শুক্রবার, ৮ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

বন্ধ হোক সড়ক বিভীষিকা

মো. রশীদুজ্জামান রুনু

বন্ধ হোক সড়ক বিভীষিকা

চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণেই প্রতিদিন প্রতিক্ষণ সড়কে এই অনাকাক্সিক্ষত মর্মান্তিক মৃত্যুর স্রোত বেড়েই চলেছে। এই নারকীয় অবস্থা থেকে বাঁচতে কারওরই যেন সামান্যতম প্রচেষ্টাও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। নিরাপদ সড়কের আকাক্সক্ষার আন্দোলনে আংশিকভাবে হলেও সফল একজন অ্যাক্টিভিস্ট, রাষ্ট্রীয় একুশে পদকপ্রাপ্ত সমাজসেবী, অভিনয়-শিল্পী ইলিয়াস কাঞ্চন সম্প্রতি অভিমান-ক্ষোভে বলেছেন, তাঁদের নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠনটি আর সড়ক দুর্ঘটনার প্রাণহানি ও আহত-পঙ্গুত্ববরণের কোনো পরিসংখ্যান উপস্থাপন করবে না। এর পেছনে মূল কারণটি সম্ভবত এই- সরকার-পক্ষ আর কয়েকটি সড়ক-নিরাপত্তা আন্দোলনের সংগঠন প্রতিবছর সড়ক-মহাসড়কে অপঘাতে যেসব প্রাণহানি, আহত-হওয়া পঙ্গুত্ববরণ ও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির যেসব পরিসংখ্যান দিচ্ছেন তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অর্থাৎ তারা নিজ নিজ মতলববাজির লক্ষ্যে এসব করছেন; তাই এসবের ওপরে দেশবাসীর আস্থা কমে গেছে।

সড়কের অনাকাক্সিক্ষত দুঃখজনক দুর্ঘটনাগুলো কমিয়ে আনতে সবার আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এবং প্রশাসন-তথা বিচার বিভাগকে সড়কের শৃঙ্খলা শতভাগ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সমস্ত আইন ও বিধি-বিধান মেনে প্রতিটি অপরাধীকে (আইন লঙ্ঘনকারীকে) উপযুক্ত শাস্তিদানের আওতায় আনতে হবে। সড়কের আইন ও বিধিসমূহ অমান্য করার প্রবণতা রোধে পুলিশ বিভাগের প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে- সড়কে চলাচলকারী প্রতিটি নাগরিক মানে পথচারী, গাড়ি-যাত্রী, গাড়িচালক, গাড়িমালিক এবং সড়ক-নির্মাণকারী ঠিকাদার ও সরকারি-প্রকৌশলীদের তাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে অবহেলার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে জরিমানা, আইনের বিধানমতো উপযুক্ত চার্জশিট দিয়ে এবং গ্রেফতার করে উপযুক্ত বিচার-কর্মকর্তার আদালতে বিচারের আওতায় আনার জন্য হাজির করা। যেহেতু এই রাষ্ট্র ও সমাজে সুশাসনের প্রচ- অভাব, তাই সড়কের আইন লঙ্ঘনের দায় নিয়ে কোনো নাগরিককে বিচারের মুখোমুখি করতে কেউই এগিয়ে আসেন না এবং এর পরিণতিতে বাংলাদেশের সব সড়কে অবিরাম আইন লঙ্ঘন চলছে এবং প্রাণহানিসহ সব অনাচার, নৈরাজ্য চলছে। বলা যায়, অপরাধজগতের মাফিয়া আখড়ায় যেমনটা চলে ঠিক তেমনটাই যেন চলছে। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়কালেও দেখা গেছে, বছরে সারা দেশে সড়কের অপঘাতে প্রাণহানি ছিল প্রায় ১ হাজার। পরবর্তী দুই দশকে তা বেড়ে এখন কমপক্ষে ৯ হাজার। আর আহত হওয়া ও পঙ্গুত্ববরণ করেন প্রায় লাখখানেক মানুষ। এর ফলে বছরের আর্থিক ক্ষতি কমপক্ষে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার ওপরে। কিন্তু সেসব নিয়ে নাগরিক সচেতনতা মোটেই বাড়ছে না। সড়কের নৈরাজ্যে যার স্বজন মারা যায়, যে পরিবারের একমাত্র আয়-উপার্জনকারী ব্যক্তিটির প্রাণহানি পরিবার-পরিজনকে রাস্তায় বসিয়ে ছাড়ে, সংবাদপত্রে বা টেলিভিশন মিডিয়ায় হিউম্যান-স্টোরি প্রকাশিত হয়, নাগরিক-সমাজে শোকাবহ পরিবেশ সৃষ্টি হয়, কখনো কখনো প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল হয়, শহর-নগরের রাজপথে কিছু গাড়ি পোড়ানো, ভাঙচুর চলে আর দিনের পর দিন হা-হুতাশ চলে। কিন্তু আসল ক্ষত ও ক্ষতি কি মুছে ফেলা যায়! না, যায় না কোনোদিনই। এই সর্বনাশা ক্ষত শুকাবার নয় কোনো দিনই। 

আর আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক দুনিয়ার এই যুগে সব দেশেই সরকার তথা নাগরিক সমাজ যখন সড়কের নৈরাজ্যে সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা কায়েমে যারপরনাই প্রচেষ্টা চালিয়ে অপঘাত-মৃত্যু ও পঙ্গুত্ববরণ কমিয়ে আনার যুদ্ধ চালাচ্ছে তখন আমাদের বাংলাদেশ সড়ক ব্যবস্থাপনায় আরও বেশি নৈরাজ্য-দশায় নিয়ে যাচ্ছে- যার পরিণাম সড়কে এইসব অপ্রয়োজনীয় প্রাণহানি আর পঙ্গুত্ববরণ। সরকার সড়কের নৈরাজ্য দূর করতে পারে পুলিশি ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা কায়েম করার মাধ্যমে। প্রথমত, পুলিশ বিভাগের মাধ্যমে সারা দেশে অন্তত গাড়ি-চালনায় দক্ষ গাড়িচালক (সব ধরনের গাড়ি, প্রাইভেট কার ও জিপ, বাস, ট্রাক, ভারী লরি ইত্যাদি) তৈরি করতে সে কাজে দরকার কমপক্ষে ৫০টি অটো/ ভেহিক্যাল ড্রাইভিং ট্র্রেনিং ইনস্টিটিউট পরিচালনা। প্রতিবছর এসব ইনস্টিটিউট থেকে ন্যূনতম স্কুল ফাইনাল (মানে এসএসসি) উত্তীর্ণ ৫ লাখ যুবক ও যুবা-নারীকে দক্ষ গাড়ি ড্রাইভারের প্রশিক্ষণ দিয়ে উপযুক্ত ড্রাইভার তৈরি করতে হবে। এসব ইনস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ না করে কেউ অটো-ভেহিক্যাল ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবেন না। এমন কি অধিক-বয়স্ক কেউ নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে চাইলে, মানে রাস্তায় গাড়ি ড্রাইভিং করতে চাইলে এই ইনস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে পাশ করা বাধ্যতামূলক। অত্যন্ত উঁচু-স্তরের প্রশিক্ষকদের দিয়ে, প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সদস্যদের দিয়ে এসব প্রশিক্ষণকাজ চালানো দরকার।

                লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর