির্বাচন হলো একটি রাজনৈতিক দলের জন্য অক্সিজেন; যা গ্রহণ না করলে তার বেঁচে থাকা দায়’। কথাটির সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ কম। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান লক্ষ্য জনসমর্থন আদায় করে রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহণ। আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকারে যাওয়ার একমাত্র উপায় নির্বাচন। তাছাড়া একটি রাজনৈতিক দলের জনগণের কাছাকাছি যাওয়ার মোক্ষম উপায়ও নির্বাচনে অংশ নেওয়া। সে নির্বাচন থেকে বারবার দূরে থাকার অর্থ হলো দলকে জনগণের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়া। দ্বিতীয় যে পথে একটি রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারে, সেটি হলো সশস্ত্র বিপ্লব। বলা নিষ্প্রয়োজন, সে পরিবেশ বাংলাদেশে অতীতেও ছিল না, এখনো নেই এবং বিএনপি সে ধরনের সংগঠনও নয়। সুতরাং নির্বাচন বর্জন তাদের জন্য কোনোভাবেই সমীচীন হয়নি। আওয়ামী লীগের দিকে তাকালে দেখা যায় শত প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তারা নির্বাচন থেকে দূরে থাকেনি। ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের ন্যূনতম সম্ভাবনা নেই জেনেও শেষ অবধি তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। বস্তুত একটি নির্বাচন বর্জনের অর্থ হলো একটি রাজনৈতিক দলের পাঁচ বছরের জন্য ব্যাকফুটে চলে যাওয়া।

এখন কথা হলো, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপির কী করা উচিত। প্রথমত, বিএনপিকে তাদের কথিত আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাদের আত্মসমালোচনা করতে হবে। তৃতীয়ত, অতীতের ব্যর্থতার পর্যালোচনা করে ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। চতুর্থত, বিএনপির নেতৃত্বে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে, দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। কিন্তু হতাশার বিষয়, আত্মসমালোচনার পথে বিএনপি এখনো পা দেয়নি। বরং মনে হচ্ছে, আন্দোলনের লাশ কাঁধে নিয়ে ক্লান্ত পায়ে সামনে এগোনোর চিন্তা-ভাবনা করছে দলটি।

কোনো কাজের ব্যর্থতার পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করে ভুলের অনুসন্ধান এবং নতুন কর্মপন্থা গ্রহণ বাঞ্ছনীয়। দরকার হলে একেবারে ইউটার্ন করে উল্টোপথে হাঁটা শুরু করতে হয়। বিএনপিতে এখনো তা দেখা যাচ্ছে না। তাদের উচিত প্রথমে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তির দিকে নজর দেওয়া। সরকার উৎখাতের বালখিল্য চিন্তা-ভাবনা বাদ দিয়ে নিজেদের ঘরকে মজবুত করার দিকে মনোনিবেশ করা বেশি জরুরি। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত নেতা-কর্মীদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব-কোন্দল বিরাজমান তার অবসান ঘটাতে হবে আগে। শোনা যায়, বিএনপি এখন একক নেতৃত্বে চলছে। ঐক্যবদ্ধতার জন্য একক নেতৃত্ব খারাপ কিছু নয়। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ‘একত্ব’ পরিহার বাঞ্ছনীয়। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের প্রধান বৈশিষ্ট্য সমন্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতি। বিএনপিতে এর অনুপস্থিতি প্রকটভাবেই দৃশ্যমান। যদিও সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম হিসেবে জাতীয় স্থায়ী কমিটি নামে একটি অঙ্গ রয়েছে। তবে সেটার অবস্থা এখন আধাখেঁচড়া। অন্তত পাঁচটি পদ শূন্য রয়েছে ওই কমিটিতে। অনেক যোগ্য নেতা থাকা সত্ত্বেও সেসব পদ পূরণের কোনো উদ্যোগ নেই। তিন বছর পর পর কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হওয়ার কথা থাকলেও প্রায় আট বছর ধরে তার দেখা নেই। সর্বশেষ ২০১৬ সালের কাউন্সিলের পর ৫৯২ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠন করে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, অত্যন্ত ‘ভাইব্রেন্ট’ অর্থাৎ ‘প্রাণবন্ত’ কমিটি হয়েছে। গত আট বছরে দলটির কর্মকান্ডে সে প্রাণবন্ত কমিটির ‘প্রাণ’ কতটুকু আছে তা নিয়েই অনেকের সংশয় রয়েছে। বছরে অন্তত দুবার জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা করার কথা থাকলেও সর্বশেষ কবে তা হয়েছে অনেকে হয়তো ভুলেই গেছেন।

