শনিবার, ২ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

আমার একটা নদী ছিল

ইমদাদুল হক মিলন

আমার একটা নদী ছিল

সেই নদীর নাম রজতরেখা। নদীটি আমার ছিল। আমার নিজস্ব নদী। এত ভালো কোনো নদীকে আমি বাসিনি। এমন সখ্য গড়ে ওঠেনি কোনো নদীর সঙ্গে। কবিতার মতো নাম, রজতরেখা। কবে কোন মহাজন এই অসামান্য নামটি রেখেছিলেন, কে জানে। শীতলক্ষ্যা থেকে বেরিয়ে মুন্সীগঞ্জ শহরের ভিতর দিয়ে, নাকি শহরটির পাশ দিয়ে দিঘিরপার হয়ে এই নদী গিয়ে পড়েছে পদ্মায়। রবীন্দ্রনাথের ‘আমাদের ছোট নদী’র মতো।

রজতরেখার ধারের একটি গ্রামের নাম কামারখাড়া। আবার শুনতাম নাম হচ্ছে বেসনাল। দুই নামে একই গ্রাম হয় কী করে? তা জানার অবশ্য চেষ্টা করিনি কখনো। গাছপালা জলা পুকুর আর ফসলের জমিতে নিবিড় হয়ে থাকা গ্রামখানি। শিশুদের হাতে আঁকা ছবির মতো। এই গ্রামে আব্বার এক মামাবাড়ি। আব্বার দ্বিতীয় মায়ের আপন ছোটভাই আমাদের সেই দাদা। অত্যন্ত স্নিগ্ধ মুখের নম্র নিরীহ আর বিনীত ধরনের মানুষ। ওরকম মানুষ দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। এই দাদার চার ছেলে চার মেয়ে। বড় মেয়ে হালিমা ফুফুর বিয়ে হয়েছে ধনাঢ্য এক কাপড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে। আমার সেই অসামান্য সুন্দরী ফুফুটি ভদ্রলোকের দ্বিতীয় স্ত্রী। মেজো ফুফুটির বিয়ে হয়েছিল আব্বার সেই সৎমায়ের আগের পক্ষের ছেলের সঙ্গে। আমাদের সেই কাকাটির নাম ছিল হাপি। ছোটখাটো সহজ-সরল ধরনের ভালো মানুষ। এই কাকার কথা আমার ‘জিন্দাবাহার’ উপন্যাসে আছে।

দাদার ছেলেদের নাম মালেক, ওয়াজেদ, ছানা আর আমার সেজো ফুফুটির নাম খালেদা। ওই বাড়িটিকে আমরা বলতাম মালেক কাকাদের বাড়ি। মালেক কাকা তেমন লেখাপড়া করেননি। বরিশালের নিম্নাঞ্চলে দাদার সঙ্গে নৌকায় সেই অঞ্চলের হাটেবাজারে ঘুরে ঘুরে কাপড়ের ব্যবসা করতেন। ওয়াজেদ কাকা আমার ছোট। আমি ঠাট্টা করে তাকে ওয়াজদ্দি বলে ডাকতাম। আমাদের মুরগিটোলার বাসায় একবার দুবার এসে দশ পনেরো দিন করে থেকে গেছে ওয়াজেদ। স্বাধীনতার পর রজনী চৌধুরী রোডের বাসায় এসে প্রায় তিন-চার মাস থেকেছিল। গ্রামে ফিরতে পারছিল না। গ্রামের এক বাড়িতে ডাকাতি হয়েছিল। সেই ডাকাতিতে অনেকের সঙ্গে পনেরো ষোলো বছর বয়সি ওয়াজেদকেও আসামি করা হয়। আমাদের বাসায় থাকার এক পর্যায়ে উকিলের পরামর্শে সে মুন্সীগঞ্জ কোর্টে জামিন নিতে যায়। জজ সাহেব তাকে জামিন না দিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেন। দুতিন মাস বোধহয় জেল খেটেছিল ওয়াজেদ। বিনাদোষে। ক্লাস সেভেন এইটে পড়ার সময় বছরে একবার দুবার আমি কামারখাড়া গ্রামটিতে যেতাম। দশ দিন পনেরো দিন থেকে আসতাম সেই বাড়িতে। আমার দাদা যেমন ভালো মানুষ দাদিও তেমন, ছেলেমেয়েগুলোও হয়েছে তেমন। এত মায়াভরা মন একেকজনের। যেন একজনের চেয়ে আরেকজন আমাকে বেশি ভালোবাসে। খালেদা নামের ফুফুটি বোধহয় তখন ক্লাস ফোর ফাইভে পড়ে। মুখে কথা নেই। চঞ্চল পায়ে এই এদিকে ছুটে যাচ্ছে, এই ওদিকে ছুটে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর আমার জন্য নানারকমের খাবার নিয়ে আসছে। এত যত্ন আর এত আদর জীবনে কখনো আমি কোথাও পাইনি। কোনো কোনো বর্ষাকালে সেই বাড়িতে গিয়েছি। বাড়িটির সামনে সুন্দর একটি পুকুর। পুকুরের ওপারে তেঁতুল আর বাঁশঝাড় জড়াজড়ি করে আছে। ঝোপজঙ্গল আর সাপে ভর্তি জায়গাটি। এপারে বাঁধানো ঘাটলা। ঘাটলায় যাওয়ার আগে ছোটমতো একটা বাগান। দুটো পাটাতন করা টিনের ঘর আর একটা রান্নাঘর। উত্তর পাশে আরও দুই শরিকের বাস। এই হচ্ছে মালেক কাকাদের বাড়ি। পশ্চিম পাশের ঘরটায় দাদা-দাদি আর মেয়েরা থাকতেন। পুবদিককার ঘরে মালেক কাকারা তিনভাই। আমি গেলে ওই ঘরে থাকতাম।

এই বাড়ির লাগোয়া পশ্চিম দিকটায় এক কবিরাজ বাড়ি। নাকি ভদ্রলোকের অন্য কোনো পেশা ছিল আমার ঠিক মনে নেই। ওয়াজেদ কাকার বয়সি তার একটা ছেলে ছিল আর ছোট ফুটফুটে দুটি মেয়ে। বড় মেয়েটি খুব চঞ্চল। গাছপালা ঝোপঝাড়ে ভর্তি সেই বাড়িটায় একটি মাত্র টিনের পুরনো ঘর ছিল। ঘরের চাল লাউ-কুমড়োর লতায় সবুজ হয়ে আছে। রোদ যেন ঢোকেই না বাড়িতে। সারাক্ষণ স্নিগ্ধ ছায়ায় ভরে আছে ছোট্ট বাড়িটি। তার পরের বাড়িটি ছিল জমিদার বাড়ি। এলাকাটি ছিল হিন্দুপ্রধান। ছোট ছোট জমিদার বাড়ি ছিল বেশ কয়েকটি। ওই বাড়ি তেমন একটি বাড়ি। রজতরেখার তীর থেকে পশ্চিম দিকে এসেছে একটা সড়ক। সেই সড়ক চলে গেছে মালেক কাকাদের বাড়ি ঘেঁষে ওই জমিদার বাড়িটি ছুঁয়ে সোজা পশ্চিমে। রাস্তার দক্ষিণপাশে বাঁধানো ঘাটলায় বিশাল পুকুর। পুকুরের চারপাশ নারিকেল, কলা, আমড়া, কামরাঙ্গা আর পেয়ারা গাছে ভর্তি। পুকুরের মাঝখানে লাল শাপলা ফুটে থাকে। হিন্দু জমিদাররা চলে যাওয়ার পর বাড়ির মালিক হয়েছে হাওলাদাররা। ওই হাওলাদার বাড়ির বড় ছেলেটির সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়েছিল। সম্ভবত তার নাম সেলিম। ফাগুন মাসের কত বিকাল ঘাটলায় বসে গল্প করে কাটিয়েছি তার সঙ্গে। বিকাল কখন সন্ধ্যা হয়ে যেত, সেলিমদের আমবাগানের দিকে আড়মোড় ভাঙতো বাদুড়েরা, টের পেতাম না।

বাড়িটিতে দোতলা দালান ছিল। পিছনে আরেকটি পুকুর ও বিশাল আমবাগান। আমার অনেক লেখায় এই বাড়ির বর্ণনা আছে।

ওই এলাকার হাওলাদাররা বেশ নামকরা।

কামারখাড়ার পাশে আরেকটি গ্রামের নাম বাইনখাড়া। বাংলা ভাষার বিখ্যাত লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পিতৃপুরুষের গ্রাম।

বর্ষাকালে সারা দিন রাত বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছেই। রজতরেখা থেকে যে খালটি ঢুকেছে গ্রামে সেই খাল উপচে মাঠঘাট ভেসে যাচ্ছে। শুধু বাড়ির পাশের সড়কটি সামান্য জেগে আছে। মালেক কাকা ওয়াজেদ কাকাদের সঙ্গে গিয়ে ‘চাঁই’ পেতে রেখে এসেছি ওদিকটায়। সকালবেলা তুলতে গিয়ে দেখি বেশ ভারী। চিংড়ি মাছ ছটছট করছে তার ভিতরে। আমরা বলি ‘ইচামাছ’। এত পড়েছে ইচা, চাঁই টেনে তোলাই যায় না।

দাদির হাতের রান্না ছিল অসাধারণ। সেই চিংড়ি বা ইচা পেঁয়াজ কাঁচামরিচ আর সরিষার তেল দিয়ে এত চমৎকার ভুনা করতেন, এখনো সেই স্বাদ আমার মুখে লেগে আছে।

জলে একটুখানি জেগে থাকা সড়কের উপর দাঁড়িয়ে টর্চলাইটের আলো ফেললে পিল পিল করে এগিয়ে আসতো ছাটাছাটা চিংড়ি। ছাতার শলাকা দিয়ে টেঁটা বানিয়েছেন মালেক কাকা। পাটায় ঘষে ঘষে টেঁটার মুখ ধারালো করা হয়েছে। সেই টেঁটা দিয়ে টর্চলাইটের আলোয় আমরা ঘচঘচ করে চিংড়ি মাছ গাঁততাম। ওরকম আনন্দের কাল জীবনে আর কখনো ফিরে আসেনি।

এই এলাকার হাইস্কুলটি ছিল স্বর্ণগ্রামে। কামারখাড়া থেকে পশ্চিমে, সড়কের লাগোয়া। স্বর্ণগ্রামের পটভূমিতে আমি লিখেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ‘সাড়ে তিন হাত ভূমি’।

‘বন্ধু’ নামে ছোটদের গল্পটি লিখে ফেলার পর আমার মনে হয়েছিল দ্বিতীয় গল্পটি লেখা উচিত বড়দের গল্প হিসেবে। রাতারাতি লিখে ফেললাম ‘শঙ্খিনী’ নামে একটা গল্প। কিছুটা ওই খালেদা ফুফুকে কল্পনায় রেখে একেবারেই ছেলেমানুষি, কাঁচা গল্প। কিন্তু আমার ধারণা হলো লেখাটি অসামান্য হয়েছে। এই লেখা আমাকে খ্যাতির চূড়ান্তে পৌঁছে দেবে। ওই বয়সে যা হয় আর কি! তিয়াত্তর সালের শেষ দিককার কথা। তত দিনে দুয়েকটা পত্রিকা অফিস চিনেছি, সাহিত্য সম্পাদককে চিনেছি। যে পত্রিকায় প্রথম গল্পটি ছাপা হয়েছিল, দৈনিক ‘পূর্বদেশ’, সেই পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকের হাতে গল্প দিয়ে এলাম। ভদ্রলোকের কী নাম ছিল মনে নেই। তিনি বললেন এক সপ্তাহ পরে গিয়ে খবর নিতে। গেলাম। তিনি অত্যন্ত বিরক্ত ভঙ্গিতে গল্পটি ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, কিচ্ছু হয়নি। যাও ভাগো।’ বলাই বাহুল্য, খুবই অপমানিতবোধ করলাম। যেন কেউ আমার গালে একটা চড় মেরে দিল।

বাংলাবাজার থেকে ‘জোনাকি’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা বেরোত। কলকাতার ‘উল্টোরথ’, ‘প্রসাদ’ বা ‘জলসা’ পত্রিকার আঙ্গিকে। মালিক, সম্পাদক ছিলেন আবদুল মতিন নামের এক ভদ্রলোক। লেখক শিল্পীদের খুবই ভক্তিশ্রদ্ধা করতেন। আহসান হাবীব নামের এক ভদ্রলোক ওই পত্রিকার গল্প উপন্যাস নির্বাচন করতেন। মাঝারি মাপের অত্যন্ত সুন্দর ফুটফুটে চেহারার মানুষ। ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল রিলেশানসের প্রভাষক। হোন্ডা কোম্পানির ঝকঝকে নতুন একটা মোটরবাইক চালাতেন। আহমেদ সানবিম ছদ্মনামে গল্প উপন্যাস লিখতেন। কথাবার্তা আর চালচলনে খুবই স্মার্ট। ‘শঙ্খিনী’ গল্পটি সেই ভদ্রলোককে দিয়ে এলাম। ক’দিন পর খবর নিতে গেছি। তিনিও গল্প ফেরত দিয়ে একগাদা কথা শুনিয়ে দিলেন। ‘এসব বাজে লেখা আমরা ছাপি না।’ এও এক চূড়ান্ত অপমান।

তখন কলকাতা থেকে সাগরময় ঘোষ সম্পাদিত বিখ্যাত ‘দেশ’ পত্রিকাটির মতো আরেকটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বেরোত। সেই পত্রিকাটির নাম ‘অমৃত’। ‘দেশ’ আনন্দবাজার গ্র“পের পত্রিকা আর ‘অমৃত’ হলো যুগান্তর গ্র“পের। অমৃতর সম্পাদক ছিলেন কবি মনীন্দ্র রায়। তাঁর সহযোগী ছিলেন কমল চৌধুরী নামে এক ভদ্রলোক। ‘শঙ্খিনী’ গল্পটি আমি ডাকে পাঠিয়ে দিলাম ‘অমৃত’ পত্রিকায়। আশ্চর্য ব্যাপার, ঠিক পরের সপ্তাহে ছাপা হয়ে গেল। ছাপা হলো সম্পাদকীয় পাতার পরের পাতায়। অর্থাৎ পত্রিকাটির প্রথম লেখা। পরবর্তীকালে জেনেছি ব্যাপারটি অত্যন্ত সম্মানজনক। সাধারণত বড় বা নামি লেখকদের লেখা দিয়ে পত্রিকা শুরু হয়। কবি মনীন্দ্র রায় বা কমল চৌধুরী আমার লম্বা নামটি দেখে হয়তো ভেবেছিলেন, আমি বাংলাদেশের জাঁদরেল কোনো লেখক হব। সেই কারণেই এতটা সম্মান দিয়ে লেখাটি ছেপেছিলেন।

এ ঘটনার বছর পঞ্চাশেক পর কলকাতা বইমেলায় বয়স্ক এক ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। আমি বসেছিলাম নির্মল বুক এজেন্সির স্টলে। ধপধপে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোকটি এসে বললেন, ‘আমার নাম কমল চৌধুরী। অমৃত পত্রিকায় আপনি চারটি গল্প লিখেছিলেন। সবগুলোই আমার হাত দিয়ে ছাপা হয়েছে।’ অমৃতে ‘শঙ্খিনী’ ছাপা হওয়ার পর আমি খুবই হাস্যকর একটি কান্ড করেছিলাম। দুটো ‘অমৃত’ পত্রিকা কিনেছি। একটা বাড়িতে রেখে আরেকটা বগলে নিয়ে প্রথমে গেলাম দৈনিক ‘পূর্বদেশ’-এর সাহিত্য সম্পাদকের কাছে। পত্রিকাটি তাঁর সামনে খুলে ধরে বললাম, ‘এই যে দেখুন গল্পটি ছাপা হয়েছে।’ ‘অমৃত’ পত্রিকায় এতটা সম্মান দিয়ে আমার গল্প ছেপেছে দেখে ভদ্রলোক এতটাই হতভম্ব হলেন, কী বলবেন বুঝতেই পারছিলেন না। তোতলাতে লাগলেন, ‘না মানে ইয়ে...।’ আহমেদ সানবিম নামের ভদ্রলোকটির কাছেও গেলাম। ছাপা গল্পটি দেখে তাঁর মুখের ভঙ্গি হলো দেখার মতো। ঢাকা ইউনিভার্সিটির আইআর এর লেকচারার, অত স্মার্ট লোকটি একেবারে যেন গাধা হয়ে গেলেন। আমাকে বলতেন তুমি করে। সে কথা ভুলে আপনি আপনি করতে লাগলেন। ‘বসুন বসুন, চা খান।’ এই ঘটনার বেশ কয়েক বছর পর আহসান হাবীব ওরফে আহমেদ সানবিম রোকেয়া হলের সামনের রাস্তায় মোটরবাইক অ্যাকসিডেন্টে মারা যান। মুক্তধারা থেকে সম্ভবত তাঁর একটি বা দুটি ছোটদের গল্পের বই বেরিয়েছিল।

পরে ‘শঙ্খিনী’ গল্পটি আমি মনোযোগ দিয়ে পড়ে দেখেছি সত্যি সেটি অত্যন্ত কাঁচা গল্প। অল্প বয়সের ভাবালুতা ছাড়া ওই গল্পে আর কিছুই নেই। যে দুজন সম্পাদক গল্প ফেরত দিয়েছিলেন তাঁদের জায়গায় আমি হলেও ওই গল্প ছাপতাম না।

একবার বর্ষাকালে মালেক কাকাদের বাড়িতে গিয়েছি। দাদা আর মালেক কাকা বরিশালে। ওয়াজেদও বাড়িতে নেই। এ অবস্থায় আমি গেছি বেড়াতে। দাদির যত্নআত্তির অন্ত নেই। খালেদা, ছানা ওরাও আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়েছে। ছানার তখন সাত-আট বছর বয়স হবে। একদিন দুপুরের মুখে দাদি খুবই লাজুক মুখে বললেন, ‘বাড়িতে কেউ নাই মিয়াভাই, একটু যে বাজারে যাওন লাগে। পাঠানোর মতন কোনো লোক পাইতাছি না। তুমি যাইবা?’ আমি প্রমাদ গুনলাম। কামারখাড়া থেকে দিঘিরপার বাজার মাইল খানেকের কাছাকাছি। একা একা নৌকা বেয়ে যেতে হবে। নৌকা আমি ভালোই বাইতে পারি। সাঁতারও জানি। মেদিনীমন্ডল গ্রামে থাকার সময় বালক বয়সেই ওসব শিখে ফেলেছিলাম। দাদি বললেন, ‘পারবা না মিয়াভাই?’ ওই বয়সের ছেলেদের পৌরুষ ধীরে ধীরে জাগতে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ পৌরুষের ছোট ছোট ধাক্কা এসে কৈশোর আর যৌবনের মাঝখানকার সময়টিকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। দাদির কথায় আমার পৌরুষের অহঙ্কার জেগে উঠল। ‘হ, পারুম। অহনই যাইতাছি।’ দাদি আমার হাতে একটা পাঁচ টাকার নোট দিয়ে, কী কী আনতে হবে বলে দিলেন।

সড়কের কোনায় একটা বকুলগাছ। গাছের গোড়ায় মালেক কাকাদের কোষা নৌকাটা বাঁধা। আমার পরনে ডোরাকাটা লুঙ্গি আর নীল রঙের হাফহাতা শার্ট। বুক পকেটে দাদির দেওয়া পাঁচ টাকার নোটখানা নিয়ে বইঠা বাইতে লাগলাম।

