বৃহস্পতিবার, ৭ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

ড. ইমতিয়াজ দোষ স্বীকার করেননি

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

ড. ইমতিয়াজ দোষ স্বীকার করেননি

হিস্টোরিসাইজিং ’৭১ জেনোসাইড নামক এক কলঙ্কিত, বিভ্রান্তি ছড়ানো পুস্তকে ড. ইমতিয়াজ নামক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন শিক্ষক তার বইয়ের ৪০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু ’৭১ সালের ৭ মার্চ ‘জয় পাকিস্তান’ বলে তাঁর ভাষণে সমাপ্তি টেনেছিলেন। তিনি (তখন তার বয়স ১২/১৩-এর বেশি হওয়ার কথা নয়) সেদিন রেসকোর্সে (পরবর্তীতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) উপস্থিত থেকে নিজ কানে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ‘জয় পাকিস্তান’ কথাটি শুনেছেন বলেও তার দাবি লিপিবদ্ধ করেছেন।

শুধু এটিই নয়, তার সেই কুখ্যাত পুস্তকে বঙ্গবন্ধু এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে এমন অনেক মিথ্যা তথ্য সংযোজন করেছেন যার জন্য তথ্যপ্রযুক্তি আইনসহ অন্যান্য আইনে তার সাজা হতে পারে।  উল্লেখযোগ্য যে, সাবা খাট্টাক নামীয় পাকিস্তানি এক প্রভাবশালী বান্ধবীর অনুপ্রেরণায় তিনি এই বিতর্কিত বইটি লিখেছেন, সে কথা তিনি বইতে নিজেই উল্লেখ করেছেন (পৃষ্ঠা VII)। গোটা বইতে তিনি বঙ্গবন্ধুকে শেখ মুজিব বলে উল্লেখ করেছেন, ভুলেও এক জায়গায় বঙ্গবন্ধু শব্দটি উচ্চারণ করেননি, যা থেকে তার বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষ প্রমাণিত।

বইটির কথা প্রকাশ্যে আসার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সৃষ্ট পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিশন এই মর্মে প্রতিবেদন প্রদান করেছিলেন, উক্ত বইয়ে বহু আপত্তিকর, ভ্রান্ত কথাবার্তা রয়েছে এবং সেটি পাওয়ার পর পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ড. ইমতিয়াজকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত ‘গণহত্যা সেন্টার’-এর পরিচালকের পদ থেকে অপসারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আইনের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জনকে সেই পদে প্রতিষ্ঠিত করে।

ড. ইমতিয়াজের বইটির সবকটি পৃষ্ঠা মনোযোগ সহকারে পাঠ করার পর আমি সেসব ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সত্যতা যাচাই করেছি যারা সেদিন বঙ্গবন্ধুর অতি কাছে অবস্থান করে তাঁর ভাষণ শুনেছেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর দেহরক্ষী কর্মকর্তা, মুন্সীগঞ্জের মহিউদ্দিন আহমদ, তার ভিডিওতে ধারণ করা মন্তব্যে চরমভাবে রাগান্বিত হয়ে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু কখনো ‘জয় পাকিস্তান’ শব্দ মুখে আনেননি, যারা এ ধরনের মিথ্যাচার ছড়াচ্ছে, তারা কুলাঙ্গার। দেশের বর্তমান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, তিনি মঞ্চের বেশ কাছে থেকে পুরো ভাষণটি শুনেছেন, বঙ্গবন্ধু কখনো জয় পাকিস্তান বলেননি। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম নামক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ইমেরিটাস অধ্যাপক বলেছেন, তিনি এক বিদেশি সাংবাদিকের অনুবাদক হিসেবে ভাষণস্থলে উপস্থিত ছিলেন, পুরো ভাষণ শুনেছেন এবং তরজমা করেছেন, বঙ্গবন্ধু কখনো জয় পাকিস্তান শব্দ উচ্চারণ করেননি।

এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণ নিয়ে কয়েকটি নির্ভরযোগ্য বই ছাপা হয়েছে, যার একটির মোড়ক উন্মোচন করেছেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এসব বইয়ের কোথাও এমন কথা নেই যে, বঙ্গবন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন। উল্লিখিত পাকিস্তানি মহিলার দ্বারা প্রভাবিত হয়েই, বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার বিষাক্ত ধ্যান-ধারণা নিয়েই যে ড. ইমতিয়াজ এমন কথা লিখেছেন তা সহজেই অনুমান করা যায়। ড. ইমতিয়াজ লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এয়ার মার্শাল এ কে খন্দকার, বিচারপতি হাবিবুর রহমান, কবি শামসুর রাহমানও একই কথা বলেছিলেন। কিন্তু তাদের কেউই যে ময়দানে উপস্থিত ছিলেন না, সে কথা ড. ইমতিয়াজ উল্লেখ করেননি। তারা অন্যের মুখে শুনেছেন, এমনটি বলে পরবর্তীতে ভ্রম সংশোধন করে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়েছেন। মার্শাল খন্দকার খোলামেলাভাবেই বলেছেন, কিছু বিপরীতধর্মী রাজনীতিকের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই, আসল ঘটনা না জেনে তিনি এমনটি বলেছিলেন। তিনি জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। ড. ইমতিয়াজের পক্ষেও সমর্থক জোগাতে অসুবিধা হয়নি। যেই অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্পষ্ট করে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু কখনো জয় পাকিস্তান শব্দ উচ্চারণ করেননি, তিনিও ড. ইমতিয়াজের পক্ষে সাফাই গাইতে পিছপা হননি। বলেছেন, ড. ইমতিয়াজ বইটি অনেক আগে লিখেছেন, এরই মধ্যে তার ধ্যান-ধারণায় পরিবর্তন হয়ে থাকতে পারে বিধায় তাকে ক্ষমা করা উচিত। কিন্তু অধ্যাপক সাহেবের নিশ্চয়ই অজানা নয় যে, ড. ইমতিয়াজ কখনো তার ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেননি। বরং তার দাবিকেই প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে আসছেন। কয়েক সপ্তাহ আগে এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে দেখা হলে তিনি অকপটভাবে আমার কাছে স্বীকার করেন যে, বইটি তিনি কখনো পড়েননি, আরও বলেছেন বইটি পড়ার পর আমার সঙ্গে কথা বলবেন।

দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার উপসম্পাদক সোহরাব হাসান সাহেবও কম যাননি। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়ায় অবাক হওয়ার কিছু নেই, কেননা তার চিন্তাধারার সঙ্গে সবাই পরিচিত। তিনি বলেছেন, ড. ইমতিয়াজকে অপসারণ করার আগে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া একটি আইনি তত্ত্ব। কিন্তু যে ব্যক্তি তার সম্পর্কে উল্লিখিত কথাগুলোর সত্যতা অস্বীকার করেন না, তাকে ন্যাচারাল জাস্টিস তত্ত্বের অধীনে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকে না। এ ব্যাপারে বিলেতের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিচারপতি লর্ড ডেনিং বলেছিলেন, ‘ন্যাচারাল জাস্টিসের তত্ত্বকে অতিরিক্ত প্রসারিত করার সুযোগ নেই।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি, বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতৃবৃন্দসহ অনেকেই ড. ইমতিয়াজের লেখা পড়ে গভীরভাবে সমালোচনামুখর হয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছিলেন। ড. ইমতিয়াজ তার বইতে বঙ্গবন্ধুকে তিরস্কার করে লিখেছেন, (তার ভাষায় শেখ মুজিব) যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধী ছিলেন। বইয়ের ১২ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, জে এন দিক্ষিতের মতে, মুজিব (তার ভাষায়) পাকিস্তান এবং অন্য ইসলামিক দেশসমূহ থেকে বাংলাদেশের পক্ষে স্বীকৃতি আদায়ের জন্যই নাকি (তার ভাষায় মুজিব) যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিপক্ষে ছিলেন। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুই যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আইন প্রণয়ন করেছিলেন, সে কথা কি ড. ইমতিয়াজের মনে ছিল না? একই পৃষ্ঠায় তিনি আরও লিখেছেন, (তার ভাষায় শেখ মুজিব) পুরো নয় মাস অনুপস্থিত ছিলেন বলে গণহত্যার বিষয়টি প্রয়োজনীয় গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করা হয়নি। লিখেছেন, এ বিষয়ে (তার ভাষায় শেখ মুজিব) পুরোপুরি অন্ধকারে ছিলেন। গণহত্যা-পরবর্তী প্রশ্নগুলো (তার ভাষায় শেখ মুজিবের) কাছে দ্বিতীয় ধাপে নেমে গিয়েছিল। (শেখ মুজিব) তাঁর দলের চাটুকারদের পরামর্শ দ্বারা প্রভাবিত হতেন। তার বইয়ের ১৩ পৃষ্ঠায় ড. ইমতিয়াজ লিখেছেন, (তার ভাষায় শেখ মুজিব) পাকিস্তানে আটকে থাকা বাঙালিদের ফেরত পাওয়ার জন্য স্থায়ীভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার ভাষায় (শেখ মুজিবুর রহমান) নাকি হাসকার সাহেবকে বলেছিলেন, সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার মানে হবে শক্তি এবং সময়ের অপচয়। বইটির ১৫ পৃষ্ঠায় লেখনীর মাধ্যমে তিনি ৩০ লাখ শহীদের হিসাব নিয়ে এমন প্রশ্ন তুলেছেন, যা অতীতে খালেদা জিয়া তুলেছিলেন। শহীদদের সংখ্যার ব্যাপারে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য উল্লেখ করে প্রশ্ন করেছেন, ‘আসলেই কি ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়েছিলেন?’ তার অন্যতম জঘন্য লেখনী স্থান পেয়েছে ৪১ পৃষ্ঠায়, যেখানে তিনি দাবি করেছেন যে বাঙালিরা ৫০ হাজারের মতো বিহারিকে ‘গণহত্যা’ করেছে, যারও বিচার হওয়া উচিত।