বিএনপি নেতারা সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে ‘ঐক্যবদ্ধ’ হওয়ার আহ্বান জানালেও খোদ দলটিতেই ঐক্যের অভাব রয়েছে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত দ্বন্দ্ব-কোন্দলে জর্জরিত দলটি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বিগত কয়েক বছরে জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাত কারণে বিএনপির বহুসংখ্যক নেতাকে হয় বহিষ্কার করা হয়েছে, না হয় পদাবনতি-অব্যাহতির মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হয়েছে। কর্মী হারানো একটি রাজনৈতিক দলের জন্য পুঁজি হারানোর মতো। যেখানে নতুন নতুন কর্মী সংগ্রহ করে দলকে অধিকতর শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা, সেখানে বিগত বছরগুলোতে শতাধিক নেতাকে দল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক দিন আগে একজন সিনিয়র সাংবাদিক বলেছিলেন, ‘বিএনপিকে টিকে থাকতে হলে এর ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে।’ কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে দলটির নেতৃত্বকে এর বিপরীত নীতি অবলম্বন করতে দেখা গেছে। প্লাস নয়, মাইনাস হয়ে দাঁড়িয়েছে মূলনীতি। যে কারণে এখন নেতৃত্বের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। তার ওপর রয়েছে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া নেতৃত্ব। কোনো কোনো এলাকায় এমন অনেককে নেতা বানানো হয়েছে, যারা কর্মী হওয়ারও যোগ্য নয়। কোথাও আবার দলকে ঐক্যবদ্ধ করার কথা বলে একজনকে নেতা বানানো হলেও তিনি কার্যত অধিকতর বিভক্তি সৃষ্টি করে দলে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ব্যাপৃত হয়েছেন। কেউ কেউ আন্দোলনে ‘রুস্তম পাহলোয়ানের’ ভূমিকা পালন করবেন বলে শীর্ষনেতাকে ম্যানেজ করে পদ বাগিয়ে আনলেও আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে তার টিকিটির সন্ধান পাওয়া যায়নি। বিক্রমপুরের বিএনপি কর্মীদের থেকে জানা যায়, তেমনি একজন হাইব্রিড নেতা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে সদম্ভে বলেছিলেন, ‘লিডার, কোনো কেন্দ্রীয় নেতার দরকার নাই। ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক বন্ধ করে দিতে আমি একাই যথেষ্ট।’ কিন্তু দেখা গেল, পুরো আন্দোলনের সময় মহাসড়কটি খোলা থাকলেও ওই নেতার বাড়ির দরজা বন্ধই ছিল। বিএনপিকে যদি ঘুরে দাঁড়াতে হয়, তাহলে দলটির নেতৃত্বের চিন্তা-ভাবনায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনা জরুরি। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগে দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা করা শুরু উচিত। কারও পারিবারিক সম্পত্তি নয়, দলকে কর্মীদের সম্পত্তিতে পরিণত করা দরকার। সবচেয়ে বড় কথা হলো, দলের ‘লিজ প্রথা’ বাতিল করতে হবে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অদূরদর্শিতার কারণে একেকজন নেতা নামধারী অরাজনৈতিক ব্যক্তি বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় দলটির লিজ-গ্রহীতা রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। এদের কবল থেকে দলকে মুক্ত করতে শীর্ষ নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। সেই সঙ্গে এ মুহূর্তে নতুন করে আন্দোলনের নামে হঠকারী কোনো কর্মসূচিতে না গিয়ে দলকে সুসংগঠিত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। বলা যায়, বিএনপি এখন দিগভ্রান্ত হতাশ পথিক। তাকে সঠিক পথের দিশা দিতে কোনো দয়াল-মুর্শিদ কি সত্যিই আসবেন?

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর