শনিবার, ৯ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

কত প্রিয় মুখ

ইমদাদুল হক মিলন

কত প্রিয় মুখ

বছর দুয়েকের মধ্যে চারটা গল্প লিখলাম ‘অমৃত’ পত্রিকায়। ‘জোয়ারের দিন’ গল্পটি খুবই প্রশংসিত হলো। তত দিনে আমি উন্মাদের মতো লিখতে শুরু করেছি। প্রাপ্তবয়স্কদের পত্রিকাসহ হেন পত্রিকা নেই যেখানে লেখা ছাপাবার জন্য ছুটছি না। ছাপা হচ্ছেও। প্রতি সপ্তাহে দুটো তিনটে, চারটা পাঁচটা গল্পও ছাপা হয়। দেশেই এভাবে লেখা ছাপা হচ্ছে, ফলে পশ্চিমবঙ্গের কথা ভুলে গেলাম। ‘অমৃত’ পত্রিকার কথা আর মনেই রাখলাম না।

এসব ’৭৩ থেকে ’৭৫ সালের ঘটনা। তার পঁচিশ ছাব্বিশ বছর পর নতুন করে কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ হলো। যোগাযোগ করিয়ে দিলেন বাংলা ভাষার অতি জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার। তিনি ঢাকায় এসেছিলেন ’৯০/’৯১ সালের দিকে। পার্ল পাবলিকেশন্সের আলতাফ হোসেন সাহেবের সঙ্গে সমরেশদার খুবই ঘনিষ্ঠতা। আলতাফ হোসেন সাহেবের ডাকনাম মেনু মিয়া। আমি ডাকতাম মিনুভাই। অত্যন্ত বড় হৃদয়ের মানুষ। একুশে বইমেলায় সমরেশদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন মিনুভাই। কলকাতায় ফিরে গিয়ে সমরেশদা ‘বর্তমান’ পত্রিকার সঙ্গে বাংলাদেশের দুজন লেখক নিয়ে কথা বললেন। একজন হুমায়ূন আহমেদ, আরেকজন আমি।

‘বর্তমান’ পত্রিকাটির মালিক প্রকাশক ভারতবর্ষ কাঁপিয়ে দেওয়া সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকাতে কাজ করতেন। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে নিজে পত্রিকা করলেন ‘বর্তমান’। পত্রিকা ব্যাপক জনপ্রিয় হলো। পত্রিকাটির স্লোগান ‘যে পত্রিকা ভগবান ছাড়া কাউকে ভয় করে না’। ‘আনন্দবাজার’ গ্র“পের মহারথীদের অনেকের ছেলেমেয়েই ‘বর্তমান’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হলো। একটি সাপ্তাহিক পত্রিকাও প্রকাশ করল ‘বর্তমান’। নাম ‘সাপ্তাহিক বর্তমান’। সেটিও খুব জনপ্রিয় হলো। দৈনিক আর সাপ্তাহিকে যুক্ত হলো সন্তোষকুমার ঘোষের কন্যা ও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ছেলের বউ কাকলী চক্রবর্তী, গৌরকিশোর ঘোষের কন্যা শাহানা নাগচৌধুরী, বিমল করের কন্যা অনুভা কর, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়। অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রজন্মের কর্মক্ষেত্র হয়ে উঠল ‘বর্তমান’ গ্র“প।

কলকাতায় ফিরে গিয়ে কাকলী, শাহানা ও অনুভার সঙ্গে কথা বললেন সমরেশদা। আমাদের দুজনের লেখা ছাপাবার ব্যাপারে তাদের উৎসাহিত করলেন। গল্প চেয়ে আমাকে চিঠি লিখলেন কাকলী চক্রবর্তী। ‘সাপ্তাহিক বর্তমান’-এর জন্য লিখলাম ‘মানুষের আড়ালে মানুষ’ নামে একটি গল্প। গল্প পড়ে সমরেশদা খুশি হলেন। প্রায় একই সঙ্গে তিনটি চিঠি পেলাম আমি। কাকলী চক্রবর্তী লিখেছেন, লিখেছেন শাহানা নাগচৌধুরী আর একটা চিঠি যৌথভাবে লিখেছেন অনুভা কর ও পার্থ ঘোষ নামে একজন। তারপর শুরু হয়েছিল ওদের সঙ্গে আমার চিঠি লেখালেখি। প্রত্যেকের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হলো। প্রায়ই গল্প লিখতে লাগলাম ওদের কাগজে। ‘আলতাপরি’ নামে একটি বড়গল্প নিয়ে খুবই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল অনুভা। ওর ডাকনাম ‘পুচুন’।

এসবের কয়েক বছর পর কলকাতায় গিয়েছি। সঙ্গে গৌতম নামে আমার এক অনুজ বন্ধু। উঠেছি ‘টলি ক্লাব’-এ। সেখানে একদিন কাকলীদি দেখা করতে এলেন, একদিন এলেন শাহানাদি, আরেকদিন এলো অনুভা। অনুভার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল সবচাইতে গভীর। অনুভা মারা গেল ক্যান্সারে। আর গৌতম সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেল ব্যাংককে।

কলকাতায় সেবার ‘বর্তমান’ গ্র“পের তরুণ লেখক ও সাংবাদিকরা বড় একটা হোটেলে আমার সম্মানে পার্টির আয়োজন করেছিল। সেই অনুষ্ঠানে অনুভা আমার খুব যত্ন নিয়েছিল।

‘বর্তমান’ পুজোসংখ্যার জন্য গল্প চেয়ে চিঠি পাঠালেন কাকলীদি। বেশ খেটেখুটে একটা গল্প লিখলাম, ‘মেয়েটির কোনও অপরাধ ছিল না’। ফতোয়ার শিকার এক মেয়ের গল্প। পটভূমি আমার সেই প্রিয় নদী রজতরেখা তীরবর্তী এক গ্রাম। আমার অতিপ্রিয় লেখক হাসান আজিজুল হক প্রায়ই গল্পটির কথা বলতেন।

‘বর্তমান’ পুজোসংখ্যায় তারপর আমি উপন্যাস লিখেছি। ‘নূরজাহান’-এর একটি অংশ। সেই লেখা পড়ে বাংলাসাহিত্যের একজন খুব বিখ্যাত লেখক আমাকে চিঠি লিখলেন। তিনি ‘কেয়াপাতার নৌকো’ উপন্যাসের লেখক প্রফুল রায়। তখন তিনি ‘সংবাদ প্রতিদিন’ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক। পরের পুজোয় তাঁর পত্রিকার জন্য উপন্যাস চাইলেন। সেখানে লিখলাম ‘নূরজাহান’-এর আরেকটি অংশ। এ সময় এক যুবক এলেন ঢাকায়। ৩৮ নম্বর বাংলাবাজারের দোতলায় মিনুভাইয়ের পার্ল পাবলিকেশন্সের শোরুম। গেছি মিনুভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। যুবকের সঙ্গে তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাঁর নাম প্রদীপকুমার সাহা। শিশু কিশোরদের বিখ্যাত বইয়ের প্রকাশনা কলকাতার ‘নির্মল বুক এজেন্সি’র স্বত্বাধিকারী; নির্মলকুমার সাহার একমাত্র পুত্র। ‘নির্মল বুক এজেন্সি’ এখন প্রদীপই পরিচালনা করছে। পরিচয়ের পর প্রদীপ আমার বই চাইলেন। সেই প্রথম কলকাতার কোনও প্রকাশক আমার বই প্রকাশ করতে চাইলেন। কয়েক মাসের মধ্যে বই বেরোল ‘মানুষজন’। আমার পাঁচটি উপন্যাসের সংকলন। তারপর প্রদীপ আমার অনেক বই করেছেন। বেশির ভাগই শিশু কিশোরদের। তার মধ্যে ‘ভূতগুলো খুব দুষ্টু ছিল’ প্রায় রাতারাতি সাতটা আটটা এডিশন হয়ে গেল। নির্মলের ব্যবসায়ী পলিসি চমৎকার। ওরা বইয়ের দাম রাখে কম। কিন্তু বই বিক্রি করে প্রচুর। ১০ হাজারের কম কোনও সংস্করণ ছাপে না।

সে সময় আবার গেলাম কলকাতায়। প্রদীপ আমাকে রাতের খাবারে ডাকলেন ওদের ফ্ল্যাটে। আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি পশ্চিমবঙ্গের লোকজন খুবই কৃপণ হয়। বাড়িতে গেলে চা-ও খাওয়ায় না। আমি ওরকম একটা মনোভাব নিয়েই প্রদীপদের ফ্ল্যাটে গেছি। ভেবেছি সামান্য খাবার-দাবার হবে। গিয়ে বেশ বড় একটা ধাক্কা খেলাম। টেবিলভর্তি খাবার। একজন মানুষের জন্য বিশাল আয়োজন। মাছ মাংস শাক-সবজি চাটনি সব মিলিয়ে কমপক্ষে পনেরো কুড়ি আইটেম। প্রদীপের বাবা-মা, একমাত্র বোন আর স্ত্রী ভারি যত্ন আর সম্মান করলেন আমাকে। ফেরার সময় অতি বিনীত ভঙ্গিতে প্রদীপের স্ত্রী আমার হাতে একটা শপিংব্যাগ দিলেন, ‘এটা বউদির জন্য’। আমি খুলেও দেখিনি কী আছে ভিতরে। ঢাকায় আসার পর ব্যাগ খুলে আমার স্ত্রী দেখেন নীল রংয়ের একটা কাতান শাড়ি। এই শাড়ি সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা নেই। স্ত্রী বললেন, ‘অনুমান কর তো শাড়িটার দাম কত হতে পারে?’ আমি তাচ্ছিল্যের গলায় বললাম, ‘দু আড়াই হাজার হবে।’ ভদ্রমহিলা বললেন, ‘কমপক্ষে পঁচিশ হাজার টাকা।’ আমি হতবাক। পরে বহুবার প্রদীপের বিশাল হৃদয়ের পরিচয় আমি পেয়েছি। যখনই কলকাতায় গেছি প্রদীপ ছুটে এসেছেন আমার হোটেলে। হোটেলের বিল তিনি সব সময়ই পরিশোধ করেছেন। আমার হাতখরচের জন্য বিশ পঁচিশ হাজার টাকা গুঁজে দিয়েছেন পকেটে। কোনও হিসাবের বালাই নেই। আমি যা রয়্যালটি পাব, হয়তো তার তিন চারগুণ বেশি দিয়ে দিয়েছেন।

প্রদীপ আমাকে তিনজন লেখকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথমদিন নিয়ে গেলেন প্রফুল রায়ের ফ্ল্যাটে। প্রফুলদা আর তাঁর স্ত্রী দুজনেই বিক্রমপুরের। অনেক গল্প হলো বিক্রমপুর নিয়ে। এত নম্র বিনয়ী ভালো মানুষ প্রফুলদা! তাঁর স্ত্রীও তেমন। ফেরার সময় তাঁর অনেকগুলো বই উপহার দিলেন আমাকে। প্রফুলদার হাতের লেখা অপূর্ব। পরিচয়ের বহু বছর পর পাঁচজন বড় লেখকের সঙ্গে ‘আইআইপিএম সুরমা চৌধুরী স্মৃতি আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কার’ পেলাম আমি। ২০১২ সালে কলকাতায় গিয়ে গ্রহণ করতে হলো সেই পুরস্কার। পুরস্কার পেয়েছেন প্রফুল রায় তাঁর ‘কেয়াপাতার নৌকো’ উপন্যাসের জন্য, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পেয়েছেন ‘সেই সময়’ উপন্যাসের জন্য, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ‘খোয়াবনামা’র জন্য, সমরেশ মজুমদার ‘কালবেলা’ ট্রিলজির জন্য, সেলিনা হোসেন ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’র জন্য আর আমি ‘নূরজাহান’ এর জন্য। আমাদের হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন বাংলাসাহিত্যের এক কিংবদন্তি রমাপদ চৌধুরী। অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে সমরেশদা ঠাট্টা করে আমাকে বললেন, ‘রমাপদদার বয়স কত জানো? দেড়শোর কম হবে না।’ আমার সৌভাগ্য রমাপদ চৌধুরী সম্পাদিত ‘আনন্দ পাবলিশার্স’ থেকে প্রকাশিত ‘হীরক সংগ্রহ গল্প’ সংকলনে আমার ‘দেশভাগের পর’ গল্পটি ছাপা হয়েছে। বাংলাদেশের তিনজন লেখকের গল্প এই গ্রন্থে আছে। হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন ও আমি।

এক দুপুরে প্রদীপ আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব গুহের অফিসে। সে এক রাজকীয় অফিস। বুদ্ধদেবদা অতি প্রাণবন্ত মানুষ। নতুন কারও সঙ্গে পরিচয় হলেই তাঁকে একটা দামি কলম উপহার দেন। আমাকেও দিলেন। চা শিঙাড়ার ফাঁকে ফাঁকে গল্প করলেন অনেকক্ষণ। তারপর লাঞ্চ করাতে নিয়ে গেলেন একটা ক্লাবে। সারাটা দুপুর কাটালাম তাঁর সঙ্গে। গভীর বন্ধুত্ব হলো। বুদ্ধদেবদার আরেকটা স্বভাব তিনি চিঠি লিখতে খুব ভালোবাসেন। ‘বর্তমান’ আর ‘প্রতিদিন’ পত্রিকায় আমার গল্প পড়ে ভারি সুন্দর দুটো চিঠি লিখেছিলেন। ‘আনন্দ পাবলিশার্স’ থেকে প্রকাশিত তাঁর ‘রিইউনিয়ন’ বইটি আমাকে উৎসর্গ করেছেন।

তারপর প্রদীপ আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন শরৎচন্দ্রের পর যাঁকে বলা হতো বাংলাসাহিত্যের সবচাইতে জনপ্রিয় লেখক, সেই শংকরের ফ্ল্যাটে। যদিও পরবর্তীতে আমাদের হুমায়ূন আহমেদ শরৎচন্দ্র ও শংকরের জনপ্রিয়তা ডিঙিয়ে অনেক উপরে উঠে গেছেন। শংকর আমাদের যৌবনকালের অনেকটা অংশজুড়ে ছিলেন। মহান সত্যজিৎ রায় এই লেখকের দুটো উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ করেছেন। ‘সীমাবদ্ধ’ আর ‘জনঅরণ্য’। শংকর খুবই আন্তরিক ধরনের মানুষ। চা খাওয়ালেন, গল্প করলেন অনেকক্ষণ। ফেরার সময় যে কথাটি তিনি বললেন, এই জীবনে আমি তা কখনোই ভুলব না। খুবই আন্তরিক ভঙ্গিতে আমার কাঁধে হাত রাখলেন। অতি আপনজনের ভঙ্গিতে বললেন, ‘কোলকাতায় এসেছ, তোমার কাছে টাকা পয়সা আছে তো? আমার কাছ থেকে নিয়ে যাও।’ আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। অনেক পরে একবার ঢাকায় এলেন শংকর। ‘চৌরঙ্গী’সহ তাঁর বেশ কয়েকটি বই বের করেছে ‘ইউপিএল’। ঢাকা ইউনিভার্সিটির একটি হলে প্রকাশনা উৎসব হবে বইয়ের। শংকরদা এসেছেন সেই উপলক্ষে। তাঁর প্রিয়বন্ধু ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। তিনি রফিকুল হক সাহেবের বাড়িতেই উঠেছেন। আমার বন্ধু বদিউদ্দিন নাজির ‘ইউপিএল’-এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হিসেবে আমাকে সে আমন্ত্রণ জানাল। ভারি জমজমাট অনুষ্ঠান হলো। আর শংকরদার দীর্ঘ একটি সাক্ষাৎকার ভিত্তিক অনুষ্ঠান করলাম আমি ‘চ্যানেল আই’তে।

হুমায়ূন আহমেদ আর আমার জন্য ‘আনন্দবাজার’ গ্র“পের দরজাটাও খুলে দিলেন সমরেশ মজমুদার। নব্বই দশকের শেষদিককার কথা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর ‘আনন্দ পাবলিশার্স’-এর প্রকাশক বাদল বসু এসেছেন ঢাকায়। শেরাটন হোটেলে উঠেছেন। সেখানকার ‘সান্ধ্য আড্ডা’য় গিয়ে দেখি শামসুর রাহমান, রফিক আজাদ, বেলাল চৌধুরী, রবিউল হুসাইন আছেন। এক ফাঁকে সুনীলদা আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে ‘আনন্দবাজার’ গ্র“পের একটা মুখবন্ধ খাম ধরিয়ে দিলেন। পুজোসংখ্যা ‘আনন্দলোক’-এ উপন্যাস লেখার আমন্ত্রণপত্র। আমি এতটাই মুগ্ধ ও বিস্মিত। লোভ সামলাতে না পেরে চিঠিটা শামসুর রাহমানকে দেখালাম। কবি আমাকে আন্তরিক ভঙ্গিতে অভিনন্দন জানালেন। ’৯৫ সালে ‘নূরজাহান প্রথম পর্ব’ ছেপেছে ‘আনন্দ পাবলিশার্স’। পাঁচ হাজার বইয়ের এডিশন শেষ হলো অতি দ্রুত। প্রথম সংস্করণ আগস্ট ১৯৯৫, দ্বিতীয় মুদ্রণ এপ্রিল ১৯৯৬। ‘দেশ’ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন বেরোল ‘চোখের পলকে দ্বিতীয় মুদ্রণ’। বাংলাদেশের কোনো লেখকের ক্ষেত্রে এ ঘটনা প্রথম। পর পর তিন বছর উপন্যাস লিখলাম ‘আনন্দলোক’ পুজোসংখ্যায়। হুমায়ূন আহমেদ লিখলেন পর পর সাতবার ‘দেশ’ পুজোসংখ্যায়। ‘আনন্দলোক’ পুজোসংখ্যায় প্রথমবার লিখলাম ‘মৌসুমি’, দ্বিতীয়বার ‘সুতোয় বাঁধা প্রজাপতি’, তৃতীয়বার ‘প্রিয়’। পুজোসংখ্যায় প্রকাশিত উপন্যাস ‘আনন্দ পাবলিশার্স’ থেকে বই হয়ে বেরোয়। ঢাকায় প্রকাশকদের ব্যাপক তাগিদ থাকার ফলে উপন্যাস তিনটি আর ‘আনন্দ পাবলিশার্স’কে দেওয়া হলো না। এ প্রসঙ্গে আরেকটি খুব স্মরণীয় ঘটনা মনে পড়ে। বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ ‘আনন্দলোক’-এর সম্পাদক হয়ে এলেন। দ্বিতীয় অথবা তৃতীয়বার পুজোসংখ্যার উপন্যাসের জন্য তাঁর সই করা চিঠি এসেছিল আমার কাছে।

