মঙ্গলবার, ৫ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

হাবিয়া দোজখের এই আগুনের শেষ কোথায়?

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

হাবিয়া দোজখের এই আগুনের শেষ কোথায়?

এ পর্বের লেখা আগেই শেষ করেছিলাম। ভেবেছিলাম একনাগাড়ে ভিতরে মোশতাক বাহিরে খন্দকারের লেখা ‘১৯৭১ ভেতরে বাইরে’ বইটি নিয়ে আলোচনা করব। বাইরে আর ভিতরে খন্দকার বললাম এ কারণে যে, একদিকে আবুল কাশেম খন্দকার, অন্যদিকে খন্দকার মোশতাক। এক খন্দকার আগে, আরেক খন্দকার শেষে তাই অমন বললাম। এ কে খন্দকারের জন্ম ১৯৩০ সালের ১ জানুয়ারি। বাড়ি পাবনার নগরবাড়ী ঘাটের পাশে। বাবা সরকারি চাকরি করতেন বলে অবিভক্ত বাংলার নানা জায়গায় ঘুরেছেন। এক জায়গায় বলেছেন, তার স্কুলে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সে সময়ের বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন গিয়েছিলেন। সে অনুষ্ঠানে কিছু হিন্দু ছাত্রছাত্রীও পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। মুসলিম মন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নেবে না; এ জন্য তারা সেদিন স্কুলেই আসেনি। হতে পারে? কারণ তখন দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি নিয়ে এক প্রচন্ড উত্তেজনা ছিল। ’৪৭-এ ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর তার বাবা আগে ছিলেন ব্রিটিশের চাকর বা গোলাম, পাকিস্তান হলে শুধু রাষ্ট্রের নাম বদল করে হয়েছিলেন পাকিস্তানের গোলাম। এই যা কৃতিত্ব। তিনি মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন ১৯৪৭ সালে মালদহ স্কুল থেকে। তখন তার পরিবার ছিল মেদিনীপুরের কাঁথিতে। সেখান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। আইএ পাস করে ভর্তি হয়েছিলেন স্যার সলিমুল্লাহ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে সময় পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে লোক নিতে একদল কর্মকর্তা ঢাকায় আসেন। তার ছেলেবেলা থেকেই আকাশে ভাসবার স্বপ্ন ছিল। তাই তিনি তার বইয়ে লিখেছেন, বিএ, এমএ পাস করা ৪৩ জন অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে উচ্চমাধ্যমিক পাস একমাত্র তিনিই নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমি তার লেখা থেকেই পরে এক এক করে তুলে ধরব। এখানে আর তাকে নিয়ে এগোতে পারলাম না। সমসাময়িক কিছু ঘটনা আমাকে বাধ্য করল সেদিকে দৃষ্টি দিতে।

প্রথমেই বলব সেদিন বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে হাবিয়া দোজখের আগুনে বেশ কিছু সোনার সংসার পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক পরিবারের পাঁচজন পাসপোর্ট, ভিসা করে ইতালি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে দেশ ছাড়ার আগে শেষ খাবার খেতে হাবিয়া দোজখে গিয়েছিল। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। বেহেশতের সম্ভাবনায় তাদের আর বিদেশ যাত্রা হয়নি। স্টামফোর্ডের অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদারের মেয়ের ছিল জন্মদিন। তারাও বড় আশা করে জন্মদিনের উৎসব পালন করতে নামকরা রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলেন। এক সময় হঠাৎই তারা বুঝতে পারেন আগুন লেগেছে। মনে হয় তারা চারজন ড. কামরুজ্জামান মজুমদার, তার স্ত্রী এবং মেয়েদের নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে বেরোবার চেষ্টা করেন। সেখানে আগুন। কী করবেন, আবার ফিরে আস্তে আস্তে ছাদে উঠে যান। উঠতে উঠতে ভাবেন যদি ছাদের দরজা বন্ধ থাকে তখন কী হবে। কিন্তু না, আল্লাহর রহমতে ছাদের দরজা তারা খোলা পান এবং ছাদে উঠে যান। সেখানেও দু-একটি চেয়ার টেবিল দিয়ে গ্রাহক আপ্যায়নের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু প্রায় অর্ধেক ছাদ ফাঁকা ছিল। অনেক মানুষ জড়ো হয়। কিন্তু সেখান থেকে সরে যাওয়ার কোনো পথ নেই, পাশের কোনো দালানকোঠায় যাওয়ার সুযোগ নেই। এক দালান থেকে আরেক দালানের দূরত্ব বড়জোর ৬+৬ = ১২ ফুট। কিন্তু এই ১২ ফুটের পুলসিরাত সেদিন কারও পক্ষেই পার হওয়া সম্ভব ছিল না। নির্মাণ আইনে যদি মানুষের সুরক্ষার জন্য এক ইমারত থেকে আরেক ইমারতে যাওয়ার জন্য যদি ছোট ছোট কয়েকটা পুল করে রাখা হয় তা হলে অতি সহজেই এমন দুর্যোগ-দুর্বিপাকে মানুষের জীবন বেঁচে যেতে পারে। কিন্তু না, সেখানে তেমন ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু তবু তারা উদ্ধারকারীদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন, আশা ছিল উদ্ধারকারী কোনো দল আসবে তাদের বাঁচাতে। বিশেষ করে অধ্যাপক ছিলেন ওরকম দুর্যোগ-দুর্বিপাক বিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ। যার জন্মদিন ছিল সেই বাবা-মা-বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল আর বলছিল আমার জন্মদিন কী তাহলে সত্যি সত্যিই মৃত্যুদিন হলো। না, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অবুঝ শিশুর জীবননাশ করেননি। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল তাদের বিশাল চঙ্গা দিয়ে অবরুদ্ধদের উদ্ধার করেছে। জানি না এই উদ্ধারকর্মের জন্য যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অগ্রসর হয়েছে তারা আদৌ বিভাগীয়ভাবে এবং জাতির কাছে কতটা কি সম্মান পাবে। কারণ আমাদের দেশে এখন কেউ কাউকে অন্তরাত্মা উজাড় করে সম্মান করে না। আর যারা এভাবে পূর্ব অনুমতিহীন হাবিয়া দোজখের সৃষ্টি করে তাদের আদৌ কিছু হবে কি না। কবে নিমতলী, আশুলিয়া তাজরীন ফ্যাশন, চকবাজারের চুড়িহাট্টা, বনানীর এফআর টাওয়ার, বঙ্গবাজার, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা এরকম কত শত শত বন্ধ দালানকোঠায় মানুষ পুড়ে মরছে। কারও কোনো আকার-বিকার নেই। ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র মহোদয় কী করছে কিছু বুঝি না, বলতেও পারি না। কত বড় নেতা কত ত্যাগী মানুষ মণিভাই। যিনি আমাকে, আমার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীকে আপন ভাইয়ের মতো দেখতেন। তার সন্তান তাপস-পরশকে দুর্দিনে কতবার কোলে নিয়েছি। কিন্তু মেয়র হিসেবে তাপসের কোনো উচ্চবাচ্য শুনছি না। কেমন যেন লাগে। এই অগ্নিকান্ড এই রাবণের চিতাও কি আগের মতোই বিনা প্রতিকার বা বিনা বিচারে যাবে? যে যাই বলুক, বঙ্গবন্ধুকন্যা মায়ের মতো বোন তেমন কিছুই বলতে পারি না। কিন্তু এক সময় তো এসবের সমস্ত দায়-দায়িত্ব ব্যর্থতা সবই তার ওপর বর্তাবে। বড় অস্বস্তি লাগে।

