শুক্রবার, ৮ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

কেন এই রাজনৈতিক শূন্যতা

মেজর আখতার (অব.)

কেন এই রাজনৈতিক শূন্যতা

বিএনপিসহ কতিপয় বিরোধী দলের নির্বাচন প্রতিহত যখন বর্জনে রূপান্তরিত হয়েছিল তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে বিরোধী দল আর রাজনীতির মাঠে টিকে থাকতে পারবে না। রাজনীতি পুরোপুরি চলে গেল সরকারের শক্ত মুঠির মধ্যে। যে কোনো সরকার নির্বাচনের প্রাক্কালে খুবই দুর্বল ও নমনীয় থাকে। তখন প্রশাসন দোদুল্যমান হয়ে যায়। প্রশাসনে ওপর থেকে চাপ কমে যায়। নির্বাচনকালে সরকারবিরোধী রাজনীতি খুবই তেজস্বী ও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। তাই নির্বাচন যদি সঠিক ও সুষ্ঠু না হয় তাহলে সরকার হালে পানি পায় না। সরকার গঠন তো দূরের কথা সংসদকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যায়। নির্বাচন-উত্তর সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এবারের একতরফা নির্বাচনের পরে জনগণের প্রত্যাশা ছিল বিরোধী দল সংসদ ও সরকার গঠনে রাজধানীতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখাবে। এবারের নির্বাচনে জনগণ ভোট কেন্দ্রে না গিয়ে বিরোধী দলকে তাদের মনোভাব ও সমর্থন যথেষ্ট পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিল। ভোট কেন্দ্রে জনগণের পরিষ্কার অনুপস্থিত দেখে সরকার ও নির্বাচন কমিশন উভয়েই যথেষ্ট ভড়কে গিয়েছিল। বিশেষ করে নির্বাচনের আগের সপ্তাহে জনগণ যেভাবে মাঠে নেমে আসছিল তা সরকার প্রধানকে যথেষ্ট ভীতির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। নির্বাচনের শেষ সপ্তাহে যেভাবে সরকার প্রধান ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচন প্রচার-প্রচারণায় গুরুত্ব দিয়েছিলেন তার বিশ্লেষণ করলেই আমার বক্তব্যের সারবত্তা বেরিয়ে আসবে।

সব বিরোধী দলের নির্বাচন-উত্তর কার্যক্রম দেখে সরকারের ব্লাড প্রেসার একদম স্বাভাবিকে চলে আসে। তারপরে শুরু হয় দেশ-বিদেশ থেকে অভিনন্দনের প্রতিযোগিতা। চলে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের অভাবনীয় চিঠি যা সরকারের আস্থা ও আত্মবিশ্বাস একদম আকাশে উঠিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, চটজলদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের তিন সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধি দলের সফর সরকারের প্রত্যয় ও তাদের দৃঢ়তা আরও বাড়িয়ে দেয়। প্রতিনিধি দলের সফরের আগেই অত্যন্ত পরিকল্পিত ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে জামিন দিয়ে দেওয়া হয় বিএনপির নেতাদের। বিশেষ করে ওপর স্তরের দুই নেতাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের তিন সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধি দলের সফরের আগে জেল থেকে ছেড়ে দিয়ে প্রতিনিধি দলের সৌজন্য সভা বা তাদের সঙ্গে মিলন দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের সফর শুরু হয়। তারপরও যদি সরকারের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সম্পর্ক কী এবং কেমন তা নিয়ে যদি কেউ কোনো নেতিবাচক বক্তব্য দিতে চান তাহলে তাকে বা তাদের অর্বাচীন জ্ঞানপাপী বলা ছাড়া অন্য কোনো যথোপযুক্ত শব্দ আমার জানা নেই।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার বর্তমান সরকারের সঙ্গে আগামী পাঁচ বছর সুসম্পর্ক রেখে ব্যবসায়িক স্বার্থে একযোগে কাজ করার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যে নিয়ে নিয়েছে তাতে কারও মনে সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়িক স্বার্থের সঙ্গে ভারত, ইউরোপিয়ান ও ব্রিটিশদেরও কোনো সংঘাত নেই। তারাও আগ থেকেই বর্তমান সরকারের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যেই কাজ করে আসছে এবং আগামীতে কাজ করতে কোনো বাধাও তারা দেখতে পাচ্ছে না। কিছুটা সমস্যা হয়তো হতে পারে চীনকে নিয়ে। যদিও চীনের ব্যবসায়িক স্বার্থের সঙ্গে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন- কারও তেমন কোনো সংঘাত নেই। তবে চীনের সঙ্গে সবার রাজনৈতিক সংকট রয়েছে তা আবার বাংলাদেশের ভূরাজনীতিতে তত বড় কোনো সংকট নয় বলেই মোটামুটি দৃশ্যমান। আবার রাশিয়াও সরকারের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে রেখেছে। সম্প্রতি জার্মান সফরে গিয়ে ইউক্রেন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যে আন্তরিক সভা প্রধানমন্ত্রী করে এসেছেন তা সরকারের সফল পররাষ্ট্রনীতি ও উচ্চমার্গের কূটনীতি হিসেবেই বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে। তার ওপরে হামাসের ওপর ইসরায়েলের জঘন্যতম হামলাকে গণহত্যা আখ্যায়িত করে সরকার আরব বিশ্বে একটি বিশেষ অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। তুরস্ক, ইরান, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, আরব আমিরাত- সবার সঙ্গে বর্তমান সরকারের গলায় গলায় ভাব। রোহিঙ্গা নীতির কারণে জাতিসংঘও সরকারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে। এককথায় বলা যায়, বর্তমান সরকার বিশ্বের সবার কাছে ‘গুড বয়’।

