শুক্রবার, ৮ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

জিকিরের শব্দে শয়তান পলায়ন করে

আল্লামা মাহ্‌মূদুল হাসান

পূর্ববর্তী বুজুর্গানে দীন বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে তাকদিরে নির্ধারিত মৃত্যুবরণ কামনা করতেন। তার কারণ হলো- হাদিস শরিফে এসেছে, এ সময় ইন্তেকাল হলে কবরের সওয়াল-জওয়াব আছান হয়। এখন প্রশ্ন হলো, হাদিসের সু-সংবাদ কাদের ব্যাপারে? আল্লাহ-রসুলের অন্য সব আদেশ-নিষেধ অমান্য করে শুধু এই সুসংবাদের রাতে মৃত্যুবরণ করলেই কী কবরের সওয়াল-জওয়াব সহজ হয়ে যাবে? আজাব মাফ হয়ে যাবে? আসলে হাদিসের মর্মার্থ হলো, ওই ব্যক্তি নাফরমান হবে না, বরং রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরিকা অনুযায়ী আল্লাহর ফরমাবরদার হবে। এ কথার দলিল হলো কুরআন-হাদিসের বহু সংখ্যক আয়াত ও বাণী। এ রাতে যারা খালেস নিয়তে ইবাদত করে আল্লাহ পাক তাদের বিগত সপ্তাহের গুনাহ মাফ করে দেন এবং আগত সপ্তাহের আমল করা তাদের জন্য সহজ করে দেন। মানুষ যেমন অপেক্ষায় থাকে শবেকদর, শবেবরাতের জন্য, ঠিক তেমনি আল্লাহর ওলিরাও শুক্রবারের রাতের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। অন্য রাতে তো তারা তাহাজ্জুদ পড়েনই কিন্তু এ রাতের বিশেষ ফজিলতের জন্য তারা বেশি আগ্রহী হয়ে থাকেন।

মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, মাদরাসার ছাত্র-উস্তাদদের জন্য প্রয়োজন কমপক্ষে শুক্রবারের রাতে বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগি করা। শুক্রবার সরকারি ছুটি থাকার কারণে মানুষ এ দিনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কর্মসূচি ঠিক করে রাখে আগে থেকেই। এমন মহা ফজিলতের দিনে মানুষ শরিয়তবিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত হয় এবং আপন খালিক-মালিকের স্মরণ থেকে চরমভাবে গাফেল হয়ে যায়। গান-বাদ্য ও সিনেমার আয়োজন বেড়ে যায়। বনভোজনে গিয়ে নাচ-ফুর্তি, বেপর্দেগি ইত্যাদি নানা ধরনের নফরমানিতে মশগুল হয়। বিবাহের অনুষ্ঠানে গিয়ে ভিডিও ছবি তোলে, গায়রে মাহরাম মহিলাদের সঙ্গে প্রকাশ্যে আনন্দ-উল্লাস করে।

মাদরাসার ছাত্ররা এ দিনে বাসাবাড়িতে চলে যায়। বাসায় গিয়ে অনেকে নামাজ পড়ে না। অনেকের বাসায় টিভি থাকে। তাতে নাটক-সিনেমা, খেলাধুলা দেখে পবিত্র দিনটি পার করে। এক সপ্তাহে আমল করে যে সওয়াব অর্জন করেছিল তা বাসাবাড়িতে গিয়ে বরবাদ করে আসে। শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ার কারণে দুনিয়ার কাজকর্ম বন্ধ হয় না বরং আরও বেড়ে যায়। তবে ইবাদত বন্দেগির কাজ কমে যায়।

আমার মজলিশে যারা আসেন আমার মনে চায় তাদের প্রশ্ন করতে যে, কারা কারা গত রাতে তাহাজ্জুদ পড়েছেন; কিন্তু অনেকেই তো পড়েননি, সুতরাং প্রশ্ন করলে তাদের দোষ মানুষের সামনে প্রকাশ হয়ে যাবে, তাই প্রশ্ন না করাই উত্তম। যারা পড়েননি তাদের উচিত ওয়াদা করা যে, কমপক্ষে শুক্রবারের রাতে তাহাজ্জুদ পড়ব। অনেকে ওয়াদার সঙ্গে ‘ইনশা আল্লাহ’ বলেন। ‘ইনশা আল্লাহ’তেও প্যাঁচ থাকে। যেমন অনেকে রাতে তাহাজ্জুদ পড়বে বলে ‘ইনশা আল্লাহ’ বলে ঘুমায়। যদি উঠতে না পারে তাহলে বলে যে, আল্লাহ চাননি তাই উঠতে পারিনি।

হজরত বেলাল (রা.)-এর জীবনেও ‘ইনশা আল্লাহ’ না বলার এক ঘটনা আছে। একবার রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষ রাতে সফর করে যখন মদিনার প্রায় নিকটবর্তী স্থানে আসলেন তখন ক্লান্তির কারণে আর সামনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। সঙ্গে হজরত বেলাল হাবশি (রা.)-সহ অনেক সাহাবি ছিলেন। এদিকে নবীজির অভ্যাস ছিল, কোনো জায়গা থেকে রাতে মদিনায় ফিরলে বাড়িতে যেতেন না, বরং রাস্তার কোনো এক জায়গায় তাঁবু করে রাত কাটিয়ে দিতেন। তার কারণ হলো রাতে সবাই ঘুমিয়ে থাকে। এ সময় বাড়িতে গেলে স্ত্রী-সন্তানদের ঘুম ভেঙে জাগাতে হবে, এতে তাদের কষ্ট হবে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের এতটুকু কষ্ট দিতে রাজি ছিলেন না। মহিলারা স্বামীর অনুপস্থিতিতে সাধারণ অবস্থায় থাকে। অর্থাৎ তাদের শরীরে কাপড় থাকে অনুন্নত, ময়লাযুক্ত। যা দেখে স্বামীর খারাপ লাগতে পারে, স্ত্রীও বিব্রতবোধ করে। এ কারণে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে বাড়িতে ফিরতেন না। আমরা কিন্তু এর বিপরীতটা করি। আমরা রাতে স্ত্রীর অবস্থান সম্পর্কে সংবাদ নিতে যাই চুপে চাপে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা করতেন না। এটা করা সম্পূর্ণ নিষেধ। কারণ প্রত্যেকেরই স্বাধীনতা রয়েছে। যখন তখন না বলে যাওয়া ঠিক না। আগে সংবাদ পাঠিয়ে এবং কাছে এসে সালাম করে ঘরে যাওয়া উচিত। এখন যেহেতু অত্যাধুনিক যুগ তাই মোবাইল করে যাওয়াই উত্তম।

বলছিলাম বেলাল (রা.)-এর ঘটনার কথা। হযরত বেলাল হাবশি (রা.) বলেন, ওই দিন এমন মজার ঘুম চোখে এসেছিল যে, মনে হয় জীবনে কোনো দিনও এমন ঘুম আসেনি। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমতাবস্থায় সাহাবিদের লক্ষ্য করে বললেন, রাত তো সামান্যই বাকি আছে, এখন একসঙ্গে সবাই ঘুমালে ফজর কাজা হয়ে যেতে পারে। তাই তোমাদের মধ্যে কেউ কি আছে, যে জাগ্রত থেকে শেষ রাতে আমাদের নামাজের জন্য জাগিয়ে দেবে? হজরত বেলাল হাবশি (রা.) ‘ইনশা আল্লাহ’ না বলে বললেন, ইয়া রসুলাল্লাহ! আমি শেষ রাতে জাগিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছি। অতঃপর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবিদের নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। এদিকে হজরত বেলাল (রা.) জোর করে চোখ খোলা রেখেছেন। ঘুমের চাপ কতক্ষণ সহ্য করা যায়! জাগ্রত থাকতে থাকতে বেলাল (রা.)-এর শরীরে ক্লান্তি এসে গেল। তিনি ক্লান্তি দূর করার উদ্দেশ্যে গাছ বা কিছু একটার সঙ্গে হেলান দিয়ে বসলেন। ব্যাস ফজর শেষ হয়ে পূর্বাকাশে সূর্য উঁকি দিল। হঠাৎ এক সাহাবি সূর্যের তাপে জেগে গেলেন এবং উঠে দেখেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও ঘুমিয়ে আছেন। তিনি জাগাতে সাহস পাচ্ছিলেন না। তাছাড়া রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঘুমের মধ্যে ডাক না দেওয়ারই নিয়ম ছিল। একে একে চতুর্থ নম্বরে হজরত ওমর (রা.) জাগ্রত হয়ে দেখলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘুমিয়ে আছেন। তিনি ডাক দেওয়ার কোনো পন্থা না পেয়ে উচ্চৈঃস্বরে জিকির করতে শুরু করলেন। একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত ওমর (রা.)-কে জিজ্ঞাসাও করেছিলেন, অন্য সময়ের চেয়ে তুমি শেষ রাতে এত আওয়াজে কেন জিকির কর? হজরত ওমর (রা.) উত্তর দিলেন, যারা ঘুমিয়ে থাকে তাদের জাগানোর জন্য। তাছাড়া উচ্চৈঃস্বরে জিকির করলে আশপাশের শয়তান পর্যন্ত পলায়ন করে।

লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ

সর্বশেষ খবর