ঋতুপর্ণ পরে ‘প্রতিদিন’ পত্রিকায় যুক্ত হলেন। প্রতি রোববার ‘রবিবার’ নামে ভারি সুন্দর একটা ম্যাগাজিন শুরু করলেন তিনি। সেখানেও প্রায়ই লিখতাম। পরে ওই ম্যাগাজিনটির দায়িত্ব নিয়েছিলেন কবি জয় গোস্বামী। আরেকজন টগবগে তরুণ যুক্ত ছিলেন ‘রবিবার’-এ। সে গানের জগতের মানুষ। অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। তার ব্যান্ডের নাম ‘চন্দ্রবিন্দু’। পরে সিনেমা তৈরি করতে লাগল সে। বেশ আধুনিক চিন্তা-চেতনার মানুষ। ‘প্রজাপতি বিস্কুট’ নামে সিনেমা করল। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কিশোর উপন্যাস ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ সিনেমা করল। অনিন্দ্য আমার অতিপ্রিয় এক অনুজ বন্ধু।

কলকাতার সঙ্গে তারপর একটা গ্যাপ তৈরি হয়ে গেল। অনেকদিন আর আনন্দবাজার গ্র“পের পত্রপত্রিকায় লেখা হলো না। ২০২১ অথবা ২০২২ সালে ঢাকায় এলেন ‘আনন্দমেলা’র সম্পাদক সিজার বাগচী আর ‘সানন্দা’র সম্পাদক পায়েল সেনগুপ্ত। এক সন্ধ্যায় গুলশানের এক রেস্ট হাউসে ওদের সঙ্গে পরিচয় হলো। দুজনেই তরুণ। মেধা মনন সৃজনশীলতায়, চিন্তা-চেতনায় অগ্রসরমান। সিজার কথাসাহিত্যিক। গল্প উপন্যাস লেখেন। বাদল বসুর বিখ্যাত আত্মজীবনী ‘পিয়ন থেকে প্রকাশক’-এর অনুলেখক। তারপর অনুলেখন করেছেন সন্দ্বীপ রায়ের ‘আমার বাবা সত্যজিৎ রায়’। খুবই গুণী লেখক সিজার। ওর গল্প উপন্যাস আমি খুবই পছন্দ করি। ভাষাটি খুব সুন্দর সিজারের। পায়েল গল্প কবিতা লেখেন। তাঁর কবিতা আমি বিশেষভাবে পছন্দ করি। দুজনেই আমাকে তাঁদের পত্রিকায় লেখার আমন্ত্রণ জানালেন। ‘আনন্দমেলা’য় গল্প লিখলাম, বাংলাদেশের বিশেষ বিশেষ দিবস নিয়ে কিছু লেখা লিখলাম। ‘সানন্দা’তেও লেখালেখি শুরু হলো। ২০২৩-এর পুজোসংখ্যা ‘আনন্দমেলা’য় লিখলাম উপন্যাস ‘বুলু ও অচিন দ্বীপ’। ‘আনন্দ পাবলিশার্স’ থেকে বই হয়ে বেরোল। তার আগে বেরিয়েছে ‘নূরজাহান অখন্ড সংস্করণ’, ‘পঞ্চাশটি গল্প’, ‘পঞ্চাশটি ভূতের গল্প’। এগারোটি গল্প নিয়ে ‘দেশভাগের পর’ বইটি বেরিয়েছিল ১৯৯৮ সালে।

‘সানন্দা’য় গল্প লিখলাম ‘পূর্ণিমা সন্ধ্যায়’ নামে। পটভূমি রজতরেখার তীর। ‘বাবান’ নামে আমার একটি চরিত্র আছে। বাবানের বয়স সাত বছর। সে পশু পাখির ভাষা বোঝে, গাছ ও নদীর ভাষা বোঝে। তাদের কথা শুনতে পায়। অনেকগুলো গল্প লিখেছি বাবানকে নিয়ে। একেবারেই শিশুদের জন্য লেখা। একটা গল্প আছে ‘বাবান ও রজতরেখা নদীটি’। ‘বকুলতলা’ গল্পের পটভূমি কামাড়খাড়া গ্রাম। গ্রামের পাশের নদী সেই রজতরেখা। এক ফাল্গুনে মালেককাকাদের বাড়িতে গেছি। গভীর রাতে ঘুম ভেঙেছে। খোলা জানলা দিয়ে ঢুকেছে চাঁদের প্রখর আলো। ওই দেখে আমার যেন মাথা খারাপ হয়ে গেল। ওয়াজেদকাকা ঘুমাচ্ছে পাশে। সে টেরও পেল না, আমি দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। বাইরে বেরিয়ে মাথা খারাপ হয়ে গেল। এ কী অদ্ভুত জ্যোৎস্না! বোধহয় ফাল্গুনী পূর্ণিমা। পূর্ণিমার চাঁদ আমাকে পেয়ে বসল। আমি ‘চন্দ্রগ্রস্থ’ হয়ে গেলাম। আমার ভূতের ভয় প্রবল। একা ঘরে থাকতে পারি না। অন্ধকার ঘরে থাকতে পারি না। গ্রাম এলাকায় একা রাতে ঘর থেকে বেরোই না। সেই আমি ওরকম নির্জন রাত দুপুরে একা ঘর থেকে বেরিয়েছি? একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছি? একেই কি ‘চাঁদে পাওয়া’ বলে? ‘চন্দ্রগ্রস্থ’ হওয়া বলে? আমার তো একটুও ভয় করছে না? বয়স কত তখন? ১৮/১৯ হবে। হাঁটতে হাঁটতে বকুলগাছটার দিকে যাচ্ছি। দেখি গাছতলায় দুজন মানুষ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘আমি ঘরে থাকতে পারি না। আমি তোমার জন্য পাগল হয়ে গেছি। চলো, পালিয়ে যাই।’ ছেলেটি তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে ‘এত ভেঙে পোড়ো না, আমি একটা ব্যবস্থা করবোই।’ দূর থেকে দৃশ্যটি দেখে আমি ফিরে এসেছিলাম। সেই রাতটির কথা আমি কোনওদিন ভুলতে পারিনি। ওই দুজন মানুষকে মাথায় রেখে লিখেছিলাম, ‘মেয়েটির কোনও অপরাধ ছিল না’।

আমার গ্রামনির্ভর লেখাগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দুটো গ্রাম আর দুটো নদী। একটি গ্রামের নাম ‘মেদিনীমন্ডল’, আরেকটির নাম ‘কামারখাড়া’ অথবা ‘বেসনাল’। এক নদীর নাম ‘পদ্মা’, আরেক নদীর নাম ‘রজতরেখা’। শীতলক্ষ্যা থেকে বেরিয়ে রজতরেখা গিয়ে পড়েছে পদ্মায়। নদীটির সঙ্গে আমার জীবনের অনেক মিল। লেখালেখির এক উৎস থেকে যাত্রা শুরু করে আমি গিয়ে মিশেছি আরেক বিশাল উৎসে। ঢাকা ও কলকাতা। লেখক জীবনের শুরু থেকে খুবই আন্তরিকভাবে একটা জিনিসই চেয়েছি।

বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের লেখক পাঠক প্রকাশকরা আমাকে চিনুক, আমার লেখা পড়ুক। সেই বাসনার অনেকখানি পূর্ণ হয়েছে। তবু প্রকৃত লেখকের পথ কখনও ফুরায় না। নদীর মতোই সে চলমান থাকে। এক ঘাট থেকে পৌঁছায় আরেক ঘাটে। রবীন্দ্রনাথের গানের মতো, ‘নদী আপন বেগে পাগলপারা, পথে পথে বাহির হয়ে আপনহারা।’

                লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

সর্বশেষ খবর