সরকারের সামনে বর্তমানে তেমন কোনো সংকট বা চ্যালেঞ্জ দেখা যাচ্ছে না যদি এই বছরের এপ্রিল ও মে মাসে ভারতের নির্বাচনে গণেশ না উল্টে যায়! সম্প্রতি ভারতে একটি জমকালো বিয়ে ভারতের সাধারণ জনগণের মধ্যে যথেষ্ট বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে যা আগামী নির্বাচনে বিজেপির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। তাছাড়া লাগাতার কৃষক আন্দোলনও বিজেপিকে বেকায়দায় ফেলতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে বিজেপির অতিমাত্রার হিন্দুত্ববাদ। ভারতের ইতিহাসে দেখা গেছে, ভারত সরকার যত বেশি হিন্দুত্ববাদে জোর দিয়েছে তত বেশি সাধারণ জনগণ হিন্দুত্ববাদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেছে। এবারও এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আগামী নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাইডেন সাহেবের ভরাডুবিও নিশ্চিত। আগামীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন হলে বিশ্বে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে যা থেকে বাংলাদেশও বাইরে থাকতে পারবে না। পরিবর্তিত প্রেসিডেন্ট যদি নির্বাচিত হতে পারে তাহলে বাংলাদেশের ব্যাপারে অবশ্যই নীতি পরিবর্তন করবেন। তাছাড়া মিয়ানমার নীতিতেও পরিবর্তিত প্রেসিডেন্ট নতুন নীতি গ্রহণ করতে এবং এই এলাকায় একটি যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারে। কাজেই খুব স্পষ্টভাবেই বলা যায়, নভেম্বর উত্তর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তিত প্রেসিডেন্ট অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধে যেতে বাধ্য করতে পারে। সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে আরও আধুনিকীকরণ, অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিতকরণ এবং একটি শক্তিশালী সশস্ত্রবাহিনী গড়ে তুলতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে আসতে পারে যা পরবর্তীতে সরকারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