সড়কের দক্ষিণ পাশে রজতরেখা থেকে ঢুকে যাওয়া খালটি পুবে-পশ্চিমে লম্বা। প্রথমে আমাকে যেতে হবে পুবদিকে। খানিক দূর এগোলে মুন্সীগঞ্জ থেকে আসা সড়কটি দক্ষিণে চলে গেছে। এদিকটায় কাঠের একটা পুল। ওই পুল থেকে ওয়াজেদ কাকা আর আমি অনেক দিন খালের জলে লাফিয়ে পড়ে ডুবোডুবি করেছি। ‘বলো তারে’ গল্পে এ সব কথা লিখেছিলাম। ওই পুলের তলা দিয়ে কোষা নৌকা বেয়ে গিয়ে পড়লাম রজতরেখায়। এখন যেতে হবে দক্ষিণে। বর্ষার ভরা নদী। আমরা স্রোতকে বলি ‘কাটাল’। রজতরেখায় ব্যাপক কাটাল। উত্তর থেকে দক্ষিণে চলেছে কাটালের টান। দিঘিরপার বাজারে যেতে তেমন কোনো কষ্টই হলো না। বইঠায় এক ‘চাব’ দিলে নৌকা যতটা এগোয়, কাটালের টানে এগোয় তার চেয়ে তিন-চার গুণ বেশি। অনায়াসেই চলে গেলাম বাজারে। দিঘিরপার খুবই জমজমাট বড় বাজার। কত রকমের নৌকা লেগে আছে ঘাটে। আখের নৌকা, গুড়ের নৌকা, ধান-চাল, আনাজপাতির নৌকা। অনেকটা আমার ছেলেবেলার গোয়ালীমান্দ্রার হাটের মতো। লোকজনে গমগম করছে বাজার। কত নৌকা এসে ভিড়ছে বাজারের ঘাটে, কত নৌকা ছেড়ে যাচ্ছে। বড় বড় পালতোলা মহাজনি নাও বাজারের ঘাটে না থেমে সোজা চলে যাচ্ছে দক্ষিণের পদ্মায়। হয়তো দূরের কোনো গঞ্জে যাবে।

বাজারঘাটে নৌকা বেঁধে নামলাম। দাদির বলা জিনিসগুলো ঘুরে ঘুরে কিনলাম। কত মানুষ বাজারে! কত দোকানপাট। গুড়ের ডালায় ভন ভন করছে মাছি। মাছ চালা থেকে আসছে মাছের বোঁটকা গন্ধ। ময়রার দোকানে জিলিপি ভাজা হচ্ছে। গুড় দিয়ে খাস্তারুটি খাচ্ছে কয়েকজন মাঝিমাল্লা। খালি গায়ের একটি কিশোর টুকরো করা আখের ছাল ছাড়াচ্ছে। ঝিমকালো শরীরে তার দাঁতগুলো অতিরিক্ত সাদা মনে হচ্ছে। আবর্জনার ভাগাড়ে কাক আর কুকুর হামলে পড়েছে।

ফেরার সময় কাটালের বিপরীতে যেতে হবে। বাড়ি পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে?

ভরা বর্ষায় ছানা সেন্টুদার বাবা হাফেজমামা তার দুই ছেলেকে নিয়ে পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরতে যেতেন। ইলিশ ধরার জাল ছিল তার। ওরকম বর্ষায় বিকালের দিকে চলে যেতেন। পরদিন বেলা করে বাড়ি ফিরতেন। নৌকার ডরায় বারো পনেরোটা কিংবা তার চেয়েও বেশি ছোট বড় মাঝারি সাইজের ইলিশ। চকচকে সাদা ইলিশের গা থেকে নীলচে একটা আভা বের হতো আর মাছগুলো যেন একটু বাঁকা হয়ে থাকত। আমার বুজিকে তিন-চারটা মাছ দিয়ে যেতেন হাফেজমামা। সেই মাছের কী অপূর্ব গন্ধ ছিল, কী অপূর্ব স্বাদ ছিল! ছানা সেন্টুদা দুজনেই মহা গল্পবাজ। ওই বয়সেই বিস্তর অভিজ্ঞতা তাদের। পদ্মায় মাছ ধরতে গিয়ে তারা জেনেছিল নদীতে কাটাল যদি খুব বেশি হয় তা হলে ফেরার সময় তীরঘেঁষে নৌকা বেয়ে আসতে হয়। তীরের দিকে কাটালের জোর থাকে কম। নৌকা বেয়ে আসতে সুবিধা।

দিঘিরপার বাজার থেকে ফেরার সময় কথাটা মনে পড়েছিল। দক্ষিণ থেকে উত্তরে যাব। এখন ডান দিকে গ্রাম। বাঁ দিকে রজতরেখার বালুচর বর্ষাজলে ডুবে গেছে।

মনে আছে যতক্ষণ সময় লেগেছিল বাজারে যেতে, ফেরার সময় লাগল তার তিনগুণ বেশি। শ্রাবণ মাসের শেষদিক। আকাশে পালতোলা নৌকার মতো ভাসছে সাদা মেঘ। কোথাও কালো মেঘের চিহ্ন নেই। বৃষ্টির সম্ভাবনাই নেই। কাস্তের ধারের মতো রোদ আমার গায়ে মাথায় যেন অবিরাম পোঁচ দিয়ে যাচ্ছিল। ঘেমে একেবারে নেয়ে উঠেছি। নদীতে ওই প্রথম ওই শেষ নৌকা বাওয়া আমার। রজতরেখা নদীটির কথা ভাবলেই এই স্মৃতি মনে আসে। চোখের সামনে এক কিশোরকে দেখতে পাই, ঘামে নেয়ে কোষা নাও বেয়ে বাড়ি ফিরছে। তখন টেডি প্যান্টের ফ্যাশন চালু হয়েছে। এখনকার স্কিনটাইট জিন্সের মতো নিম্নাঙ্গে একেবারে সেঁটে থাকে। মালেক কাকাদের বাড়িতে ওরকম একটা প্যান্ট নিয়ে গেছি। আটষট্টি সালের কথা। আগস্ট মাস। কয়েক দিন সেই বাড়িতে কাটিয়ে ফিরছি। রজতরেখার পশ্চিমতীরে, যেখান দিয়ে খাল ঢুকেছে গ্রামের ভিতর, নদী এবং খালের মুখটায় হেলে পড়া একটা খেজুরগাছ। জায়গাটাকে বলে খেজুরতলা। খেজুরতলাতেই মুন্সীগঞ্জ থেকে আসা স্পিডবোট, নৌকা এসব থামে। অর্থাৎ ওটা একটা ঘাট। আমি টেডি প্যান্ট পরে ব্যাগ হাতে নিয়ে নৌকায় চড়লাম। কিন্তু প্যান্ট এত টাইট, পা ভাঁজ করে বসা যায় না। প্রচ- রোদ। সেই রোদে ছইয়ে উঠে পা ঝুলিয়ে বসে রইলাম। মাঝি নৌকা বেয়ে যাচ্ছে কাটাখালির দিকে আর আমি রোদে ভাজাভাজা হচ্ছি। আমার অবস্থা দেখে মাঝি লোকটার খুব মায়া হলো। বলল, ‘বাজান, নৌকায় আমার একটা লুঙ্গি আছে। লুঙ্গিটা দিতাছি। লুঙ্গি পইরা ছইয়ের তলায় বসেন। এই রইদ্রে পুইড়া লাভ কী?’ নৌকার অন্য যাত্রীরা হাসাহাসি করছিল আর আমি খুবই লজ্জা পাচ্ছিলাম। কিশোর বয়সের লজ্জা বড় ভয়ংকর। সঙ্গে একটা জেদও হলো। না আমি নড়ব না। যা হওয়ার হবে। ওই রোদেই পুরো রাস্তাটা বসে রইলাম, একটুও নড়লাম না। রোদে পুড়ে ঝিম কালো হয়ে ঢাকায় ফিরলাম। আমাকে দেখে কান্নার রোল পড়ল বাসায়। কারণ গেট দিয়ে ঢুকেই আমি রুম দুটোর দিকে তাকিয়েছি, কোন রুমে আটকে রাখা হয়েছে পাগল বুজিকে। বুজি নেই। পাশের পুকুরে ডুবে মারা গেছেন। বুজির মৃত্যুর কথা লিখেছি ‘যে জীবন আমার ছিল’ বইতে।