বইয়ের ১১ পৃষ্ঠায় তিনি জনগণকে বিভ্রান্ত করে লিখেছেন, পাকিস্তানি সৈন্যরা শুধু ভারতীয় বাহিনীর কাছেই আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন, তারা ভারতীয় এবং বাংলাদেশি মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তার দাবি এই যে, বাংলাদেশি সৈন্যরা ভারতীয় বাহিনীর নির্দেশে, তাদের অধীনস্থ হয়ে, তাদের ইচ্ছা অনুযায়ীই যুদ্ধ করেছেন। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অবশেষে ভারত-পাকিস্তান বিষয়ে পরিণত হয়েছিল (পৃষ্ঠা ১১)।

মারাত্মক ভুলের বশবর্তী হয়ে তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জাতিগত, ভাষাগত, ধর্মগত কোনো ইস্যু ছিল না। কেননা পাকিস্তানি এবং বাঙালিদের মধ্যে ভাষাগত, গোষ্ঠীগত এবং ধর্মগত কোনো বিতর্ক ওঠেনি। এই দাবির পক্ষে তিনি উদ্ভট যুক্তি উপস্থাপন করে লিখেছেন, উর্দু এবং বাংলা উভয় ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় থাকায় ভাষা নিয়ে কোনো বিভাজন ছিল না, দেশটির দুই অংশের মানুষের মধ্যে আন্তঃগোষ্ঠীয় বিবাহ প্রচলিত থাকায় এটা বলা যায় না যে, তাদের মধ্যে গোষ্ঠীগত পার্থক্য ছিল। তার মতে, হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিল নেহাতই রাজনৈতিক কারণে। তার এই দাবির অর্থ বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে যে হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিল, তা ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশনের সংজ্ঞায় পড়ে না, কেননা সে সংজ্ঞা অনুযায়ী একটি গোষ্ঠী দ্বারা আরেক গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ চালাতে হয় আর তাদের বিভাজন হতে হয় জাতিগত, গোষ্ঠীগত (এথনিক), বর্ণগত অথবা ধর্মগত কারণে। ১৯৭১-এর হত্যাকান্ডের কোনোটিই না থাকলে তা গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে না, আর তাই যে ব্যক্তি একসময় গণহত্যা কেন্দ্রের পরিচালক ছিলেন, তিনি এমন উদ্ভট কথা বললে আমাদের দেশে চালানো গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া দুষ্কর হতে পারে বৈকি, যার জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ জাতিসংঘের ঐতিহ্যভুক্ত হয়েছে। এখন যদি জাতিসংঘ মনে করে, যে ব্যক্তি গণহত্যা সেন্টারের পরিচালক ছিলেন, তিনি ৭ মার্চের ভাষণ অন্য রকম ছিল বলে দাবি করেন, তাহলে জাতিসংঘও বিভ্রান্ত হতে বাধ্য।

ড. ইমতিয়াজ এও লিখেছেন, নির্বাচনে জেতার জন্য আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে জামায়াতের সঙ্গে কৌশলগত আঁতাত করেছিল (পৃষ্ঠা ১৬)।

পুরো বইটিতে তার লেখায় পাকিস্তানি ইচ্ছারই প্রতিফলন পরিলক্ষিত, যা থেকে ধারণা করা অযৌক্তিক হবে না যে, তিনি সেই পাকিস্তানি প্রভাবশালী মহিলার নির্দেশনা অনুযায়ীই সবকিছু লিখেছেন,  যেমনটি পাকিস্তানিদের দ্বারা বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়ে লিখেছিলেন শর্মিলা বসু নামক এক মহিলা।

আমাদের দাবি, ড. ইমতিয়াজ যদি তার ভুল এবং দোষ স্বীকার করে, জাতির কাছে অনতিবিলম্বে ক্ষমা প্রার্থনা করে, দেশে এবং বিদেশে প্রচারিত বিভ্রান্তিকর তথ্য মুছে ফেলার চেষ্টা না করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ফৌজদারি মামলা দায়ের করা বাঞ্ছনীয়। তার লেখনী দেশের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে বৈকি, আর সেই বিপদ থেকে মুক্তির জন্যই তার দোষ স্বীকার করা অপরিহার্য।

                লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

সর্বশেষ খবর