বৃহস্পতিবার, ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

রাষ্ট্রভাষা বাংলার সঙ্গে প্রবঞ্চনা

ড. মুহম্মদ মনিরুল হক

রাষ্ট্রভাষা বাংলার সঙ্গে প্রবঞ্চনা

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে এ পর্যন্ত ১৭টি সংশোধনী হয়েছে। নানা অংশ সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। কিন্তু তৃতীয় অনুচ্ছেদে কোনো আঁচড় লাগেনি। ওই অনুচ্ছেদে তিন শব্দে উল্লিখিত বাক্য ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ প্রথম থেকেই বিদ্যমান। কিন্তু একটি শ্রেণি নিজেদের স্বার্থে, আরেকটি শ্রেণি অসাবধানতায়, ঠুনকো পান্ডিত্য জাহিরে বাংলা ভাষাবিরোধী ক্রিয়াকলাপে লিপ্ত থাকছে।  এ কি কোনো সুচারু শত্রুতা, ষড়যন্ত্র নাকি বাংলার প্রতি অনীহা সে প্রশ্ন বারবার সামনে আসে। প্রকাশ্যে বাংলা ভাষার কোনো শত্রু নেই। প্রকাশ্যে এ ভাষার বিরুদ্ধাচরণও কেউ করে না, সম্ভবও নয়। সবাই প্রকাশ্যে বাংলা চান, বাংলা ভাষার স্তুতি করেন। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে আইনও জারি হয়। তবুও বাংলা ভাষা স্বদেশে দিন দিন দ্বিতীয় ভাষায় পরিণত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত অনাদর, অবহেলায় ধ্বংস হচ্ছে এ ভাষার যথাযথ মর্যাদা ও স্বকীয়তা। বাংলা ভাষা প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছে শিক্ষা এলাকায়; অন্তরায়ে পড়ে প্রশাসনিক কাজে। এ ভাষা গুরুত্বহীন থাকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়, বাধাগ্রস্ত হয় উন্নয়ন পরিকল্পনায়, সর্বোপরি বিলীন হয় বিভিন্ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে। ‘উন্নয়নপ্রক্রিয়ার প্রবণতা হচ্ছে উন্নয়নের ভাষারূপে মাত্র একটি ভাষার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা।’ একাধিক ভাষার ব্যবহার উন্নয়নের কাজে নানারকম বিঘ্ন ঘটায়। কিন্তু বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় ওপরের অংশে বিশেষ করে পরিকল্পনা পর্যায়ে ইংরেজি ভাষার একচ্ছত্র প্রভাব বিদ্যমান। যদি শুধু বাংলাকেই উন্নয়নের ভাষারূপে ব্যবহার করা হতো, তবে বাংলা ভাষা দ্রুত মানরূপ পেত- নতুন শব্দ গঠিত হতো, বাক্যসংগঠনে শৃঙ্খলা অর্জন করত। বাংলাদেশে প্রযুক্তির ভাষা ইংরেজি, প্রযুক্তিশিক্ষার ভাষাও ইংরেজি। দেশের প্রযুক্তিবিদ, ব্যবস্থাপকগণও কার্যক্ষেত্রে ইংরেজি ব্যবহার করেন। অধিকাংশ পন্ডিতেরা এখনো ইংরেজিনিষ্ঠ, ইংরেজিই যেন তাদের শিক্ষা, আভিজাত্য ও যোগ্যতার মানদন্ড। দেশীয় সমাজ, সংস্কৃতি ও সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণার ক্ষেত্রে এখনো ইংরেজিকে অবলম্বন করা হয়। যখন কোনো গবেষক বাংলা ভাষায় সমাজ-রাষ্ট্রের নানা ক্রিয়াকলাপ-প্রক্রিয়া ব্যাখ্যায় মন দেন, তখন তিনি উদঘাটন করতে চান বিষয়ের অভ্যন্তরীণ সূত্র। তাঁদের লক্ষ্য রচনাকে মূল্যবান করা। আর যখন ইংরেজিতে লেখেন, তখন তিনি হয়ে ওঠেন তথ্য-উপাত্ত সরবরাহকারী। 

এ দেশে যোগ্যতার অন্যতম মানদন্ডরূপে, অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধার বিচারে, নিয়োগ, দক্ষতার ক্ষেত্রে বাংলার কোনো স্থান যেন নেই। এ কারণে বাংলাকে অবলম্বন করা বা বাংলা শেখার আবশ্যিকতা নেই। ইংরেজিতেই অনেকের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষিত হয় বলে ইংরেজি ব্যবহারেই তারা বেশি সোচ্চার থাকেন। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, নতুন পদ, শাখা-প্রশাখা, শিক্ষা, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক, কোম্পানি, বিজ্ঞাপন সর্বস্তরে আজ ইংরেজি-বাংলার সংঘর্ষ; বাংলা ভাষার বিশৃঙ্খলা ও ব্যর্থতা। যেখানে নতুন নতুন পরিভাষা তৈরি হওয়ার কথা, শুদ্ধ-নির্ভুল বাংলা লেখার কথা, সেখানে উপযুক্ত-ঝলমলে বাংলা শব্দ-বাক্য বাদ দিয়ে ইংরেজি শব্দ লেখা হচ্ছে বাংলা বর্ণমালায়। একটি শ্রেণি যথাযথ-প্রচলিত বাংলা শব্দ-বাক্য বাদ দিয়ে বাংলার মধ্যে ইরেজি শব্দ-বাক্য বাংলা বর্ণমালায় লিখছে, আরেকটি শ্রেণি এগুলোর স্বীকৃতি দিচ্ছে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত গ্রন্থেও এমন পরিলক্ষিত হয়। এ ধারায়, প্রতিবর্ণীকৃত রূপের প্রয়োগ থেকে বাদ যাচ্ছে না ‘আন্দোলন’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘মুক্তিসংগ্রাম’, ‘মুক্তিযোদ্ধা’, ‘স্বাধীনতা’, ‘মানচিত্র’, ‘পতাকা’, ‘ভাষা’, ‘দেশ’ প্রভৃতি চেতনাদীপ্ত ও ঐতিহাসিক শব্দও। বিদ্যমান বিশৃঙ্খল বাংলা ভাষা পরিস্থিতিতেও ভাষাবিজ্ঞানীদের ‘চলমান প্রক্রিয়া’ বা ‘ব্যবহার সংখ্যাতিরিক্ত’ যুক্তি থামছে না। নিত্য ব্যবহৃত কয়েকটি বানান নিয়েও তারা ঐকমত্য হন না। ‘খ্রিষ্টাব্দ’ লিখতে এক অংশের ‘স’ আরেক অংশের ‘ষ’ এর ব্যবহারও অপাঙ্ক্তেয়। ফলস্বরূপ, বাংলা ভাষার বিশৃঙ্খলাকারী ও বানানে ভুল প্রয়োগকারীর আস্ফালনও কমানো যায় না। সর্বস্তরে বাংলার পরিবর্তে ইংরেজির বিস্তার, ব্যাপকভাবে বিদেশি শব্দ-বাক্যের ব্যবহার কখনো কখনো দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ বা রাজনৈতিক চাপে বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ধোপে টিকে না। বাংলা ভাষা বিরোধীরাই সফল হয়। বেড়ে যায় বাংলার সঙ্গে শত্রুতা ও ষড়যন্ত্রের মাত্রা।  একক-নির্দিষ্ট রাষ্ট্রভাষার দেশে যথোপযুক্ত বাংলা শব্দ-বাক্যকে নির্বাসিত করে বিদেশি ভাষার ব্যবহার শুধু বাংলার সঙ্গে শত্রুতা নয়, রাষ্ট্র, সমাজ ও দেশের সঙ্গেও প্রবঞ্চনা। একুশের সূত্রেই যে গ্রোথিত বাংলার প্রগতিশীলতা, সংস্কৃতি, দেশাত্মবোধ, মুক্তিসংগ্রাম, স্বাধীনতা ও চেতনা সে মর্মকে তাৎপর্যহীন করার চতুরতা।

♦ লেখক :  শিক্ষা ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ

 

 

 

 

সর্বশেষ খবর