মার্চ বাংলাদেশের জন্মের মাস, মার্চ বাঙালি জাতির রক্তদানের মাস। মার্চ বাংলাদেশের পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মের মাস। আমি সব সময়ই ভাবী, বাংলাদেশের আর বঙ্গবন্ধুর জন্মের একই অর্থ। তা না হলে একই মাসে বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু জন্মাবেন কেন? সে যাই হোক, ২ মার্চ বহুদিন পর মুক্তিযুদ্ধের চারণভূমি ভূঞাপুরে গিয়েছিলাম বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা মো. এছহাকের সম্পাদনায় “কাদেরিয়া বাহিনীর ২৭ নম্বর হিরো কোম্পানি ’৭১” বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করতে। বড় ভালো লেগেছে গবেষক মামুন তরফদার, মির্জা মহীউদ্দিন আহমেদ ও অন্যদের বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা। বিশেষ করে মহীউদ্দিন আহমেদ তার লেখা একটি বই দিয়েছেন। চন্দন ঘোষের সঙ্গে স্বাধীনতার পরপরই আমার সাক্ষাৎ। তার বাবা যোগেন্দ্র ঘোষকে হানাদারদের হত্যার কাহিনি বলে কাঁদছিলেন। সেদিন নাকি আমিও কেঁদেছিলাম। অন্যের দুঃখে দুঃখিত হওয়া আমার চিরদিনের অভ্যাস। এখনো অনেকের দুঃখে কাঁদি। তাদের আত্মীয় দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বাধীনতার সময় দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আত্মার আত্মীয়তে পরিণত হয়েছিলেন। ’৭২ এর এপ্রিলে শতাধিক সহকর্মী নিয়ে আমি যখন জীবনে প্রথম কলকাতা যাই তখন ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির পক্ষ থেকে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি নেত্রকোনার সন্তান শঙ্কর প্রসাদ মিত্র দুজন পাশাপাশি আমাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেছিলেন। সেই প্রথম আমাকে কেউ সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে। আমার সারা দেহমন উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল। আমি বিব্রত হয়ে গিয়েছিলাম। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে দেবদেবীকে, আরাধ্য ভগবানকে। এরপর দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে নির্বাসিত জীবনে এক নিবিড় ঘনিষ্ঠতা জন্মেছিল। তার বাড়িতে কতবার খেয়েছি বলার মতো না। দেবুদা বর্ধমানে এসেছেন, ছেলেমেয়ে স্ত্রীকে নিয়ে খেয়েছেন, আমার ঘরে থেকেছেন। যেমনি ভারতের প্রয়াত মহামান্য রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জি বর্ধমানে আমার বিছানায় আমার ঘরে রাত কাটিয়েছেন। তেমনি কত স্মৃতি কত কথা, কখন চলে যাব, তাই কোনো কিছু পাশ কাটিয়ে যেতে পারি না। বড় সাধ জাগে পক্ষে-বিপক্ষে যা কিছুই হোক যেন লিখে যেতে পারি। মির্জা এছহাকের বই প্রকাশনীতে মুক্তিযুদ্ধে ভূঞাপুরের কত বীর মুক্তিযোদ্ধা, ত্যাগী বন্ধু, সহকর্মীদের কথা যে মনে পড়েছে বলে শেষ করতে পারব না। পিংনা থেকে কমান্ডার আবদুল হাকিম বীরপ্রতীক এসেছিল। তাকে সভাপতি করা হয়েছিল। কত যে ভালো লেগেছে, আনন্দিত হয়েছি, যা বলার মতো না। এসেছিল সরিষাবাড়ী পিংনার জাহাজমারা সামাদ গামা। অনেকেই আসেনি, আসতে পারেনি। কেউ কেউ তো পরপারে চলে গেছে। তাদের মধ্যে আশরাফ গিরানী, আজিজ বাঙ্গাল, আলীম তালুকদার, ক্যাপ্টেন মোতাহার, মাহফুজ সিদ্দিকী, জিয়াউল হক জিয়া, আরফান কোম্পানী, আবদুল হামিদ ভোলা, কদ্দুস, জাহাঙ্গীর, জমশের, মীর মোয়াজ্জেম হোসেন দুদু, আ. বারী, মোহন, বদি, তারা মৃধাসহ আরও অনেকে।

ওই দিনই সন্ধ্যার দিকে ঢাকার পথে ছিলাম। আমি এমনিতেই মোবাইল নিয়ে বেশি টোকাটোকি নাড়াচাড়া করতে শিখিনি। কিন্তু তবু ইদানীং যখন গাড়িতে নিশ্চুপ বসে থাকি তখন ইউটিউবে এটা-ওটা দেখার চেষ্টা করি। সেখানে খবরই বেশি। বিশেষ করে ইদানীং পাকিস্তানের রাজনৈতিক কর্মকান্ড, ইমরান খান, গাজায় ইসরায়েলের বর্বরতা, ন্যাটো সমর্থিত ইউক্রেন যুদ্ধ। মনে হয় তখন সাড়ে ৭-৮টা হবে হঠাৎই চোখ পড়ে সদ্য সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর এক সংবাদ সম্মেলন। সংবাদ সম্মেলনে তার ৩০-৩৫ মিনিটের কথাবার্তা আমাকে মারাত্মকভাবে আকৃষ্ট করেছে। সাইফুজ্জামান আমার ভাতিজা। কোলে নিতে পেরেছি কিনা বলতে পারব না। তবে ওর বাবার সঙ্গে ওকে অনেকবার পাশে বসিয়েছি, আদর করেছি। ভূমিমন্ত্রী হিসেবেও তাকে বেশ কয়েকবার দেখেছি। একটা কর্মদ্যোমী যুবকই মনে হয়েছে। কিন্তু ২ মার্চের তার সংবাদ সম্মেলন আমাকে স্পর্শ করেছে। জানি বর্তমানে রাজনীতিকদের হাতে রাজনীতি নেই। রাজনীতির ১৪-১৫ আনাই এখন ব্যবসায়ীদের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বে। এক্ষেত্রে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর ছেলে সাইফুজ্জামানও আলাদা নয়। কিন্তু দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে তার সম্পর্কে বিদেশে সম্পদ বা টাকা পাচার নিয়ে যেসব কথা উঠেছে সেসব নিয়ে আমার মনেও কমবেশি প্রশ্ন ও দ্বিধা সংশয় ছিল। রাজনীতির ছত্রছায়ায় কত মানুষ কত কিছু করেছে। যাদের এক সময় ভাঙা কাপে চা খাওয়ার ক্ষমতা ছিল না তারা অনেকেই এখন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। আমরা পাকিস্তানের ২২ পরিবারের হাত থেকে মুক্ত হতে চেয়ে বুকের রক্ত ঢেলে বাংলাদেশ বানিয়ে ২২ হাজার বা ২২ লাখ ধনীর হাতে বন্দি হয়ে পড়েছি। মুক্তির কোনো পথ পাচ্ছি না। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর ছেলে সাইফুজ্জামানও তাদের দলের বাইরে নয়। কিন্তু একটা ব্যাপার সে স্পষ্ট করেছে যে, ‘আমরা একটা ব্যবসায়ী পরিবার। সারা জীবন সৎভাবে ব্যবসা করেছি। ইংল্যান্ড, আমেরিকায় স্বাধীনতার আগে থেকেই আমার বাবার ব্যবসা ছিল। আমি রাজনীতি করিনি। আমার বাবা রাজনীতি করতেন। তার মৃত্যুর কারণে আমি ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিতে এসেছি। আমি আমার ব্যবসা-বাণিজ্য বেনামে ছেড়ে আসিনি। বিশেষ করে দেশের বাইরের ব্যবসা-বাণিজ্য।’ সে বলেছে, ‘আমার নামে বিদেশি ব্যবসা-বাণিজ্যের এবং বিশেষ করে মন্ত্রী হওয়ার পর গত ১০ বছরে আমার বিপুল পরিমাণ বিদেশে সম্পত্তি বেড়েছে। এসবে মন্ত্রী হয়ে আমি যদি কোনো প্রভাব বিস্তার করে থাকি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। বিশেষ করে আমেরিকা, ইংল্যান্ডে বাংলাদেশের মতো ব্যবসা-বাণিজ্যে কোনো প্রভাব খাটে না। সেখানে আইন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ এবং নিয়মকানুন মেনে ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হয়। করোনার সময় অনেকেই ভয় পেয়ে জিনিসপত্র কম দামে ছেড়ে দিয়েছে। আমি সাহস করে আইনের মাধ্যমে সেগুলো গ্রহণ করেছি বা ক্রয় করেছি। করোনা শেষে সেগুলোর দাম শত গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার ব্যবসাও বেড়েছে। সেখানে এক পয়সাও ট্যাক্স না দিয়ে আড়াল করা যায় না। বৈধ ট্যাক্স দিয়ে বৈধ ব্যবসা করেছি।’ তার আরেকটা কথা আমাকে স্পর্শ করেছে, ‘চিটাগাংয়ে আমার বাবা ’৭৩ সালে আট লাখ টাকা দিয়ে আমাদের বাড়ি কিনেছিলেন। যার দাম এখন সাত-আট শ কোটি টাকা।’ সাইফুজ্জামান আরও বলেছে, পটিয়া অথবা সাতকানিয়ার কোথাও কয়েক বছর আগে একটা জমি কিনেছিল দুই লাখ টাকা দিয়ে। এখন তার দাম চার-পাঁচ কোটি টাকা। ওরকম ঘটনা আমার জীবনেও ঘটেছে। ’৭৪ সালে একদিন আমার পাড়ার ছোট্ট এক ছেলে আকবর কবীর। আকবরের বড় ভাই হুমায়ুন ছিল আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। টেবিল চাপড়ে ভালো গান করতে পারত। আমাকে খুব ভালোবাসত। আমিও তার ভালোবাসার পাগল ছিলাম। সেই আকবর এক সকালে বলেছিল, ‘বজ্র ভাই, পাঁচ হাজার টাকা দেন ভূঞাবাড়ির পুকুরটা বিক্রি হচ্ছে ওটা কিনব।’ আমাদের ক্যাশিয়ার সমরকে বলেছিলাম, ওকে পাঁচ হাজার টাকা দিও। পরদিন শুনি টাকা দেয়নি। বলেছিলাম, কী সমর ওকে যে টাকা দেওনি? সে বলেছিল, ‘স্যার, ২৫০ টাকা মায়নায় চাকরি করি। কলেজ জীবনে দুই আনা ভাড়া দিয়ে করটিয়া যেতাম। সেই ৬৪ পয়সার এক টাকার জায়গায় আইয়ুব খানের সময়ে যখন ১০০ পয়সায় এক টাকা হয় তখন ১২ পয়সার জায়গায় ১০ পয়সা বাস ভাড়া দিতাম। বাস কন্ডাক্টর তাই নিত। যাতায়াতে পাঁচ পয়সা ফিরত। কলেজ জীবনে ওই পাঁচ পয়সা বাঁচিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বছরের খরচ চালিয়ে ছিলাম। তাই পাঁচ হাজার টাকা তো আমার কাছে অনেক টাকা। লিখে না দিলে কীভাবে দেই।’ ছোট্ট একটা কাগজে লিখে দিয়েছিলাম, আকবর কবীরকে ৫,০০০ টাকা দেওয়া হোক। লিখিত কাগজ পেয়ে টাকা দিতে সমর পাঁচ মিনিটও দেরি করেনি। সেই টাকা থেকে ৪,৭৫০ টাকা দিয়ে ভূঞাবাড়ির পুকুরের সুরুজের গুমান খার অংশের ৪৭ শতাংশ জায়গা কিনেছিল। ’৯০ এ দেশে আসার পর আমি আরও প্রায় ৪০-৪৫ শতাংশ জায়গা কিনেছিলাম। তার দাম পড়েছিল প্রায় ৪০-৫০ লাখ টাকা। সে জমি এক সময় দুই কোটি পঞ্চাশ লক্ষে আমাদের টাঙ্গাইল জেলা কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলামের কাছে বিক্রি করেছিলাম। বায়নাপত্রও হয়েছিল। ৪০ লাখ টাকা দিয়ে আর দিতে পারেনি। তাই সে নিতে পারেনি। ওকে টাকা ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। সেই জমি পরে ১২-১৩ কোটি টাকায় বিক্রি করেছি। তাই হাত পা চলছে। না হলে হয়তো না খেয়ে মরতে হতো। মানসম্মান থাকত না। ভিক্ষের ঝুলি হাতে নিতে হতো। আমি ব্যবসায়ী নই। ব্যবসায়ী হলে আমার বাবর রোডের বাড়ির উত্তর পাশে যেখানে শামিয়ানা টাঙিয়ে লতিফ ভাইর বউভাতের অনুষ্ঠান হয়েছিল (সেই জায়গা আট হাজার টাকায় বিক্রি করতে আমার পিছে পিছে কত ঘুরেছে। এখন সেই জায়গার দাম ৮০ কোটি হবে। আট হাজার আমার তখনো যেমন ছিল, এখনো আছে)।

যেখানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এসেছিলেন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর ভাই, পূর্তমন্ত্রী সোহরাব হোসেন, যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি, ভারতের প্রথম রাষ্ট্রদূত সুবিমল দত্ত, সহকারী রাষ্ট্রদূত জে এন দিক্ষিত; এমনকি হাই কোর্টের পাগলখানার দুই-তিন শ পাগল নিয়ে নুরা পাগলা এসেছিল। গৌরাঙ্গীর আশরাফ গিরানী ছিল আমার ভক্ত-অনুরক্ত। হুজুর মওলানা ভাসানীও তাকে ভীষণ আদর করতেন, ভালোবাসতেন। গিরানী সব সময় বলত, হুজুর মওলানা ভাসানী আমার আধ্যাত্মিক গুরু, কাজী জাফর আহমদ রাজনৈতিক গুরু, কাদের সিদ্দিকী অস্ত্রগুরু। এক সময় রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে কী করে যেন তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছিল। এমনকি গিরানীর মৃত্যুর পর কাজী জাফর আহমদ যেমন তার কবর জিয়ারতে গেছেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও গেছেন। আমার তো ভক্ত শিষ্য। ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরপর প্রতিবাদে আমার সঙ্গে সে শরিক হয়েছিল। তাই তার কবর জিয়ারতে আমি অনেকবার গেছি। যা বলছিলাম, ৫,০০০ টাকার জমি ১২ কোটি বিক্রি করে আমি বেশ কিছুদিন ভালোভাবেই পেট চালিয়েছি। ড. রাজ্জাক প্রাক্তন কৃষিমন্ত্রী আদব-কায়দা শালীনতায় এক সময় বড় ভালো ছিল। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী তাকে তার কলেজ জীবন থেকেই দুহাতে সাহায্য করেছেন। গতকাল আমার ভাতিজা বাপ্পি এসেছিল। বহু কথার মাঝে চট করে বলে বসে, তোমরা তো ঔরশজাত সন্তানের চাইতে রাজনৈতিক সন্তানদের বেশি গুরুত্ব দেও। কথাটা একেবারে মিথ্যা না। রাজ্জাকের ক্ষেত্রে কথাটা তেমনই চলে। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে লতিফ ভাইর চিঠি নিয়ে সে আমার সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছিল। সেই রাজ্জাকও স্বাধীনতার পর যখন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত তখন টাঙ্গাইল এলেই ইনভেলপে ভরে টাকা দিতাম। যে কথা এক সময় পর্যন্ত বহু জায়গায় সে বলেছে। সেই টাকার পরিমাণ ১০-৫ টাকা থাকত না। অনেক অনেক বেশি থাকত। যা এখন কয়েক লাখ দিয়ে বিচার করলেও সমপরিমাণ হবে কি না বলা যায় না। রাজ্জাক যখন মন্ত্রী হয় তখন লতিফ ভাইও মন্ত্রী। দুজনের নাকি অতটা বনাবনি সদ্ভাব ছিল না। কিন্তু তবু আমি যখন ওর অফিসে গিয়েছিলাম, দরজা খোলা মাত্র সে তার চেয়ার থেকে ছুটে এসে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছিল। এরপর আমি বড় ভাইর মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলাম। দরজা খুলতেই বড় ভাই তরাক করে মন্ত্রীর চেয়ার থেকে উঠে ছুটে এসে দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। কয়েক মিনিট আগে এক মন্ত্রী আমার পা ছুঁয়ে সালাম করেছিল আর সেখানে আমি আরেক মন্ত্রীর পা ছুয়ে সালাম করেছি। বছর কয়েক পরে একদিন বড় ভাইর মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলাম। খুব সম্ভবত মাননীয় মন্ত্রী ফারুক খানের ছোটভাই আরও কে কে বসা ছিলেন। আমি ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে লতিফ ভাই তরাক করে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। পরে বসে কথা বলতে বলতেই বাড়ি থেকে ভাবি খাবার পাঠিয়েছিলেন। তাই বড় ভাই বলেছিলেন, বজ্র, খাবার খেয়ে যা। খাবার সময় রাজা-আমির-ফকির-মিশকিন তেমন খুব একটা পার্থক্য থাকে না। কিছুটা সহজ স্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাই এক সময় মাননীয় মন্ত্রী কর্নেল ফারুকের ভাই বলেছিলেন, লতিফ ভাই কাদের ভাই তো আপনার ছোট। আপনি তাকে দেখে চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন বুঝতে পারলাম না। সে দিন বড় ভাই বড় ভাইয়ের মতো, পিতার মতো বলেছিলেন, আমি কাদের সিদ্দিকীর জন্য, ছোট ভাইয়ের জন্য দাঁড়াইনি। আমি দাঁড়িয়েছি একজন শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠ অনুসারী স্বাধীনতাকে সম্মান জানাতে। সব মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান জানাতে। এই ছিল সে সময়ে আমাদের দিন-রাত্রী। ২০ জানুয়ারি ২০১৪ সালে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর হঠাৎই শওকত মোমেন শাজাহান মারা যায়। মারা যাওয়ার কত হবে সাত-আট ঘণ্টা আগে শাজাহান ফোন করেছিল, স্যার, আর হয়তো বাঁচব না।

আপনাদের সম্পর্কে কত সময় কত কটুকথা বলেছি। কিন্তু সামনে গেলে সন্তানের যত্ন পেয়েছি। বাসাইলের অলিদ আমাকে চেয়ার নিয়ে মারতে এসেছিল। এ অপমান সহ্য করে বাঁচা যায় না। সে বাঁচেওনি। সেই অলিদ এবার তার ছেলে জয়ের নির্বাচনে ভোট চুরিতে প্রধান সেনাপতি ছিল। শাজাহানের লাশ যখন সখিপুরে নিয়ে যাওয়া হয় সেই জানাজায় আমি শরিক হয়েছিলাম। লতিফ ভাই এবং ড. রাজ্জাক দুজনেই লাশের সঙ্গে ছিল। সেই জানাজায় ১০-১৫ হাজার লোকের মাঝেও আমি যেমন লতিফ ভাইকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছিলাম, অস্ত্রগুরু হিসেবে নির্দ্বিধায় রাজ্জাকও আমাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছিল। পরের পর্বে সাইফুজ্জামানের পরের কথা বলব।

লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর