২০২০ সালের একটা সমীক্ষায় বলা হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২৮% মানুষ একলা পরিবার হিসেবে বসবাস করে। অবশ্য তার মানে এই নয় যে, সবসময় ঘরে একাকী থাকে। উইকঅ্যান্ড ছাড়া প্রতিদিন কাজে যেতে হয়। হয়তো বন্ধু- বান্ধবের সঙ্গেও সময় কাটিয়ে থাকে। তবে পরিবার পরিজনহীন এ একলা থাকাটা যুক্তরাষ্ট্রে আগের তুলনায় অনেক গুণ বেড়ে গেছে। বাংলাদেশে এ ধরনের একলা থাকার উদাহরণ নেই বললেই চলে। অন্ততপক্ষে কাজের লোকজন থাকে।
তবে আমি যে একাকিত্ব সম্পর্কে গল্প বলতে চাচ্ছি তাকে ইংরেজিতে বলা হয় লোনলিনেস যা সাময়িক বা ক্রনিক হতে পারে। এই যেমন ধরুন, আমার স্ত্রী এবং ছোট কন্যা প্রায় আড়াই মাসের জন্য ভারত এবং বংলাদেশ বেড়াতে গিয়েছে। আমিই পাঠিয়েছি। অতএব আমি এখন পুরোপুরি একা কিন্তু সাময়িক। আমার একটা দারুণ অভিজ্ঞতা হচ্ছে। তবে আমি পার্টি বা আড্ডাবাজ মানুষ। পার্টি করার জন্য বেশ কবছর আগে ব্যাকইয়ার্ডে একটা টিনেরচালা দিয়ে ক্রিনঘর বানিয়েছিলাম। ওই ঘর এখন আর তেমন আনন্দ দিচ্ছে না। অতএব সম্প্রতি বাড়ির সামনে আমাদের গাড়ি পার্ক করার অর্ধেকটা জায়গায় একটা পার্টি হাউস বানালাম। এই তো সেদিন আমার এখানকার ডিসপ্যাচ পত্রিকার এডিটর এবং তার বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করে রান্না করে খাওয়ালাম। তাই বলে প্রতিদিন তো আর পার্টি করা যায় না। সপ্তাহের পাঁচ দিনই বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে যেতে হয়। তবে উইকঅ্যান্ড অর্থাৎ শনি, রবি দুই দিন ঘরে অথবা বাজার করতে ওয়ালমার্টে যাওয়া। তা ছাড়া টেলিভিশনে খেলাধুলার প্রোগ্রাম অথবা সিনেমা দেখা। তবে মোটামুটি অনেকটা সময় একাকীই কাটাচ্ছি। এবার বলছি আসল একাকিত্ব। আপনি পার্টিতে আছেন অথবা পরিবারের সবার সঙ্গে আছেন কিংবা কোনো মিটিংয়ে আছেন এবং আপনাকে হঠাৎ একাকিত্ব ধরেছে। কেউ হয়তো বলবে আপনি অন্য মনস্ক হয়ে গেছেন। এটা কি আপনার মানসিক রোগ? ভিড়ের মধ্যে আপনি একাকিত্ব অনুভব করছেন। এবং আপনি প্রায়ই একাকীই থাকতে চান।
সেই একাকিত্বে আমার মা, বাবা এসে হাজির হয়। এসে হাজির হয় আমার চেয়ে বড় ৬ ভাই-বোন। আমার এ বয়সে মা-বাবার বেঁচে থাকার কথা নয়। এমনকি ভাই বোনেরাও। তবু স্মৃতিরা এসে ভিড় জমায়। সেই সুন্দর সুন্দর মুহূর্তগুলো অথবা সেই কাশবনে লুকোচুরি খেলার বন্ধুটি যার নরম হাতটা ধরেছিলাম। মোদ্দাকথা একাকিত্বকে ভালো লাগাতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সার্জেন জেনারেল, ডা. বিবেক মূর্তির মতে একাকিত্বতাকে বলা হয় যখন আপনার বর্তমান সংযোগ থেকেও আপনার জীবনের জন্য আরও বেশি সংযোগ প্রয়োজন। আবার প্রজেক্ট আনলোনলির লেখক, পরিচালক এবং হার্ভাডের শিক্ষক ডা. জেরিমি নোবেলের মতে তিন ধরনের একাকিত্ব রয়েছে। সাইকোলজিক্যাল, সামাজিক এবং অস্তিত্বগত। আর এসবের জন্যই রয়েছে সাইকোলজিস্ট, কাউন্সিলর এবং সাইকিয়াট্র্রিস্ট।
কভিডের সময়কালটা বিশ্বজুড়েই একাকিত্বের সমস্যা অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতেও একাকিত্ব বিশ্বজুড়েই স্বাস্থ্যগত সমস্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই মাঝেমধ্যে একাকিত্বের অনুভূতি কামনা করে। তাই অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি অনেক সময় জোর করে একাকিত্ব বেছে নেয়। তাতে করে তারা আরও সৃজনশীল হতে পারে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, বলা চলে সারাটা জীবনই একাকিত্বের ভিতর দিয়েই কাটিয়েছেন। এমনকি তিনি বেশ কয়েকবার ডিপ্রেশনেও ভুগেছেন। কিন্তু হয়তো একাকিত্ব থেকেই তিনি এতটা সৃজনশীল হতে পেরেছেন। তাই হয়তো লিখেছিলেন- ‘একলা চলোরে’।
বর্তমান সময়ের ক্রেজ এ আর রহমানও বলতে চেয়েছেন, “আপনার ভিতরের কণ্ঠ দেবত্বের কণ্ঠস্বর। এটা শোনার জন্য আমাদের নির্জনে থাকতে হবে, এমনকি ভিড়ের জায়গায়ও।” সৃজনশীলতা সব মানুষের ভিতরেই আছে। এমনকি কাজের মেয়ে রহিমারও। শুধু সময়, সুযোগ এবং চিন্তাভাবনা করার জন্য নির্জনতা প্রয়োজন।
ইলন মাস্কের টেসলা গাড়ি বেশ কবছর ধরে রাস্তায় চলছে। এ গাড়ির নামটা নেওয়া হয়েছে বিজ্ঞানী, আবিষ্কারক মি. নিকোলা টেসলা থেকে। টেসলা বলেছেন, “নির্জনতা এবং নিরবচ্ছিন্ন নির্জনতায় মন তীক্ষ্ণ এবং প্রখর হয়। চিন্তা করার জন্য কোনো বড় গবেষণাগারের প্রয়োজন নেই। সৃজনশীল মনকে পঙ্গু করার জন্য বাইরের প্রভাব থেকে মুক্ত নির্জনতায় মৌলিকতা বিকাশ লাভ করে। একা থাকুন, এটি আবিষ্কারের রহস্য; একা থাকুন, তখনই ধারণার জন্ম হয়।” এ বিজ্ঞানী ইলেকট্রিক্যাল ট্রান্সফরমার, টারবাইন, অল্টারনেট কারেন্ট, ইন্ডাকশন মোটর, নিয়ন ল্যাম্প, হাইড্রো ইলেকট্রিসিটিসহ আরও অনেক কিছু আবিষ্কার করেছেন। আইনস্টাইনের কথাও একইরকম ‘এত সর্বজনীনভাবে পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও এখনো এত একা থাকা, ভাবলে অবাক হতে হয়।’
সেলিব্রিটিরা কখনো কি একাকিত্ব অনুভব করে? করে বৈকি। ওরা এক দঙ্গল মানুষের মাঝে একা হয়ে যায়, বিশেষ করে সিনেমা, মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িতদের ক্ষেত্রে। তবে এদের সমস্যা একটু ভিন্নতর। বন্ধুত্ব ছিঁড়ে গেলে শুরু হয় একাকিত্ব। মেডোনার কথাই ধরুন। তার বক্তব্য : “আমার জীবনের অনেকাংশ ছিল যেখানে আমি খুব একা ছিলাম এবং আমি অনুভব করেছি যে পৃথিবীতে আমার কোনো বন্ধু নেই।” লেডি গাগার ক্ষেত্রে অন্যরকম পরিস্থিতি- “আমি চিরকাল একাকী। আমি যখন সম্পর্কে থাকি তখন আমি একাকী থাকি। একজন শিল্পী হিসেবে এটা আমার অবস্থা।” ‘পাইরেটস অব দি ক্যারিবিয়ান’-এর অভিনেতা জনি ডেপের ডিভোর্স হওয়াতে একাকিত্ব এবং ডিপ্রেশন দেখা দেয়।
বাংলাদেশে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে একাকী হয়ে পড়ে বিশেষ করে টিনএজার থেকে প্রাপ্ত বয়স পর্যন্ত, তাতে সমস্যাটা প্রকট হয়ে পড়ে এবং আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়। এদের আগেভাগেই কাউন্সিলিং প্রয়োজন। ফোন সার্ভিসের মাধ্যমে করা যেতে পারে।
পরিশেষে আমার একটা কবিতা এবং গানের কথা মনে পড়ছে। তাহলো- ‘এসেছি একা যাবও একা।’ সুতরাং এত ভেবে অস্থির হওয়া কেন?
♦ লেখক : অধ্যাপক, বিজ্ঞান ও অঙ্ক বিভাগ, মিসিসিপি ইউনিভার্সিটি ফর উইম্যান, কলম্বাস, যুক্তরাষ্ট্র