জগন্নাথ কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ি। তখন খালেদা ফুফুর বিয়ে হয়ে গেল। সে বোধহয় তখন সেভেন এইটে পড়ে। বিয়ে হলো পয়সা গ্রামে, ফজল কাকার দোস্ত আমজাদ কাকার সঙ্গে। বর্ষাকাল। পয়সা থেকে বজরা নিয়ে এসেছে বরযাত্রীর দল। ফজল কাকা হাপি কাকা আছেন মালেক কাকাদের বাড়িতে। খালেদা ফুফু লালশাড়ি পরে গুট গুট করে হেঁটে বজরায় গিয়ে উঠল। সে তেমন লম্বা না, বেঁটে ধাঁচের। তার ওই হেঁটে যাওয়াটা এখনো আমার চোখে লেগে আছে। তার পর বহু বহু বছর এই ফুফুটির সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। গেন্ডারিয়াতে কার যেন বিয়েতে একবার দেখা হলো। ওই বয়সের পর অন্তত ত্রিশ বছর কেটে গেছে। তার পরও তাকে দেখে আমার মনে হলো ফুফুটি যেন ওই বয়সেই আছে। একদিন কত প্রিয় মানুষ ছিল চারপাশে। কত যোগাযোগ, কত দেখা সাক্ষাৎ ছিল তাদের সঙ্গে। সময় বড় নিষ্ঠুর, মানুষের সঙ্গে দূরত্ব তৈরিতে বিশাল ভূমিকা পালন করে।

মেদিনীমন্ডলের পর আমার সবচেয়ে প্রিয় গ্রাম কামারখাড়া বা বেসনাল। গ্রাম জীবন নিয়ে লিখতে গেলেই ফেলে আসা এই দুই গ্রামের দৃশ্য ভেসে উঠে চোখে।

‘নূরজাহান’ উপন্যাসে ‘পারুল’ নামে একটি চরিত্র আছে। মান্নান মাওলানার বড় ছেলের স্ত্রী, তিন সন্তানের জননী। কিন্তু তার শরীরের বাঁধন অপূর্ব। দেখে মনেই হয় না তিনটি ছেলে আছে তার। যেন এখনো কুমারী মেয়ে হিসেবে বিয়ে দেওয়া যাবে। ছোট দেবর আতাহারের সঙ্গে পারুলের প্রেম ও শরীরের সম্পর্ক। আতাহার যখন অন্যত্র বিয়ে করছে সেই অভিমানে বর্ষাকালে সে তিন ছেলেসহ চিরতরে বাপের বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। আতাহারকে তার মনে হচ্ছিল, ও কোনো মানুষ নয়। ও একটি নর্দমার কীট, মলের পোকা। পারুলের বাপের বাড়ি দিঘিরপারের দিককার কোনো এক গ্রামে। বর্ষার খাল বিল ভেঙে পারুল আর তার তিন ছেলেকে নিয়ে যে যুবক মাঝিটি নৌকা বেয়ে যাচ্ছিল সে খুবই আমুদে ধরনের। গান গাইতে গাইতে নৌকা বাইছিল।

‘আমার পাগলা ঘোড়া রে

কই মানুষ, কই লইয়া যাস।’

সময় আসলেই এক পাগলা ঘোড়া। কোথাকার মানুষকে যে কোথায় নিয়ে ফেলে, সময়ের এই কারসাজি মানুষ বুঝতে পারে না।

                লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

সর্বশেষ খবর