যাই হোক, বর্তমানে বাংলাদেশে সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। সরকার কোনো রাজনৈতিক সংকট দেখতে পাচ্ছে না এবং হতেও দেবে না। রাজনৈতিক কর্মকান্ড যা হবে তা সরকারি দল ঘিরেই হবে। সরকার কোনো ধরনের রাজনৈতিক বিরোধিতা করার সুযোগ দেবে না। সম্প্রতি সরকার স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষ থেকে কয়েকজন নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত করেছে। সরকার ইচ্ছা করলে প্রতি ছয়জন স্বতন্ত্র সদস্যের পক্ষ থেকে একজন করে নারী সংসদ সদস্য নিতে পারত। কিন্তু একজনকেও এভাবে নেওয়া হয়নি। তার খুব সহজ মানে হলো- সরকার প্রধান সংসদে কোনো বিরোধী বীজও রাখবেন না। এই যদি হয় রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দর্শন তাহলে সেখানে কর্মতৎপর বা শক্তিশালী বিরোধী দলের চিন্তাই করা যায় না। আমি জানি না আমাদের বিরোধী দলের নেতারা রাষ্ট্রের এই পরিষ্কার দর্শন বোঝেন কি না বা তা বিবেচনায় নিয়ে রাজনীতি করেন কি না! তবে আমি মনে করি বিরোধী দলগুলোকে রাষ্ট্রের এই দর্শন বিবেচনায় নিয়ে রাজনীতিতে এগোনো উচিত।

দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ ও বৈদেশিক রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ ও ভূরাজনীতির প্রেক্ষপটে বিরোধী দলগুলোর বিশেষ করে বিএনপির রাজনীতিতে নতুন করে আবেগ, বেগ, রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতামূলক একটি রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠা করা উচিত যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের চলমান দর্শনের বিপক্ষে বিরোধী শক্তি শক্ত অবস্থান নিয়ে দাঁড়াতে পারে। সরকারের পাতানো তথাকথিত আন্দোলনের কর্মসূচি মূলত সরকারকেই আরও বাড়তি সুযোগ করে দিবে এবং ক্রমান্বয়ে বিরোধী দল নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। আমার স্পষ্ট সুপারিশ থাকবে বিরোধী দল আগামী তিন বছরের জন্য তথাকথিত আন্দোলনের মাঠ থেকে একদম হারিয়ে যাবে। আন্দোলন শব্দটিই কেউ উচ্চারণ করবে না। আগামী তিন বছরে দলকে একদম তৃণমূল পর্যায় থেকে ঢেলে সাজাবে। দলকে তিনটি স্তরে ভাগ করতে হবে।

১. প্রথম ভাগে থাকবে স্বাধীনচেতা ১৫ থেকে ২১ জন দূরদর্শী চিন্তাবিদ, প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ, স্বনামখ্যাত অর্থনীতিবিদ, পেশাজীবী, শিক্ষক, সচিব পর্যায়ের সাবেক সিভিল ও মিলিটারি আমলা (পুলিশসহ), রাষ্ট্রদূত, বড় ব্যবসায়ী, ব্যাংকার এবং এনজিও নেতা। তারা দলের নীতিনির্ধারক বা থিংকট্যাংক বা দলের সর্বোচ্চ ফোরাম হিসেবে কাজ করবে। এ কমিটির নাম হবে দলের সর্বোচ্চ কমিটি। দলের প্রধান তাদের মধ্যে থেকে হবে এবং সব সিদ্ধান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত অনুযায়ী নিতে হবে। তাদের স্থায়ীকাল হবে পাঁচ বছর বা জাতীয় নির্বাচন হওয়ার শেষ ছয় মাস, যেটার স্থায়ীকাল কম হবে। কোনো জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক ভরাডুবি হলে দলের প্রধানসহ কমিটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

২. জাতীয় নির্বাহী কমিটি। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর বা জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে প্রকাশ্য সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত হবে।

৩. উপজেলা কমিটি। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর বা জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে প্রকাশ্য সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত হবে।

এই সুপারিশটি আমার একান্ত ব্যক্তিগত। তবে আমাদের মনে বাখতে হবে যদি সংগঠন আমাদের শক্তিশালী না হয় তাহলে রাজনীতিতে আমরা টিকে থাকতে পারব না।

                লেখক : স্বতন্ত্র ভাবাপন্ন

সর্বশেষ খবর